Pages

Saturday, 30 June 2018

ইতিহাসের ভয়ঙ্কর যোদ্ধা জাতি -- সামুরাই

ইতিহাসের ভয়ঙ্কর যোদ্ধা জাতি -- সামুরাই
সামুরাইদের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হলো, তারা কারো কাছে পরাজিত হলে সে পরাজিত জীবন রাখতেন না। তারা মনে করতেন, এ লজ্জার জীবন রাখার চেয়ে মৃত্যুবরণ করাই শ্রেয়। শত্রুর কাছে পরাজয় বরণ করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে নিজের পেটে তলোয়ার চালিয়ে আত্মহত্যা করতেন তারা।
সামুরাইরা এই আত্মহত্যাকে খুব সম্মানী চোখে দেখতেন। মাঝে মাঝে তারা এ আত্মহত্যার একটি অনুষ্ঠানও পালন করতেন। অনুষ্ঠানটির নাম হারা-কিরি বা সেপ্পুকু। এ অনুষ্ঠানে পরাজিত ব্যক্তি জনসমুক্ষে আত্মহত্যা করতেন।

x

আমরা অনেকেই জাপানের সামুরাই যোদ্ধাদের ইতিহাস শুনেছি। জাপানি ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে আছে তাদের অবস্থান। ইতিহাসে তাদের বীরযোদ্ধা বলে মনে করা হয়। কারণ যুদ্ধে পরাজয়কে তারা ঘৃণা করে, তাদের যুদ্ধে পরাজয়ের ইতিহাস খুব কম। তারা কোনো জাতির কাছে পরাজিত হলে নিজের শরীরে তলোয়ার চালিয়ে আত্মহত্যা করে।
সামুরাই হল জাপানের প্রাক-শিল্পাঞ্চল যুগের সামরিক বাহিনীর সদস্য যা অনেকের কাছে জাপানী যোদ্ধা হিসেবেও পরিচিত। এর অন্য আরেকটা নাম হল 'বুশি'। জাপানী  শব্দ 'সাবুরাই' থেকে 'সামুরাই' শব্দটির উৎপত্তি ঘটেছে। যার অর্থ হচ্ছে কাউকে সেবা করা। ইদো শাসনামলে সামুরাই শব্দটির সর্বশেষ প্রয়োগ হয়েছিল। ১০ম শতকে জাপানী কবিতার প্রাথমিক সংকলন গ্রন্থ 'কোকিনোয়াকাশু' তে প্রাচীন ও আধুনিককালের সংমিশ্রণের গড়া জাপানী কবিতায় এর প্রথম উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

তাঁরা বিভিন্ন অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করতে অধিকারী ও পারদর্শী ছিলেন। তার মধ্যে ‘কাতানা’ নামের এক ধরনের লম্বা তলোয়ার খুব প্রিয় ছিল তাদের কাছে। এই তলোয়ার জাপানের অন্যতম একটি আবিষ্কার ছিল যা পরবর্তী কালে মঙ্গল আক্রমনে প্রচুর কার্যকারী হয়। তলোয়ারটি বিশেষ রিতি মেনে এক প্রক্রিয়ায় তইরি হত এবং অসাধারণ ধারাল শক্তিশালী হত। এটি সম্মানের প্রতিক হিসাবেও ধরা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দেখা গেছিলো এই কাতানার এক কোপে কামান কেটে ফেলতে তাহলে ভাবুন পুরান দিনের তলোয়ার গুলি কত ভয়ানক ছিল!

একেকজন সামুরাই বিশ্বাস করেন যে তলোয়ারই তার আত্মাকে ধারন করে আছে,আর তাই তারা তলোয়ারকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হিসেবে মনে করেন। তাদেরকে যথোপযুক্ত সম্মান না করলে তাদেরকে যে কারোর সাথেই যুদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া হত। প্রত্যেকটি তলোয়ারই পরীক্ষা করার জন্য তৈরী করার জন্যে তলোয়ার ধারক যে-কোন অপরাধীকে হত্যা করার মাধ্যমে তলোয়ারের ধারালো অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে পারতেন। সামুরাইরা বিশ্বাস করতেন তলোয়ারই তাদের আত্মাকে ধারণ করে আছে। তাই তলোয়ারই তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

বিখ্যাত সিনেমা ‘কিল বিল’, ‘দি লাস্ট সামুরাই’ ইত্যাদিতে কাতানাকে দেখে থাকবেন।

তাদের বানানো প্রতিটি তলোয়ারই এমন ধারালো ও তীক্ষ্ণ ছিল যে তা যেকোনো যোদ্ধার স্বপ্নের হাতিয়ার হতে পারে। প্রতিদিন তলোয়ারগুলো পূজা-অর্চনার মাধ্যমে পরিশোধন করা হতো। জলেরর মধ্য দিয়ে তরবারি চালিয়ে মাছ শিকার করা, পাহাড়ে-বনে জঙ্গলে গিয়ে যুদ্ধ করা এ সবই যেন ধর্মীয় উপাসনার চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না।

তারা ডান হাতে অস্ত্র ধরতেন। সবসময় দুটি তলোয়ার নিজের কাছে রাখতেন। কোন যুদ্ধ না থাকলে না ‘কাতানা’ এবং ‘ওয়াকিজাশি’ নামক ছোট তলোয়ার দুটি সঙ্গে রাখতেন। তার সাথে যুদ্ধের সময় ‘তাচি’ নামের লম্বা তলোয়ার ও  ‘টান্তো’ নামের ছোট তলোয়ার সঙ্গে রাখতেন।

৭১০ সাল থেকে সামুরাইদের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়। ধারণা করা হয় তাদের উৎপত্তিও সে সময় থেকে। তারা জাপানের 'তোহুকু' অঞ্চলে বাস করতেন। সামুরাই গোষ্ঠীর সৃষ্টির পর থেকেই যুদ্ধ বিদ্যায় খুব সুনাম অর্জন করেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী যুদ্ধবিদ্যার সঙ্গে থেকে এক সময় জাতীয় যোদ্ধাতে পরিণত হয়। এক সময় জাপান সরকার তাদের জাতীয় যোদ্ধার সন্মানে সম্মানিত করেন। তারা ১২ শতাব্দী থেকে ১৯ শতাব্দী পর্যন্ত জাপানের শাসকশ্রেণীর সঙ্গে ছিলেন।

সামুরাইরা কনফুসিয়াসের অলিখিত কিছু যুদ্ধনীতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। প্রভুর প্রতি আনুগত্যবোধআত্মনির্ভরশীলনিয়মানুবর্তিতানৈতিক আচরণ ইত্যাদি ছিল তাদের কাছে প্রধান পালনীয় বিষয়। কোনো সামুরাই যদি মনে করতেন তারা এসব মেনে চলতে ব্যর্থ হয়েছেন বা পরাজয় বা 'বুশিদো' নীতি মেনে না চলার কারণে সামুরাই অসম্মানিত হলে তাকে অবশ্যই সেপ্পুকু নামের আনুষ্ঠানে  প্রকাশ্যে আত্মহত্যা করতে হয়। এই কারণে যুদ্ধক্ষেত্রেও সম্মানিত হয়ে থাকতেন।


যখন সামুরাই তার প্রভু বা শিক্ষকদের হারাতেন তখন তা 'দাইমিও' নামে আখ্যায়িত করা হতো এবং তিনি 'রোনিন' নামে পরিচিত হতেন।  তাদের কাছে অসম্মানের চেয়ে মৃত্যুই অধিকতর শ্রেয়। যুদ্ধক্ষেত্রে সেপ্পুকু নামের আনুষ্ঠানিক আত্মহত্যায় শত্রুর হাতে ধৃত হবার পূর্বে তারা তাদের পেট কেটে ফেলেন। প্রায় ৮০ বছর আগে অস্তিত্ব ছিল।

সমাজের চোখে বীর যোদ্ধা সামুরাইদের কদরই ছিল অন্যরকম। তাই ছেলেকেও সামুরাই বানাতে ছোট বেলা থেকেই কঠোর হাতে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হতো। সামুরাই হবার এই প্রশিক্ষণের সময় প্রায়ই নির্দয় ভাবে পিতার হাতে মার খেতে হত। আঘাতে ক্ষত বিক্ষত আর রক্তাক্ত হতো শিশুদেহ।

বিখ্যাত "ডাবল সোর্ড" কৌশল, একহাতে "কাতানা" আর এক হাতে "ওয়াকিজাশি" নিয়ে দুই হাতেই সমান দক্ষতায় সামনে পিছনে শত্রুর মোকাবেলা করা। আর তলোয়ারবাজি ছাড়াও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দক্ষতা হচ্ছে মুখোমুখি লড়াইয়ে একাগ্রতা ধরে রেখে শত্রুর উপর মনস্তাত্ত্বিক বিজয় লাভের কৌশল।

হেইয়ান সময়কালে (৭৯৪-১১৮৫) , সামুরাইরা ছিল ধনী জমির মালিকদের সশস্ত্র কর্মী।
১২ শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, জাপানে আসল রাজনৈতিক শক্তি ধীরে ধীরে সম্রাটের কাছ থেকে দূরে চলে যায় এবং কিয়োটো অঞ্চলে তার উত্তরাধিকারীগণ তাদের বৃহৎ এস্টেটে গোষ্ঠীর প্রধানদের দিকে চলে যায়। জেমপেরির যুদ্ধ (১১৮০-১১৮৫) জাপানের রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি মাইলফলক। এখানে একে অপরের বিরুদ্ধে দুটি-প্রধান প্রভাবশালী গোষ্ঠী টায়রা এবং মিনামোটো যুদ্ধ করে । জাপানের ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত সামুরাই হিরোদের মধ্যে একজন, মিনামোটো ইয়োশিৎসুন, দান--উরা গ্রামের কাছে টায়রা গোষ্ঠী-র বিরুদ্ধে বিজয় অর্জনে গোত্রের নেতৃত্বে ছিলেন।
বিজয়ী নেতা মিনামোটো (ইয়োশিৎসুনের অর্ধ-ভাই, যাকে তিনি নির্বাসনে রেখেছিলেন) কামাকুরাতে সরকার কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। কামাকুরা শোগুনাতে(একটি বংশগত সামরিক একনায়কত্ব) প্রতিষ্ঠার পর জাপানে সমস্ত বাস্তব রাজনৈতিক ক্ষমতা স্থানান্তরিত হয় সামুরাইদের হাতে। মিনামোটো কর্তৃপক্ষ তাদের শক্তির উপর নির্ভর করে, তিনি সামুরাইয়ের বিশেষ অধিকার বাস্তবায়ন করেছিলেন।কেউই মিনামোটোর অনুমতি ছাড়া নিজেকে সামুরাই ঘোষণা করতে পারত না।

চীনের কাছ থেকে জাপানে বৌদ্ধধর্ম চালু হয়, যা সামুরাইদের কাছে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়। নান্দনিক এবং সরল রীতিনীতি, সেইসাথে বিশ্বাস, এটি একটি আদর্শ দার্শনিক পটভূমি প্রদান করে যা সামুরাইরা নিজের আচরণবিধি কোড বুশিডোর জন্য পছন্দ করে । কামাকুরা সময়কালে, তরবারি সামুরাই সংস্কৃতিতে একটি মহান তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। একজন মানুষের সম্মান তার তলোয়ারের উপর অনেকটা নির্ভর করত।
13 তম শতাব্দীর শেষের দিকে দুটি মঙ্গোল আক্রমণের পরাজয়ের কারণে কামাকুরা শগুনাতে দুর্বল হয়ে পড়ে, যার ফলে আশিকাগা তাকাউজির নেতৃত্বে বিদ্রোহ হয়। আশিকাগা শোগুনাত প্রায় 1336 খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়।এর কেন্দ্র হয় কিয়োটোতে। পরবর্তী দুই শতাব্দীর জন্য জাপান তার আঞ্চলিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একটি সংঘাতের মধ্যে ছিল। ১৪৬৭-৭৭ সালে যুদ্ধের পর অশিকাগা শোগুনাত মোটামুটি অকার্যকর হয়ে যায়। সেই সময় সামন্ততান্ত্রিক জাপানে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের অভাব ছিল। যদিও রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও, এই সময়ে জাপানে যথেষ্ট অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছিল।
যুদ্ধকালীন সময় অবশেষে শেষ হয় ১৬১৫ সালে যখন তগুকাওয়া এর অধীনে জাপান এক হয়। এই সময়েই জাপানের শান্তি ও সমৃদ্ধি বাড়তে থাকে। প্রায় ২৫০ বছর এমনটা চলতে থাকে।প্রথমবারের মতো সামুরাইরা সামরিক মাধ্যমের পরিবর্তে নাগরিক মাধ্যমের মাধ্যমে শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তকুগাওয়া “মিলিটারী হাউজেজ অর্ডার” জারি করেন, যার দ্বারা সমানভাবে সকল সামুরাইকে  অস্ত্র মাধ্যমে এবং কনফুসিয়াসবাদের নীতি অনুযায়ী “নম্রতা” শেখানো হয়। এই ভাবে রক্ষণশীল বিশ্বাস, আনুগত্য ও কর্তব্যের ওপর জোর দিয়ে, তোকুগাওয়া বৌদ্ধ ধর্মকে সামুরাই এর প্রভাবশালী ধর্ম হিসেবে আবির্ভূত করেছিলেন। এই সময়ের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের মূলনীতি সাধারণ জনগণের আচরণের মধ্যে খাপ খেয়ে যায়। যদিও বৌদ্ধবিহারের বৌদ্ধ চিন্তাধারা ও কনফুসিয়ান চিন্তাধারার প্রভাবের মধ্যে পার্থক্য ছিল, তাতে যোদ্ধা আত্মা তখনও অব্যাহত ছিল। শত্রুদের মুখোমুখি সামরিক দক্ষতা এবং নির্ভীকতার ওপর জোর দেওয়া ছিল।
বুশিডো নীতিতে পরিবার, বিশেষত বয়স্কদের জন্য দুর্বলতা, উদারতা, সততা এবং যত্নের উপর জোর দেওয়া হয়েছে।
‎ শান্তিপূর্ণ জাপানে, অনেক সামুরাইকে আমলাতান্ত্রিক হতে বা কোনও ধরনের বাণিজ্য করতে বাধ্য করা হতো।এমনকি তারা নিজেদের যুদ্ধের জন্য লড়াই করার মতো নিজেদেরকে রক্ষা করে।তারা নিজেদের যোদ্ধা হিসেবে ভাবতেই পছন্দ করত।
‎ ১৫৮৮ সালে, তলোয়ার বহন করার অধিকার শুধুমাত্র সামুরাইদের জন্য সীমিত ছিল, যা তাদের এবং কৃষক শ্রেণীর মধ্যে আরও বড় বিচ্ছেদ সৃষ্টি করেছিল। এই সময় বেশিরভাগ সামুরাইয়ের আসল গুরুত্ব হ্রাস পায়। সামুরাইরা ঐতিহ্যগতভাবে জমির মালিকদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট জায়গায় তাদের জীবিকা নির্বাহ করতেন। জমির মালিকের দেওয়া বৃত্তি দিয়ে তাদের দিন চলত।যখন এই বৃত্তি বন্ধ হয়ে যায়,তা সামুরাইদের কষ্টে ফেলেছি। অনেক নিম্ন স্তরের সামুরাই তাদের পরিস্থিতি উন্নয়নে তাদের অক্ষমতার জন্য হতাশ ছিল।
১৯শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র‍্য সহ বিভিন্ন কারণে তোকুগাওয়ার রাজ্যের স্থিতিশীলতা হ্রাস পায়। কৃষকদের মাঝে অস্থিরতা দেখা যায়।পশ্চিমা শক্তিগুলো এসময় চাপ প্রয়োগ করে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিষয়ে অনেক কাঠখড় পোড়ানো হয়। পশ্চিমা শক্তিগুলো জাপানের উপর বন্ধক চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করে। ১৮৫৩ সালে মার্কিন নৌবাহিনীর কমোডর ম্যাথিউ সি পেরি-এর আগমনের পর, জাপানকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে তার দরজা খুলে দেওয়ার জন্য একটি মিশন প্রদান করা হয়েছিল যা ছিল বেশ অপমানজনক। তোকুগাওয়া এ সময় একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে। ১৮৫৮ সালে, জাপান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষর করে।পরে রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং হল্যান্ডের সাথেও এমন বাণিজ্যিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয় জাপান। পশ্চিমা বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য দেশটির এমন বিতর্কিত সিদ্ধান্ত জাপানের রক্ষণশীল শক্তির মধ্যে বেশ খানিকটা ক্ষোভের সঞ্চার করে ও তকুগাওয়ার ভিত অনেকটা নড়ে যায়।অনেক সামুরাই সহ আন্দোলন কারীরা সম্রাটের শক্তি পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানায়। তোকুগাওয়া শোগুনাতকে উৎখাত করার জন্য চৌশু ও সন্তুমামের শক্তিশালী গোষ্ঠীগুলি ১৮৬৮-এর গোড়ার দিকে সম্রাট মেইজির নামে একটি “রাজকীয় পুনর্গঠন” ঘোষণা করেছিল। সামুরাইদের সমস্ত বৃত্তিগুলি সরকারি বন্ডে রূপান্তরিত হয়, এবং এতে কিছু উল্লেখযোগ্য আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়ে সরকার। নতুন জাপানি জাতীয় সেনাবাহিনী ১৮৭০-এর দশকে বিভিন্ন সামুরাই বিদ্রোহকে বাতিল করে দিয়েছিল।কিছু অসংলগ্ন সামুরাই গোপনে অতি-জাতীয়তাবাদী সমাজে যোগদান করেছিল, তাদের মধ্যে কুখ্যাত ব্ল্যাক ড্রাগন সোসাইটি, তাদের উদ্দেশ্য ছিল চীনে সমস্যার সৃষ্টি করা যাতে জাপান সেনাবাহিনী একটি অজুহাত দেখাতে পারে চীন আক্রমণ করার জন্য।
সামুরাইরা তাদের সুবিধাজনক ব্যাপার গুলোকে বিসর্জন দিয়ে মেইজি রেস্টোরেশন শুরু করেছিল। এটি তাদের অধিকার অনেকাংশেই ক্ষুন্ন করেছিল।নতুন জাপান এর সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতাদের মধ্যে তিনজন ইনউই কেরু, ইটোর হিরোবুমী এবং যমগাটা আরিতোমো।তিনজনই বিখ্যাত সামুরাই ইয়োশিদার ক্লাসমেট ছিলেন। ইয়োশিদা ১৮৫৯ সালে একজন তকুগাওয়া অফিসার হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর মৃত্যুদন্ড পেয়েছিলেন।সামুরাইরাই জাপানের ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। জাপানে কি হবে না তারাই স্বপ্ন দেখায়। আধুনিক সমাজের সব অঞ্চলে নেতা হয়ে উঠবে তারা।
মেইজি পুনরুদ্ধারের পরে, শিনতোকে জাপান রাষ্ট্রের ধর্ম বানানো হয়েছিল (কনফুসীয়বাদ, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টীয়তা থেকে ভিন্ন, এটি সম্পূর্ণরূপে জাপানী ছিল) এবং বুশিডোকে তার শাসনতান্ত্রিক কোড হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছিল। ১৯১২ সালের মধ্যে জাপান তার সামরিক শক্তি গড়ে তোলার জন্য সফল হয়েছিল। ১৯০২ সালে ব্রিটেনের সাথে একটি জোটের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং দুই বছর পর মানচুরিয়াতে রাশিয়ানরা পরাজিত হয়-এর পাশাপাশি এর অর্থনীতিতেও ধ্বস নামে। বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইতালির পাশাপাশি “বিগ ফাইভ” ক্ষমতার একটি হিসাবে স্বীকৃত ছিল জাপান।
১৯২০ এর দশক ছিল উদার পন্থী। এসময় সামরিক বাহিনীতে আসে পরিবর্তন। ১৯৩০-এর দশকে জাপানের সামরিক ঐতিহ্যের একটি পুনরুজ্জীবনের পথ উন্মুক্ত হয়েছিল, যা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের দিকে অগ্রসর হয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের অনুপ্রবেশের নেতৃত্ব দেয়। এই সংঘর্ষের সময়, জাপানী সৈন্যরা এন্টিকের সামুরাই তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং অসম্মানের আগে বা মৃত্যুর বুশোদো নীতি অনুযায়ী আত্মঘাতী “বাজাই” আক্রমণ করে। যুদ্ধের শেষদিকে, জাপান আবার একটি সাধারণ কারণে সম্মান, শৃঙ্খলা ও নিষ্ঠার অনুভূতি প্রকাশ করে- অতীতের ডাইমোস বা শোগুনাত নয়, বরং সম্রাট এবং দেশকে তারা ভালবাসার প্রমাণ দেয়। এতে করে বিংশ শতাব্দীতে নিজেদের পুনর্নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণের জন্য বিশ্বের  অন্যতম  অর্থনৈতিক ও শিল্প শক্তি হবার পথে এগিয়ে যাচ্ছে তারা।

Saturday, 16 June 2018

বাংলার বর্গী রহস্য--


ঘুমানোর আগে ছেলেবেলায় এই ছড়াটি প্রচুর শুনেছি , এর আরও বড় অংশ খুজে পেলাম -

ছেলে ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো
বর্গী এল দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কিসে।।
ধান ফুরল, পান ফুরল
খাজনার উপায় কি?
আর ক’টা দিন সবুর কর
রসুন বুনেছি।।
ধনিয়া পিয়াজ গেছে পচে
সর্ষে ক্ষেতে জল
খরা-বন্যায় শেষ করিল
বর্ষ এর ফসল।
ধানের গোলা, চালের ঝুড়ি
সব শুধু খালি
ছিন্ন কাপড় জড়িয়ে গায়ে
শত শত তালি
ধানের গাছ, বিলের মাছ
যাই কিছু ছিল
নদীর টানে বাঁধটি ভেঙ্গে
সবই ভেসে গেল।
এ বারেতে পাঁচ গাঁয়েতে
দিয়েছি আলুর সার
আর কটা দিন সবুর করো
মশাই জমিদার।


কারও কারও নিশ্চয় মনে হয়েছে, এই বর্গি কারা? তাদের এত ভয় পাওয়ার কী আছে? মনে হত এরা কি কোন দৈত্য- দানব? কিন্তু হাজার প্রশ্ন করেও কারও কাছে সঠিক তথ্যও পেতাম না।
ইতিহাসের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে জানতে পারলাম, বর্গীরা আসলে মারাঠা জাতির এক গোষ্ঠী এবং তারা কথা বলে মারাঠী ভাষায় ।
মারাঠি ধনগর জাতীয় লোকেরা অভিযানে যাওয়ার সময় কেবলমাত্র একটি সাত হাত লম্বা কম্বল ও বর্শা নিয়ে বের হত। এই বর্শাকে মারাঠি ভাষায় বলা হত ‘বরচি’। এই নাম থেকেই ধনগররা ‘বারগির’ বা ‘বর্গা’ ধনগর বা ‘বর্গি’ নামে পরিচিত হয়।

আবার অন্য এক মতানুসারে বর্গি শব্দটি মারাঠি বারগির শব্দের অপভ্রংশ। বারগির বলতে মারাঠা সাম্রাজ্যের সেই সব অশ্বারোহীদের বোঝাত। বর্গি শব্দটা এসেছে ফারসি ‘বারগিস’ থেকে, যেটার অর্থ ‘প্রাচীন মারাঠা যোদ্ধা’। হাতে তাদের থাকত তীক্ষ্ণফলা বর্শা। মারাঠাদের আসল নিবাস ভারতের মহারাষ্ট্র শহরে হলেও দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতজুড়েই কিন্তু তারা ছড়িয়ে। আলিবর্দি খাঁ যখন বাংলার সিংহাসনে, সে সময় দিল্লির ক্ষমতায় ছিল মোগলরা। সে সময় এই মারাঠাদের যোদ্ধা হিসেবে নামডাক ছিল। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মোগলদের সঙ্গে মারাঠাদের ভয়ংকর যুদ্ধ হয়েছিল। এই মারাঠাদের কিছু পথচ্যুত সেনাই একসময় পরিচিত হয়ে যায় বর্গি নামে। ভারতজুড়েই তারা শুরু করে তাণ্ডব।

বাংলায় তখন চলছে আলিবর্দি খাঁর যুগ। আলিবর্দি খাঁ, যে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা, সেই সিরাজউদ্দৌলার পিতামহ হলেন এই আলিবর্দি খাঁ। তার রাজত্বে বাংলার মানুষের অভাব হয়তো ছিল, কিন্তু অশান্তি ছিল না তেমন। কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই বাংলার আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা!
কথা নেই, বার্তা নেই, একদল লুটেরার উৎপাত শুরু হয়ে গেল মুর্শিদাবাদের গ্রামগুলোতে। রাতের আঁধারে একদল লোক ঘোড়া টগবগিয়ে হানা দিতে থাকল।
মুর্শিদাবাদ নগরে বাস করত জগৎ শেঠ নামে এক ধনী সওদাগর । বর্গীরা তার কাছ থেকে ৩ লক্ষ টাকা আদায় করে নেয়। তারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে থাকল, লোকজনকে মেরে-ধরে সবকিছু কেড়ে নিতে থাকল। দোকানপাট সব তাদের অত্যাচারে বন্ধ হয়ে গেল, মানুষজন ভয়ে ঘর থেকে বেরুনো বন্ধ করে দিল। শান্ত বাংলা যেন হঠাৎ করেই আতঙ্কের বাংলা হয়ে উঠল।
আলিবর্দি খাঁ যখন খবর পেলেন, মুর্শিদাবাদে এ রকম বর্গিরা আক্রমণ করেছে। বর্গিদের ঠেকাতে সৈন্যসামন্ত নিয়ে ৭ মে নওয়াব আলীবর্দী খান মুর্শিদাবাদ উপস্থিত হন।। কিন্তু বর্গিরা ছিল ভীষণ দুর্ধর্ষ। নবাবের বাহিনীকে ঘিরে রেখে তারা সব রসদের পথ বন্ধ করে দেয়। সেবার অনেক কষ্টে বর্গিদের হাত থেকে নিস্তার পান নবাব।
ততক্ষণে মুর্শিদাবাদের অনেকটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে বর্গীরা পালিয়ে গেছে আরও দক্ষিণে।


সেই তাণ্ডবের ঢেউ বাংলায় এল কীভাবে? এখানেও একটু ইতিহাস শোনাতে হচ্ছে।
সম্রাট আওরঙ্গজেব দক্ষিণ ভারতের সামরিক অভিযানের সময় মারাঠা রাজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার ফলে মারাঠা সৈন্যরা রোষবশত ভারতবর্ষে মুগল শাসিত প্রদেশ গুলিতে লুঠপাঠ আরম্ভ করে। সুবা বাংলা ছিল যার অন্যতম।
আলিবর্দি খাঁর শ্যালক রুস্তম জং ছিলেন উড়িষ্যার উপশাসক (নায়েবে আজম)।রুস্তম জং কোন এক কারনে বলে বসেন, তিনি খাঁ সাহেবের কতৃ‌র্ত্ব মানবেন না। তখনকার দিনে যেটা হতো, এ রকম বিদ্রোহ করলে যুদ্ধ ছিল একেবারে অনিবার্য। তো যুদ্ধ হলো, সেই যুদ্ধে রুস্তম ভগ্নিপতির কাছে হারও মানলেন। আলিবর্দি খাঁ তাঁকে উপশাসকের পদ থেকে সরিয়ে দিলেন। রুস্তম তখনকার মতো রণেভঙ্গ দিলেন, কিন্তু তক্কে তক্কে ছিলেন কী করা যায়।
সেই সময় নাগপুরের রাজা ছিলেন রঘুজিৎ ভোঁসলে। রুস্তম ভোঁসলেকে গিয়ে ধরলেন, উড়িষ্যা তার ফেরত চাই-ই চাই। ভোঁসলের সাহাযে্য রুস্তম আবার উড়িষ্যা দখল করলেন। কিন্তু রুস্তমের কপালে বেশিদিন সুখ সইল না। আলিবর্দি খাঁ আবারও রুস্তমকে হারিয়ে উড়িষ্যা নিজের কব্জায় নিয়ে নেন। এদিকে সর্বনাশ যা হওয়ার তা কিন্তু হয়ে গেছে। বিপথগামী মারাঠা সৈন্য এসে পড়েছে বাংলায়। সালটা ছিল ১৭৪২। তারা এসেই শুরু করে দারুণ অত্যাচার। নিরীহ মানুষজনকে ধরে ধরে মেরে ফেলতে থাকে। এই বর্গিদের সর্দার ছিলেন ভাস্কর পণ্ডিত।

আক্রমণ তো আর কমে না। তারা লুটতরাজ চালিয়ে যেতে থাকে গ্রামে গ্রামে। আলিবর্দি খাঁ এবার সৈন্যসামন্ত বাড়িয়ে তাদের দেশছাড়া করতে আসেন। কিন্তু বর্গিরা কি এত সহজে পিছু হটার পাত্র নয়। মুর্শিদাবাদ থেকে তারা পালিয়ে যায় দক্ষিণে হুগলিতে। সেখানে গিয়ে তারা নতুন করে আস্তানা গাড়ে।
হুগলি জায়গাটি মুর্শিদাবাদের দক্ষিণে। ১৭৪২ সালের জুলাই মাসে, অর্থাৎ মুর্শিদাবাদ আক্রমনের ২ মাস পর হুগলি জেলায় বর্গীরা একটি সৈন্য শিবির স্থাপন করে এবং খাজনা আদায় করতে লাগল।বর্গীদের অমানুষিক অত্যাচারে তাঁতিরা বীরভূম থেকে পালিয়ে যায় ।
এদিকে ব্যবসা-বাণিজ্য তখন লাটে ওঠার জোগাড়, মানুষ না খেতে পেয়ে মরার পথে।

সপ্তদশ ও অস্টাদশ শতকে বাংলার রেশমি কাপড়ের আড়ংগুলি(আড়ং শব্দটা ফারসি। আড়ং বলতে বড় আকারের বাজারকে বোঝায়) ছিল জমজমাট। বর্গী আক্রমনে আড়ংগুলি লোকশূন্য হয়ে পড়ে, আড়ংগুলি খাঁ খাঁ করতে থাকে। বাংলার অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়তে থাকে। বাংলাজুড়ে খাদ্যশস্যের অভাব দেখা দেয়, ব্যবসা-বানিজ্য বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। যা হোক। বর্গীরা খাজনা বা চৌথ আদায় করতে থাকে এবং পুবের যশোর জেলা অবধি বর্গীদের খাজনা আদায় ক্রমেই স¤প্রসারিত হতে থাকে। বর্গীদের নির্মম অত্যাচারে বহু লোক ভিটেমাটির মায়া ত্যাগ করে গঙ্গার পূর্বাঞ্চলে ( বর্তমান বাংলাদেশে) চলে আসে। পূর্বাঞ্চলের বাঙালিরাও বর্গী লুন্ঠনের শিকার হয়। কেন?
এবার বাংলার ইতিহাসের এক বিচিত্র প্রসঙ্গে আসি। মীর জাফরের আগেও বাংলায় আরও একজন বিশ্বাসঘাতক ছিল! বিশ্বাসঘাতক সেই পাষন্ড লোকটার নাম মীর হাবিব। পারস্য সেই অভিজাতটি এক সময় নওয়াব আলীবর্দী খানের ঘনিষ্ট ছিল ; অথচ, এই লোকটিই স্থানীয় গুপ্তচর হিসেবে বর্গীদের সাহায্য করত! বাংলা সম্বন্ধে খুঁটিনাটি জ্ঞান ছিল তার। বর্গীরা সে জ্ঞান প্রয়োগ করে সহজেই বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত!

১৭৪২ সালের মাঝামাঝি বাংলা থেকে বর্গীদের নিমূর্ল করার কঠিন সিদ্ধান্ত নেন নওয়াব আলীবর্দী । , নওয়াবের এ সিদ্ধান্ত অবশ্য বাঙালিদের ভালোবেসে নয়, দিল্লির প্রাপ্য খাজনায় বর্গীরা ভাগ বসাচ্ছিল বলেই।
১৭৪৩ সালে বর্গীরা মেদিনীপুর আক্রমন করে। নওয়াব আলীবর্দীর নেতৃত্বে মুগল সৈন্যরা মেদিনীপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ৯ ফেব্রুয়ারি দুপক্ষের তুমুল সংর্ঘষ হয়। নওয়াব আলীবর্দীর উন্নততর রণকৌশলের ফলে মেদিনীপুর থেকে বর্গীরা উৎখাত হয়ে যায়। তবে লাভ হয়নি। ১৭৪৪ সালের ফেব্রয়ারি মাসে বর্গী নেতা ভাস্কর পন্ডিত আবার বাংলা আক্রমন করে বসে।
আলিবর্দি খাঁ কম চেষ্টা করেননি তাদের পরাস্ত করতে। একবার তো কূটকৌশলের আশ্রয় পর্যন্ত নিয়েছিলেন। আলোচনা করার জন্য ২১ জন বর্গিসহ ভাস্কর পণ্ডিতকে আমন্ত্রণ জানান নিজের তাঁবুতে। আমন্ত্রণ রক্ষা করতে এলে তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায় নবাবের লোকেরা। ভাস্কর পণ্ডিত মারাও যান, কিন্তু লাভের লাভ কিছু হলো না। কিন্তু এত কিছু করেও বর্গিদের টলানো যায়নি। পরে রঘুজি ভোঁসলে নিজেই বাংলা আক্রমণ করেছিলেন। দুর্ধর্ষ বর্গিরা কিছু সময়ের জন্য পিছু হটলেও বাংলা ছাড়ল না, ঘুরে ঘুরে চালাতে লাগল তাদের দস্যুবৃত্তি। ১৭৫০ সালের বর্গীরা আবার বাংলায় হানা দেয়। ১৭৫১ সালে বর্গী আক্রমনের তীব্রতা এতই বেড়ে যায় যে একরকম ‘ত্যাগ’ স্বীকার করেই কিন্তু ওদের দূর করতে হয়েছে, এক চুক্তির অংশ হিসেবে আলিবর্দি খাঁ বর্গিদের হাতে উড়িষ্যা ছেড়ে দেন। বাংলা থেকে দূর হয় একটা অভিশাপের। কিন্তু এই নয় বছরে যে ত্রাস তারা চালিয়েছিল, সে জন্য তাদের নামে লেখা লোকগানটা পাকাপাকিভাবে ঠাঁই পেয়ে যায় এ অঞ্চলের ইতিহাসেই।
এরপর? বর্গীদের কি হল?

আর মাত্র ৬ বছর পর ইংরেজদের করতলগত হয়ে যায় বাংলা । ওদিকে মারাঠা-বর্গীরা মুগলদের পরির্বতে নতুন এই শক্তির মুখোমুখি হতে হয়- যে শক্তিটি মুগলদের চেয়ে সহস্রগুণ চতুর খল ও শক্তিশালী।

বাংলা বরাবরই তার গান, ধান ও মান নিয়ে তার নিভৃত শ্যামল কোনায় দুই -বেলা দুই -মুঠো শাক-ভাত খেয়ে সুখেশান্তিতে এই কুহকী জীবন কাটিয়ে দিতে চেয়েছে। পশ্চিমা লুঠেরারা বারংবার নির্জনতা প্রিয় বাঙালির শান্তি কেড়ে নিয়েছে, যুদ্ধের আগুনে পুড়ে গেছে তার সোনার শষ্যক্ষেত্রটি । আমরা দেখেছি অস্টাদশ শতকের বর্গীরাই বাংলার ইতিহাসে নির্মমতম শেষ অধ্যায় নয়পশ্চিম থেকে আগত ব্রিটিশ ও পশ্চিম পাকিস্তানি শোষন ও গনহত্যা, রাজনীতির ষড়যন্ত্র তখনও বাকি । ইতিহাসের এই অমোঘ ধারা এই ইঙ্গিতই দেয় যে বাঙালির নিজস্ব একটি রাষ্ট্রের বড়ই প্রয়োজন ছিল ...



Saturday, 9 June 2018

হিমালয়ের ইয়েতি রহস্য

অদ্ভুত সুন্দর পৃথিবী কতই না বিচিত্র রহস্যের সমাহার। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন রহস্যের পিছনে ছুটে বেড়িয়েছে। আজও অনেক রহস্যের মীমাংসা হয়নি। প্রাণীজগতের হাজারো সমাহারের ভিড়ে অনেক কিছুই হয়তো মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। কেউবা হয়তো ক্ষণিকের জন্য উঁকি দিয়ে আড়ালে চলে গেছে ।
হিমালয় রেঞ্জ আকারে যেমন বড়, তেমনি বিশাল এর সাথে মিশে থাকা রহস্যের সীমা-পরিসীমা। ভূত থেকে শুরু করে লোহিত তুষার,যোগী, অমর মানব আরও কত গল্পই না প্রচলিত আছে হিমালয়কে ঘিরে। তবে সেসব গল্পের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে ইয়েতিরা।

‘ইয়েতি’ নামটা পরিচিত লাগছে? ‘তিব্বতে টিনটিন’ পরেছিলেন ছোটবেলা? এখন মনে পড়ছে ? হিমালয় পর্বতমালায় বসবাস করা মানুষের মতো দু’পেয়ে কিন্তু বিসালাকারক অদ্ভুত প্রাণীর নামই হচ্ছে, 'ইয়েতি'।
প্রথমে আসা যাক ওদের নামে।

এলাকা ভেদে তাদের নাম Michê, Dzu-teh, Migoi, Mi-go, Mirka , Kang Admi , JoBran ( তিব্বতে টিনটিনে ইয়েতিকে মিগু বলা হত) , এবং প্রায় সবগুলো নামই ভাল্লুকের সাথে জড়িত, এমনকি ইয়েতি শব্দটিও মেতি-র অপ্রভংশ, যার অর্থ ভাল্লুক।
‘ইয়েতি’ নামটা এসেছে তিব্বতি ভাষা থেকে; বাংলা করলে অনেকটা হয় ‘পাথুরে ভল্লুক’! হিমালয়ের মানুষরা আগে বলতো, ইয়েতিরা সারাক্ষণ বিশাল একটা পাথর নিয়ে ঘুরে বেড়াতো, আত্মরক্ষা নয়তো শিকার করার জন্য। আর শিস দেয়ার মতো এক রকম শব্দ করতো। ওই পাথর নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর জন্যই হয়তো ওদের নাম দিয়ে ছিলো পাথুরে ভল্লুক বা ইয়েতি। এই ‘ইয়েতি’ নামটা জনপ্রিয় হয়ে গেলেও ওদের কিন্তু আরো অনেকগুলো নাম আছে। এই যেমনঃ ‘মেহ-তেহ’ মানে মানুষরূপী ভাল্লুক, ‘মি-গো’, মানে বন্যমানুষ, ‘ক্যাং আদমি’ বা 'তুষারমানব', ‘জোব্রান’ বা 'মানুষখেকো'।

উত্তর আমেরিকার বড় পা ওয়ালা জীব অর্থাৎ বিগ ফুটের কিংবদন্তির সাথে ইয়েতির তুলনা করা যায়।

নেপাল, চীন, ভারত, বাংলাদেশও পাকিস্তানের মানুষ ইয়েতির অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন। মনে করা হয়, এই জীব চমরী গাইকেও তুলে নিতে পারে।

‘বড় পা’ বা বিগ ফুট হলো ইয়েতির মার্কিন মুলুকের আত্মীয়। এগুলোকে দেখা যায় দক্ষিন আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে।
স্থানীয়দের মতে এদের উচ্চতা হলো ৭ থেকে ১০ ফুট ও ওজন ৫০০ পাউন্ড। লোমশ শরীর, লম্বা হাত ও মানুষের মতো দুপায়ে হাঁটে। ১৬ ইঞ্চি চওড়া এদের পায়ের ছাপ! বিগফুটের সপক্ষে এ পর্যন্ত যে সব প্রমাণ উত্থাপিত হয়েছে সেগুলোর সব কটি জাল হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
বিগফুটের যে বংশধর কানাডায় থাকে, সেগুলোকে বলা হয় সাসকোয়াচ। একই রকম দেখতে, যদিও সবসময় দেখা যায় না।
ইয়েতির কাহিনী সবচেয়ে বেশী নেপালে শোনা গেলেও এটি আসলে নেপালের স্থানীয় কিংবদন্তী নয়! এটি তিব্বতের বিস্তৃত মালভূমি আর বন্ধুর পর্বতে বসবাসকারী কিছু গোত্রের লোককথার চরিত্র, তারা যখন নানা গিরিখাদ পার হয়ে অনেক আগে হিমালয় ডিঙ্গিয়ে নেপালে এসে বসতি স্থাপন করে, তাদের সাথে সাথে আসে সেই লোকগাঁথা, সংস্কৃতি, ইয়েতির গা ছমছমে গল্প।

শোনা যায়, মহামতি আলেক্সজান্দার ৩২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিন্ধু উপত্যকা জয়ের সাথে ইয়েতি অভিযানের জন্য খুব ইচ্ছুক ছিলেন। তবে স্থানীয়রা তাকে বলেছিল, এই প্রাণী নিম্নচাপ ও বেশি তাপমাত্রায় বেঁচে থাকতে পারবে না।

সমতলের মানুষের কাছে ইয়েতির বিশ্বাসযোগ্য খবর প্রথম পৌছায় ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে। নেপালের প্রথম ব্রিটিশ রেসিডেন্ট বি.এইচ. হাডসনের বর্ণনার পর ইয়েতির ব্যাপারে সারা বিশ্ব আগ্রহী হয়ে ওঠে, তিনি হিমালয় অঞ্চলের অজ্ঞাত এক প্রাণীর বর্ণনা দিলেন যে এটি নাকি মানুষের মতো সোজা হয়ে হাঁটে, সারা শরীর লম্বা চুলে ঢাকা এবং কোন লেজ নেই। মি. হডসনের বিবরণ তখন খুব একটা সারা ফেলতে পারেনি। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দির গোড়ার দিকে ইয়েতি সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে।

১৮৯৯ সালে লরেন্স ওয়েডেল নামের এক অভিযাত্রী দাবি করেন তিনি ইয়েতির পায়ের ছাপ দেখতে পেয়েছেন। অভিযানের সময় তার সাথে থাকা গাইডের কাছেও তিনি ইয়েতির পায়ের ছাপের কথা শোনেন। কিন্তু সেটি তুষারমানবের কিনা সে ব্যাপারে তিনি সন্দিহান ছিলেন।

এর পরে ১৯১৩ সালে একদল চৈনিক শিকারি হিমালয়ের তুষার ঢাকা অঞ্চলে শিকারে বের হয় এবং পরে দাবি করে তারা হিমালয়ের তুষারাচ্ছাদিত অঞ্চলে বানরের কদাকার থ্যাবড়া মুখাকৃতি, সারা শরীরে কয়েক ইঞ্চি লম্বা রূপালী হলদে চুল, মানুষের মতো হাঁটাচলা করে এবং অসাধারণ শক্তিশালী প্রাণীকে প্রত্যক্ষ করেছে। বানরের সাথে এর মিল থাকলেও আকৃতিতে এরা বানরের চেয়ে অনেক বিশাল। দু’পেয়ে প্রাণীটি অনেকটা মানুষের মতোই চলাফেরা করে এবং দেখে সহজেই ধারণা করা যায় প্রাণীটি অসাধারণ শক্তিশালী।

১৯২১ সালে কর্নেল সি.কে হাওয়ার্ড বেরির নেতৃত্বে একদল অভিযাত্রী তিব্বতের মধ্য দিয়ে এভারেস্ট অভিযানে যান এবং সে উদ্দেশে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২০ হাজার ফুট ওপরে পৌঁছান। সেখানে তারা হিমবাহের নিকটে কয়েকটি বিশাল আকৃতির মানুষের পায়ের ছাপের মতো পদচিহ্ন লক্ষ্য করেন। তুষারশৃঙ্গ এভারেস্ট থেকে মাত্র ৭৮৬ ফুট নিচে অবস্থিত জায়গাটির নাম রংবুক যেটি অশান্ত ও রহস্যময় স্থান নামে পরিচিত। জায়গাটির আয়তন ২৬৫ বর্গকিলোমিটার এবং সব সময় সেখানে প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়া বয়।

১৯২২ সালের দিকে বেশ ক’জন পর্বতারোহী ঠিক একই জায়গায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন। সেই অভিযাত্রী দলটিতে আলেকজান্ডার কিউলাস্ক নামক একজন চিকিৎসক ছিলেন। সেখানে আকস্মিক কিউলাস্ক অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি মারা গেলেন। মারা যাওয়ার সময় তিনি বার বার প্রলাপ বকছিলেন। প্রলাপের সময় এক লোমশ দানবের কথা বলছিলেন।

১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে এভারেষ্ট অভিযাত্রী ব্রিটিশ মেজর অ্যালেন ক্যামেরন জানিয়েছিলেন অভিযান চলাকালে হিমালয়ের হিমরেখার উর্ধ্বে খাড়াই শৈল প্রাচীরের গা ঘেসে সঙ্কীর্ণ পথে সারিবদ্ধ মানবাকৃতি প্রাণীর একটা দলকে মন্থর গতিতে চলতে দেখেছিলেন।

১৯২৫ সালে আলোকচিত্রী ও রয়্যাল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটির সদস্য এন. তোশবাজি একটি ছবি প্রকাশ করেন। ওই ছবিতে স্পষ্টভাবে দেখা যায়, মানুষের আকৃতির একজন কুঁজো হয়ে হাঁটছে।
তিনি বলেন, “তুষারের বিপরীতে তাকে কালো দেখাচ্ছিল এবং যতোটা আমি দেখতে পেয়েছি, তার শরীরে কোনো কাপড় ছিল না।”

১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ অভিযাত্রী ফ্রাঙ্ক স্মিদি তিব্বত গিয়ে ১৪ হাজার ফুট উঁচুতে এই প্রাণীর অতিকায় পদচিহ্ন দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি পদচিহ্নগুলোর মাপ নিয়ে দেখেছিলেন সেগুলো লম্বায় ছিল প্রায় ১৩ ইঞ্চি এবং চওড়ায় ছিল প্রায় ৫ ইঞ্চি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোলিশ সৈন্য সোয়ামির রেউচ সাইবেরিয়ার একটি বন্দীশিবির থেকে পালিয়ে হিমালয় পেরিয়ে ভারতে এসেছিলেন। আসার পথে একবার তাকে পথে বাধা দিয়েছিল দুই ইয়েতি।
১৯৫০ খ্রিঃ নেপালের প্যাঙবোচি অঞ্চলে একটা মমীকৃত হাতের তর্জনী, বৃদ্ধাঙ্গুলের অস্থিসন্ধি আর খানিকটা চামড়া পাওযা গেলেও বিজ্ঞানীরা তা পরীক্ষা করে ইয়েতি জাতীয় প্রাণীর সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেন।

১৯৫১ সাল, হিমালয় অভিযাত্রী এরিক শিপটন প্রায় ৫,৫০০ মিটার উচ্চতায় গৌরীশঙ্কর শৃঙ্গের নিকটবর্তী অঞ্চলে একই ধরণের পদচিহ্ন দেখতে পেয়ে তার ছবি তুলে নিয়ে আসেন এবং সংবাদপত্রে সেই ছবি ছাপা হলে পৃথিবীতে আরো একবার আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এই ছবি দেখে বিজ্ঞানীরা নানা যুক্তি দেখালেও তখন তেমন কোনো সিদ্ধান্তে তারা আসেননি এরপর ইয়েতি সম্পর্কে জানার আগ্রহ বেড়ে যায় বিশ্ববাসীর। তিনি যে পায়ের ছাপটি আবিষ্কার করেন, তা প্রস্থে প্রায় ১৩ ইঞ্চি ছিল।

১৯৫৩ সাল, স্যার এডমন্ড হিলারি ও শেরপা তেনজিং নোরগে জয় করলেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ ‘মাউন্ট এভারেস্ট’। আর তারপর অকপটে স্বীকার করে নিলেন, পথে তারা  বড়ো বড়ো অনেকগুলো পায়ের ছাপ দেখেছেন।এই পায়ের ছাপগুলো কিন্তু প্রমাণ হিসেবে নিতান্ত ফেলনা নয়। এই পায়ের ছাপগুলো নিয়ে ভালো রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করেছিলেন। আর তা করে দেখে গেছে, এগুলো কোনো বানানো পায়ের ছাপও নয়, কিংবা অন্য কোনো প্রাণীর পায়ের ছাপও নয়। অন্য কোনো প্রাণীরই পায়ের ছাপ এতো বড়ো হতে পারে না। ওরাংওটাং দু’পায়ে দাঁড়াতে পারলেও দু’পায়ে হাঁটতেই পারে না। আর এই পায়ের ছাপ যেই প্রাণীর, ও চলেই দু’ পা দিয়ে! এরপর হিলারি ওই প্রাণীর সন্ধানে এভারেস্ট চূড়াও আরেকবার অভিযান চালান। তার দাবি, তার বাবা ওই প্রাণীকে দেখেছিলেন।

১৯৫৮ সালে পাওয়া গেল ইয়েতিদের সম্পর্কে আরো কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। আমেরিকান তথ্যানুসন্ধানী ডক্টর নরম্যান ডাইরেনফার্ম এবং অভিযাত্রী মি. ম্যাকলিনের কাছ থেকে জানা গেল ইয়েতি নামের তুষার বানর আসলে নিম্নস্তরের এক ধরনের মানুষ বা মানব সদৃশ্য প্রাণী। এরা হিমালয়ের নির্জন গুহায় বাস করে এবং বাইরে খুব একটা চলাফেরা করে না। প্রচন্ড শীত ও বৈরী পরিবেশেও এরা সহজে টিকে থাকতে পারে। তাদের আনা বিভিন্ন প্রমাণ থেকে জানা যায় ইয়েতিদের মধ্যে দুটো প্রজাতি রয়েছে, এদের মধ্যে একটি প্রজাতি লম্বায় ৮ ফুট এবং অন্যটির উচ্চতা ৪ ফুটের কাছাকাছি।

১৯৭০ সাল, বৃটিশ পর্বতারোহী ডন উইলিয়ামস হিমালয়ের অন্নপূর্ণা শৃঙ্গে উঠছিলেন। হঠাৎ তিনি শোনেন কি, কে যেন কাঁদছে! তার গাইড শেরপাকে ঘটনাটি কি জিজ্ঞেস করায় শেরপা বলেছিল, ওটা নাকি ইয়েতির ডাক। পরে ওই রাতেই নাকি তিনি এক বিশাল দু’পেয়ে জন্তুকে তাদের ক্যাম্পের আশেপাশেই ঘুরঘুর করতে দেখেন। সকালে উঠে তিনি ওই জন্তুটির বিশাল পায়ের ছাপও দেখেন। ঠিক আগের পায়ের ছাপগুলোর মতোই। আর পরের দিন সন্ধ্যাবেলা তিনি বাইনোকুলার দিয়ে প্রায় ২০ মিনিট ধরে দেখেন ইয়েতিটাকে, দু’পেয়ে বনমানুষের মতো একটা প্রাণী তাদের ক্যাম্পের আশেপাশেই খাবারের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এমনি করে দিন দিন ইয়েতি রহস্য আরো ঘনীভূত হচ্ছিলো। আর যেখানেই রহস্য, সেখানেই রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য চলে আসেন বিজ্ঞানীরা। এখানেও তাই হলো। বিজ্ঞানীরা ইয়েতি রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য আরো বেশি ক্ষেপে উঠলেন। সেই সঙ্গে ক্ষেপে উঠলেন সত্যসন্ধানী দুঃসাহসী সব অভিযাত্রীরাও।
২০০৭ সালে আমেরিকান টিভি উপস্থাপক জশুয়া গেটস তাঁর এক বিশাল দল নিয়ে নেপালে চলে আসলেন; উদ্দেশ্য ছিল ইয়েতি রহস্য উদ্ঘাটন। অনেক ঘুরে ঘুরে তারা শুধু ইয়েতিদের পায়ের ছাপই পেলেন। একেকটা পায়ের ছাপ লম্বায় ৩৩ সেমি, পাশে ২৫ সেমি! এরপর তাদের দল হিমালয়েরই আরেক জায়গায় গেল ইয়েতি খুঁজতে। এবারও তারা পেল শুধুই পায়ের ছাপ। আর দুটো পায়ের ছাপ মিলিয়ে তারা বেশ মিলও পেলো। এমনকি, পায়ের ছাপগুলো এতোই নিখুঁত ছিলো, তারা বলেই দিলো, এই পায়ের ছাপ কোনো দুষ্টু মানুষ বানাতেই পারে না। এটা অবশ্যই সত্যিকারের কোনো প্রাণীরই পায়ের ছাপ।
এরপর ২০০৮ সালে কয়েক জন জাপানি অভিযাত্রী তো ইয়েতিদের পায়ের ছাপের ছবি-ই তুলে নিয়ে আসলো। তাদের যে দলনেতা, ইয়োশিতেরো তাকাহাসি, তিনি নাকি ২০০৩ সালে হিমালয়ে গিয়ে একটা ইয়েতিকে দেখেও ছিলেন! তার ইচ্ছা, ইয়েতির ছবি বা ভিডিও করে নিয়ে আসা।

কিংবদন্তি পর্বতারোহী রেইনহোল্ড মেসনারসহ কয়েকজন বিশ্ববিখ্যাত পর্বতারোহীও বড় বড় চুলের বানর জাতীয় এ প্রাণীর মুখোমুখি হয়েছিলেন বলে দাবি করেছিলেন।
তাদের দাবি, ভাগ্যের জোরে ইয়েতির মুখ থেকে বেঁচেছেন তারা। রেইনহোল্ড মেসনার প্রথম ব্যক্তি হিসেবে অক্সিজেন ছাড়াই এভারেস্ট জয় করেন।
শুরু হয়েছিল গুঞ্জন, তর্ক, যুক্তি- পাল্টা যুক্তির মেসনার মুখে কুলুপ এঁটে একজন যথার্থ গবেষকের মত কাজে লেগে পড়লেন, এবং দীর্ঘ দুই দশকের নিবিড় অনুসন্ধান চালানোর পরে সমস্ত ফলাফল MY QUEST FOR YETI বইতে লিপিবদ্ধ করেন।
ইয়েতি কিংবদন্তীর উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হবার পর তিব্বতে অসংখ্য জনপদেব্যপক অনুসন্ধান চালান মেসনার বছরের পর বছর ধরে, গোপন সন্ধানে পৌঁছে যান দুর্গম মনেস্ট্রিতে যেখানে তিনটি তুষার মানবের মৃতদেহ সংরক্ষণ করে রেখেছে লামারা, কিন্তু তাদের কাছে তা অতি পবিত্র বস্তু বিধায় বিদেশীদের সেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ। মেসনারের এই অনুসন্ধানের মূলপ্রেরণা ছিল যে এই কিংবদন্তীর মূলে কোন না কোন বাস্তব ভিত্তি অবশ্যই আছে, এটি স্বর্গীয় দেবদূত বা কল্পকথার শয়তান না, নিশ্চয়ই কোন প্রাণীর আদল থেকে, মানুষের সাথে তার সংঘর্ষময় ইতিহাস থেকে হাজার হাজার বছর ধরে ডাল-পালা গজিয়ে বিশাল মহীরুহতে পরিণত হয়েছে ইয়েতির গল্প।
বিজ্ঞানীরা দাবি করেছিলেন, তারা এই রহস্যঘেরা তুষারমানবের অস্তিত্ব উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন।জেনেটিক পরীক্ষার মাধ্যমে ‘ইয়েতি’ র অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন বিজ্ঞানীদের একটি দল। তারা পরীক্ষার মাধ্যমে বের করেছেন, প্রাচীন মেরু ভালুক বা পোলার বিয়ার (আকর্টিক সাগরে ঘেরা আকর্টিক সার্কেলে বাসকরা মাংসাশী ভালুক) ও বাদামি ভালুকের যৌথ মিলবন্ধন রয়েছে এ প্রাণীর মধ্যে। ইয়েতির সংগৃহীত চুলের নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, বংশগতভাবে (জেনেটিক্যালি) ১ লাখ ২০ বছর আগের প্রাচীন পোলার ভালুকের সঙ্গে সাদৃশ্য পাওয়া গেছে।
বছরের পর বছর গবেষণা চালিয়ে ও ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে এই তথ্য প্রমাণ করেছেন বিজ্ঞানীরা। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান জেনেটিক্সের অধ্যাপক ব্রিয়ান সিকেস এ গবেষণা চালিয়েছেন।
অধ্যাপক ব্রিয়ান সিকেসের মতানুসারে ফলাফলটি একেবারেই অপ্রত্যাশিত। তিনি বলেন,প্রাচীন পোলার ভালুকের উপস্থিতির বিষয়টি জানা গেলেও তারা এখনও হিমালয়ে ঘুরছে কিনা তা বোঝা যায় না। অধ্যাপক সিকেস জানান, উপ-প্রজাতির বাদামি ভালুক হিমালয়ের ওপরে থাকতে পারে। পূর্বপুরুষ মেরু ভালুক থেকে বাদামি ভালুকের উৎপত্তি হতে পারে। এমনকি বাদামি ভালুক ও প্রাচীন মেরু ভালুকের বংশধরদের মেলামেশায় সংকরজাতের হতে পারে এ উপ-প্রজাতির ভালুক। অধ্যাপক সিকেস হিমালয়ের উচু অঞ্চলের গ্রামের স্থানীয়দের কাছে ইয়েতি নামে পরিচিত দুটি প্রাচীন প্রাণীর চুলের নমুনা পরীক্ষা করেছেন। এদের একটি ভারতের লাদাখ ও অন্যটি ভুটানে পাওয়া গেছে। প্রাণী দু’টির নমুনা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল জেনব্যাংক ডাটাবেজে সংরক্ষিত অন্যান্য প্রাণীর জেনোমের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি দেখতে পেয়েছেন, তার সংগৃহীত নমুনা নরওয়ের সালবার্ডে প্রাপ্ত প্রাচীন মেরু ভালুকের চোয়ালের হাড় থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান জেনেটিক্সের অধ্যাপক ব্রিয়ান সিকেস এ গবেষণা চালিয়েছেন। বছরের পর বছর ধরে পর্যাপ্ত পরিমাণে ইয়েতির শারীরিক প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন। হিমালয়ের গায়ে রহস্যময় ‘বিগফুটের’ বৈজ্ঞানিক ব্যাখা দেয়ার জন্য এগুলোর অত্যাধুনিক ডিএনএ টেস্টেও করা হয়েছে।

এদের একটি ভারতের লাদাখ ও অন্যটি ভুটানে পাওয়া গেছে। এ দুই প্রাণীর নমুনা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল জেনব্যাংক ডাটাবেজে সংরক্ষিত অন্যান্য প্রাণীর জেনোমের (বংশগতি সম্পর্কিত তথ্য) সঙ্গে তুলনা করেছে। অধ্যাপক সিকেস দেখতে পেয়েছেন, তার সংগৃহীত নমুনা নরওয়ের সালবার্ডে প্রাপ্ত প্রাচীন মেরু ভালুকের চোয়ালের হাড় থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে।
এছাড়া ইয়েতি বলে দাবি কর হয়েছে এমন ৯টি নমুনার জেনেটিক সিকোয়েন্স বা বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষন করে দেখা গেছে তাদের বেশীর ভাগই হচ্ছে হিমালয়ে বাস করা বিভিন্ন ভাল্লুকের প্রজাতি। ৯টি নমুনার মধ্যে ৫টি তিব্বতি বাদামি ভাল্লুক, ২টি হিমালয়ের বাদামি ভাল্লুক এবং ১টি নমুনাকে এশিয়ার কালো ভাল্লুক হিসেবে সনাক্ত করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, রেইনহোল্ড মেসনার মাউন্টেইন মিউজিয়ামের সংগ্রহে থাকা একটি স্টাফ করা ইয়েতির দাঁতের অংশ পরীক্ষা করে জানা গেছে সেটি আসলে একটি কুকুরের দাঁত।
২০১৪ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেসিস্টদের চালানো গবেষণায় দাবী করা হয়েছিল ইয়েতির নমুনা গুলোর সাথে প্রাগৌতিহাসিক মেরু ভাল্লুকের জিনের মিল আছে।
৩ বছর পর নিউ ইয়র্ক স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাল্লুকের জিনত্বত্ত নিয়ে অধ্যায়নরত শার্লট লিন্ডভিস্ট আবার পূর্বের গবেষণাটির উপর নতুনভাবে আলোকপাত করে মেরু ভাল্লুকের সাথে হিমালয়ের এই অঞ্চলে বাস করা ভাল্লুকদের সম্পর্ককে নাকচ করে দেন।
শার্লট লিন্ডভিস্ট ও রবার্ট সাইক্স দুজনই ‘আইকন ফিল্মস’ নামক এক ব্রিটিশ টেলিভিশন প্রোডকশন কোম্পানির আহ্বানে এই দুটি গবেষণা পরিচালনা করেন। দুটি গবেষণার কার্যক্রম নিয়ে টিভি সিরিজ তৈরী করা হয়। ২০১৬ সালে লিন্ডভিস্টের গবেষণা কর্মের উপর নির্মিত তথ্যচিত্র অ্যানিমেল প্লানেটে “Yeti or Not” নামে প্রচারিত হয়।
পূর্বের গবেষণাটির ব্যাপারে লিন্ডসিস্ট বলেন, ‘আগের গবেষণায় খুবই ক্ষুদ্র মাইটোকন্ড্রিয়াল জেনোম ব্যবহার করা হয়েছিল। তাই যথাযথ ফলাফল পাওয়া যাইনি। কিন্তু এই গবেষণা থেকেই বোঝা গিয়েছিল তথাকথিত ইয়েতির সাথে ভাল্লুকের অবশ্যই একটা সম্পর্ক আছে’।
নতুন এই গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, প্রায় সাড়ে ৬ লক্ষ বছর আগে উত্তর আমেরিকা ও ইউরেশিয়া থেকে নেমে আসা একদল বাদামি ভাল্লুক থেকে হিমালয়ের বাদামি ভাল্লুক প্রজাতি আলাদা হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে তিব্বতের বাদামি ভাল্লুক প্রজাতির উদ্ভব ঘটেছে প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ বছর আগে।

প্রায় দেড় বছর ধরে চলা এই গবেষণা থেকে আরো জানা যায়, তিব্বতে বাস করা বাদামী ভাল্লুক ও হিমালয়ে বাস করা বাদামি ভাল্লুকের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। হিমালয়ের দূর্গমতাই এই দুই প্রজাতির মধ্যে কোন রকম সম্পর্ক স্থাপন করতে দেয়নি।
গবেষকরা আশা প্রকাশ করেন তাদের এই গবেষণার ফলে তিব্বত ও হিমালয়ের দূর্গম অংশে বসবাস করা বিলুপ্তপ্রায় এই প্রানী গুলোকে রক্ষায় সকলের দৃষ্টি আকর্ষনে সক্ষম হবে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনতাত্ত্বিকরা বলছেন, ইয়েতি বা এ ধরনের প্রাণীর দাবি নিয়ে এর আগেও ডিএনএ পরীক্ষা হয়েছে। কিন্তু এখন কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব প্রমাণের কৌশল আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। বিশেষ করে, চুল পরীক্ষার ক্ষেত্রে আধুনিক ফরেনসিক সায়েন্সের কল্যাণে পরীক্ষা কৌশলের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। আধুনিক পরীক্ষা পদ্ধতি চুলের একটি অংশ থেকে ইয়েতি বা এমন প্রাণীর অস্তিত্বের ব্যাপারে যথাসম্ভব সঠিক ফলাফল উপহার দিয়ে এই বহু প্রাচীন রহস্যের কূলকিনারা করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।


হিমালয়ের এই কিংবদন্তীর প্রাণীটাকে নিয়ে যে কতো গবেষণা আর জল্পনা-কল্পনা করা হয়েছে! কিন্তু, মজা কি জানেন? এই ইয়েতিরা আসলেই আছে কি নেই এ ব্যাপারে কিন্তু কখনোই নিশ্চিত হওয়া যায়নি। হবেটাই বা কী ভাবে? ওদেরকে যে এখনো সেভাবে দেখা-ই যায়নি! আর বিজ্ঞানীরাও ওদের ব্যাপারে একমত হতে পারেননি। কোনো বিজ্ঞানী বলেন, ইয়েতিরা অবশ্যই আছে। নইলে অমন বড়ো বড়ো পায়ের ছাপ এলো-ই বা কোত্থেকে? আবার অন্য বিজ্ঞানীরা বলেন, েসব গাঁজাখুরি গল্প। তবে, ইয়েতি যে আছে, এটা যেমন এখনো প্রমাণ করা যায়নি, তেমনি যারা বলে ইয়েতি নেই, ওসব ফালতু গল্প, তারাও কিন্তু খুব একটা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারেন না যে ইয়েতিরা আসলেই নেই। ইয়েতি যদি সত্যি সত্যিই না থাকে, তাহলে এত দিন হয়ে গেলো, তবু ওদের গল্প শেষ হচ্ছে না কেন বলো তো? সেটাইতো কথা! ইয়েতিরা আসলেই আছে, নাকি মৎসকন্যাদের মতো ইয়েতিও প্রাচীন মানুষের এক অমর কল্পনা তার সমাধানের আশায় রইলাম।


Saturday, 2 June 2018

এরিয়া ৫১: বিশ্বের সবচেয়ে গোপন ও রহস্যময় স্থান



মানুষ চিরকালই রহস্য প্রিয়। কখনো নিজেই রহস্য উদঘাটনে ব্যতিব্যাস্ত থাকে কখনও রহস্যের অন্তরালে নিজেকে লুকিয়ে রাখার মানুষের প্রবণতা খুব সম্ভবত তাকে কালজয়ী করে তোলে।


খেয়াল করে দেখুন কয়েকটা নাম কোনোদিন শুনেছেন কিংবা পড়েছেন কিনা- ড্রিমল্যান্ড, প্যারাডাইস র‍্যাঞ্চ, হোম বেজ এবং ওয়াটারটাউন। কী? শুনেছেন কখনো এ নামগুলো? বুম গেইট” বা চেইন লিংকের বেড়ার মতো দুর্ভেদ্য বেষ্টনী দ্বারা সংরক্ষিত ক্ষেত্রটির সম্মুখে ‘প্রবেশ এবং ছবি তোলা নিষেধ, প্রবেশ করলে প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগ করা হবে’ নির্দেশনামা সম্বলিত নোটিশগুলো সাধারণের নজর কাড়ে যা দেখে যে কেউ বলতে পারবে আমেরিকার সবচেয়ে রহস্যময় অঞ্চলটি গোপন মিলিটারি বহর দ্বারা সংরক্ষিত যারা তদারকিতে কোন ভুল করে না।
এ এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থার এতটাই কঠোর যে, এর সীমানায় প্রবেশকারী বহিরাগত যে কাউকে সরাসরি গুলি করার নির্দেশ রয়েছে। যদিও এখন তা কিঞ্চিত শিথিল হয়েছে। সুরক্ষিত এই এলাকা দেয়াল ঘেরা না হলেও প্রবেশ পথে সাইনবোর্ডে কঠোরভাবে অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি লেখা রয়েছে। এরিয়া ৫১ এ ঢোকার জন্য কোনো পিচের রাস্তা নেই। মূল গেট ঘাঁটি থেকে প্রায় ২৫ মাইল দূরে অবস্থিত। এখানে কর্মরতদের পরিচয় সম্পর্কে বাইরে কেউ কিছু জানে না। এই এলাকার চতুর্দিকে সিসি ক্যামেরা, মোশন ডিটেক্টর, লেজার ডিটেক্টর, সাউন্ড ডিটেক্টর অত্যাধুনিক নানা প্রযুক্তির প্রয়োগ করা হয়েছে এলাকার নিরাপত্তায়। 

আকাশ পথ দেখার জন্য রয়েছে রাডার। ঘ্রাণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আশেপাশে থাকা যেকোনো মানুষ বা বন্য প্রাণীর অস্তিত্ব তারা পর্যবেক্ষণ করতে পারে। কেউ কোনো ভাবে এলাকায় ঢুকে পড়লে তার অস্তিত্ব ধরা পরবে সেন্সরে। মুহূর্তে চলে আসবে সুরক্ষায় নিয়োজিত বাহিনী। সুরক্ষায় যারা থাকে তারা শুধুমাত্র এরিয়া ৫১ এর সুরক্ষার জন্য নিয়োজিত। কেউ যদি সব সুরক্ষা ব্যবস্থাকে কাটিয়ে ভেতরে ঢুকলেও রয়েছে বড় সমস্যা। কেননা এই এলাকাটি মরুভূমির মধ্যে অবস্থিত। প্রকৃতির সঙ্গে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী লড়াই করে বেঁচে থাকা কষ্টসাধ্য। তাই প্রাকৃতিকভাবেও এরিয়া ৫১ অনেক সুরক্ষিত।

যুক্তরাষ্ট্রের এই অত্যন্ত গোপনীয় ঘাঁটি হচ্ছে এরিয়া ৫১ (Area 51)। এতটাই গোপনীয় যে যুক্তরাষ্ট্র সরকার দীর্ঘদিন এর অস্তিত্বই স্বীকার করেনি। মানচিত্র বা সড়ক নকশা কোন কিছুতেই এরিয়া ৫১ এর উল্লেখ করা হত না। এর আকাশাসীমায় সামরিক বা বেসামরিক কোন ধরনের বিমান প্রবেশ করতে পারে না (কেবল এরিয়া ৫১গামী বিশেষ বিমান ছাড়া)। ১৯৮৮ সালে সোভিয়েত রাশিয়া স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এরিয়া ৫১ এর ছবি প্রকাশ করলে প্রথমবারের মত যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ এলাকাটির ছবি দেখার সুযোগ পায়। এরিয়া ৫১ খুবই রহস্যময় একটি এলাকা এবং এটা নিয়ে গুজবেরও শেষ নেই। যেমন অনেকে এই এলাকার আশেপাশে ভিন গ্রহের প্রাণী বা ভিন গ্রহের যান দেখার দাবী করেছেন।এরিয়া ৫১ মূলত মার্কিন সামরিক বাহিনীর একটি সামরিক ঘাঁটি। যার আয়তন ২৬,০০০ বর্গকিলোমিটার। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডা অঙ্গরাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলে এবং লাস ভেগাস থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম রেকেল গ্রামের কাছে অবস্থিত। খুবই গোপনীয় এই সামরিক বিমান ঘাঁটি গ্রুম হ্রদের দক্ষিণ তীরে অবস্থিত।


যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, এখানে সামরিক বিমানের পরীক্ষা চালানো হয়।
কোল্ড ওয়ার বা স্নায়ু যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমেরিকা লোকচক্ষুর অন্তরালে উন্নত মানের যুদ্ধ বিমান এবং অত্যাধুনিক অস্ত্র তৈরির গবেষণা এবং পরীক্ষা চলতো এ অঞ্চলে।

সময় ২০০৫ সাল। জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি সর্বপ্রথম তথ্য প্রকাশ স্বাধীনতা আইনের অধীনে কিছু দলিল প্রকাশের আবেদন করলে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বেশকিছু তথ্য অবমুক্ত করে যা ২০১৩ সালে অবমুক্ত করা সিআইএ’র গোপন দলিলে অন্তর্ভুক্ত ছিলো যারমধ্যে উল্লেখ করা হয় এরিয়া ৫১ মূলত ইউ২ এর মতো গোপনীয়তা রক্ষা করে অন্তরালে চলা কিছু স্পাই প্লেন ও অন্যান্য গোপন মরণাস্ত্র পরীক্ষা করা হতো। পরে অবশ্য এফ-১১৭ স্টিলথ ফাইটার, ডি-২১ ট্যাগবোর্ড, -১২ অক্সকার্ট নামক বিমান ব্যবহৃত হয় ওই এলাকায় চালকদের প্রশিক্ষণের জন্য।

অন্যান্য সব তথ্যের সাথে এও জানা যায়, সেখানের নির্মিত দালানসমূহে কোন জানালা নেই যার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে জানা যায় যেনো এক গবেষক দল আরেক গবেষক দলের কাজ সম্পর্কে জানতে না পারে। আরেক সূত্রে জানা যায়, যখন কোন বিমান উক্ত ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলক চালানো হয় তখন কর্মীরা দালানের ভিতরেই অবস্থান করে যাতে উড্ডয়ন সম্পর্কিত কোন তথ্য কেউ জানতে না পারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ব্যতীত।
তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে আমেরিকা সরকার ছিলো একদম কৃপণ, বলতে গেলে এক প্রকার মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছিলো তারা। ১৯৯৫ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন একটি কার্যনির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন যেখানে দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে‘ এরিয়া-৫১’কে সংরক্ষণের নিমিত্তে কোন ধরণের আইনী অথবা গবেষণা করা হতে বাঁচাতে।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কঠোর গোপনীয়তার কারণে জল্পনা-কল্পনার বিস্তৃতিটাও অনেক বেশি। কেউ কেউ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকার চাঁদে মানুষ না পাঠিয়ে এ স্থানেই ‘চাঁদে মানুষ পাঠানোর শ্যুটিং’ করেছিল, এ এলাকাতেই সবচেয়ে বেশি ইউএফও (Unidentified Flying Object) দেখা গেছে, অনেকে বলেন এখান থেকেই এলিয়েনদের সাথে যৌথ গবেষণা কার্যক্রম চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, এলিয়েনরা প্রজনন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলায় মানুষের সাথে হাইব্রিডাইজ বা সংকরায়ন করার চেষ্টা হচ্ছে, এখানে এলিয়েনদের দেহ সংরক্ষিত আছে গবেষণার জন্য।

প্রচলিত কথার মধ্যে আরও রয়েছে, এখানে মাটির অনেক নিচে গবেষণাগার আছে, অন্য গবেষণাগারের সাথে পাতালরেল যোগাযোগ আছে। এখানে যারা কাজ করে তাদের গোপনীয়তার শপথ নিতে হয়। সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তিসহ অনেক প্রযুক্তিই আসলে এলিয়েনদের প্রযুক্তি, নইলে এত দ্রুত প্রযুক্তির এত উন্নতি হওয়ার কথা নয়; এমন কথাও বলেন অনেকে।

এসব তথ্যকে আজগুবি তথ্য বলেই মনে করা হয়। কিন্তু গোপনীয়তা এসব তথ্যকে কিছুটা হলেও জনপ্রিয় করতে পেরেছে। U-2 গোয়েন্দা বিমান যখন উদ্ভাবিত হয় তখন সেটি ছিল সবচেয়ে বেশি উচ্চতায় উড্ডয়নকারী বিমান। এমন উচ্চতায় বিমান থাকতে পারে এটা কেউ তখন ভাবতো না। আর তাই সেটাকে ইউএফও ভেবে ভুল করেছে বলে ব্যাখ্যা দেয়া হয়।

এই এলাকা সর্ম্পকে মানুষ তেমন কোনো খবর জানে না। এছাড়াও এরিয়া ৫১ এর ভিতরে যে সব স্থাপনা আছে তারও তেমন ভালো কোনো ছবি পাওয়া যেত না, যে সব ছবি পাওয়া গেছে সেগুলো সব স্যাটেলাইট থেকে তোলা। মার্কিন সরকারের অবাধ তথ্য অধিকারের সুযোগ নিয়ে ১৯৬০ সালে মার্কিন গোয়েন্দা উপগ্রহ ‘করোনা’র সাহায্যে এরিয়া ৫১ এর ছবি তোলে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন সরকার সেই ছবি মুছে ফেলে। পরবর্তীতে নাসার ল্যান্ডস্যাট ৭ উপগ্রহের সাহায্যে ৫১ এর ছবি তোলা হয়, এই ছবিটিই সরকারিভাবে প্রকাশিত এরিয়া ৫১ এর ছবি। গোপন রাখার নানা চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হয়নি। রাশিয়ার গোয়েন্দা উপগ্রহ ইকনস ও রাশিয়ার বেসামরিক উপগ্রহ আমেরিকা রাশিয়ার ঠান্ডা যুদ্ধের সময় এই এরিয়া ৫১ এর ভেতরের উচ্চ রেজল্যুশনের ছবি তোলে। প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায় যে, এরিয়া ৫১ এর ভিতরে সাতটি রানওয়ে আছে। ছবিতে আরো দেখা যায় বড় বড় গুদাম ঘর, আবাসিক এলাকা, ফায়ার স্টেশন, বিশাল আকারের পানির ট্যাংকি, বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার, খেলাধুলা করার জন্য টেনিস এবং বেসবল কোর্ট। আরো আছে যোগাযোগের জন্য বেশ কয়েকটি স্যাটেলাইট ডিশ। ২০১৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) প্রকাশিত নথিতে জানানো হয়, বিমানের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ১৯৫৫ সালে নেভাদার জনশূন্য মরুভূমিতে ‘এরিয়া ৫১’ -এর বর্তমান জায়গাটি বেছে নেয়া হয়। সুতরাং মানুষজন এলাকাটিতে নানা সময়ে যে ভিন গ্রহের যান দেখার দাবী করে এসেছেন, তা আসলে হয়তো অত্যাধুনিক কোনো যুদ্ধ বিমান।
লোকমুখে শোনা যায় এক্স-১৫ এবং এ-১২ এর মতো হরেক প্রকার আধুনিক মার্কিন সামরিক বিমান এখানে নির্মিত হয় যারমধ্যে এ-১২ নামক বিমানটি তৈরী করা হয়েছিলো ১৯৫০ এবং ৬০ দশকের দিকে। এটি রাডারের আওতার বাহিরে থেকে ঘন্টায় প্রায় ২২ মাইল (৩৫৪০ কিঃমিঃ) বেগে উড়ার ক্ষমতা রাখতো। এই এ-১২ নামের বিমানটিকে আরো অত্যাধুনিক করতে তখনকার সময়ে আমেরিকা সরকার একটি ভুল করে ফেলেন যা এরিয়া-৫১ এর বিমানের পাইলট কেন কলিন্স (এরিয়া-৫১ এ যার ছদ্ম নাম ছিলো কেন কলমার) ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে তুলে ধরেন। তার দেয়া তথ্যমতে দুর্ঘটনার দিন বিমানটির পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন চলাকালীন ২৫০০০ ফিট উচ্চতায় আকস্মিকভাবে বিমানের সম্মুখভাগ উপরের দিকে প্রবলবেগে উঠতে থাকে এবং হঠাৎ উল্টে গিয়ে অনুভূমিক দিকে ধাবিত হয়। কেন কলিন্স বুঝে যায় এ যাত্রায় বিমানকে বাঁচানো অসম্ভব তাই নিজেকে বাঁচাতে বেরিয়ে পড়েন ককপিট হতে এবং প্যারাস্যুট দিয়ে সুস্থ ভাবে ল্যান্ড করার পর দেখেন তিনজন স্থানীয় ছদ্মবেশে লোক তারজন্য পিকআপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ধ্বংসাবশেষের দিকে যাওয়ার নির্দেশ দিলে তিনি উল্টোপথে হাটতে থাকেন তাদের নিয়ে এবং বলেন বিমানে পারমানবিক যুদ্ধসরঞ্জাম রয়েছে। এ কথাটি বলা হয়েছিলো কারণ এ ধরণের গল্প আগে হতেই পরিকল্পিত ছিলো। সরকারি কর্মকর্তারা একটু পর এসে ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করতঃ ধামাচাপা দেয়ার কাজ সেরে ফেলে। এর পরের দিন প্রত্যুষে সমস্ত ধ্বংসাবশেষ ট্রাকে করে এরিয়া-৫১ এর অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রায় অর্ধ শতাব্দী অবধি সেই স্থানে কেউই উক্ত জায়গায় পদচিহ্ন রাখেনি।
তবে অ্যারোস্পেস বিশেষজ্ঞ পিটার মারলিনের মতে ধ্বংসাবশেষের কিছু অংশ ডায়নামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেবার চিন্তা ভাবনা ছিল যাতে কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে তা চিহ্নিত করা সম্ভবনা হয়। আজ এ ঘটনাকে লুকিয়ে রেখে আর কোন সুবিধা পাওয়া যাবে না বিধায় সিআইএ এই ছবিগুলো প্রকাশ করেছে বলে মনে করেন ইতিহাসবিদ ডেভিড রবার্জ। ২০০৭ সালে অক্সকার্ট প্রকল্প সংক্রান্ত অনেক তথ্য প্রকাশ পায়। এর মধ্যে ছিলো এয়ার ফোর্সের কাছ থেকে নয়টার মধ্যে থেকে একটা এ-১২ বিমান তারা অধিগ্রহন করেছে যা এখন সিআইএ-র প্রধান কার্যালয়ে শোভা পাচ্ছে। যদিও সিআইএ ঘটনার কিছু ছবি প্রকাশ করেছে তথাপি এ ব্যাপারে কারা জড়িত ছিল বা কিভাবে এটি সম্পন্ন হলো সে ব্যাপারে বিস্তারিত জানা যায়নি। অ্যারোস্পেস ঐতিহাসিক পিটার মারলিন, দুর্ঘটনার জায়গাটি কয়েকবার প্রদর্শন করেছেন। তার মতে, -১২ এর ফিউজলাজ এবং পাখা ব্লো-টর্চ দিয়ে কেটে আলাদা করে ট্রাকে তোলা হয়, সাথে তোলা হয় লেজ এবং আর যে সকল বড় বড় যন্ত্রাংশ ছিল সেগুলোকে। পড়ে থাকা ছোট ছোট যন্ত্রাংশগুলোকে বাক্সে ভরা হয়েছিল। পরিস্কার করার আগে যাতে কোন বিমান থেকে কিছু দেখা না যায় তাই তারপুলিন দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। যখন দুর্ঘটনাটা ঘটে তখন অক্সকার্ট প্রকল্পটি খুব গোপনীয় প্রকল্প ছিলো, এটি প্রকাশ হলে আমেরিকার শত্রুরা বিকল্প বা প্রতিরোধের
ব্যবস্থা নিয়ে ফেলতো তাই সরকার এ ঘটনাটিকে ধামাচাপা দেয়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা টাইটানিয়ামের টুকরো আজও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারিদিকে। পিটার মারলিন জানান, এলাকা ঘুরে এ ধরনের
অনেক টুকরা তিনি দেখতে পেয়েছেন। তিনি এখানে বিমানের পাখা এবং ককপিটের কিছু অংশও পেয়েছেন যাতে এখনো 'স্কাঙ্ক অয়ার্ক্স' এর ছাপ দেয়া আছে। স্কাঙ্ক অয়ার্ক্স ছিল প্রতিরক্ষা বিভাগের একটা ভাগ।

১৯৮৯ সালের কথা সব থেকে বড় ও বিতর্কিত বিষয়টি উঠে আসে এরিয়া-৫১ এ কর্মরত পদার্থবিজ্ঞানী বব লেজারের এক বক্তব্যে। এক টিভি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ওখানে এমন কিছু মৌলিক পদার্থ নিয়ে গবেষনা করা হয় যা এখনও আবিষ্কারের ঘোষনা দেওয়া হয় নি। তিনি অবশ্য কিছু ধোয়াটে বক্তব্য দিয়েছেন একটি মৌলিক পদার্থ নিয়ে। তারমতে সুপারনোভা বা বাইনারি স্টার সিস্টেম থেকেই সম্ভবত একটি মৌল সংগ্রহ করা হয়েছে। যার মাত্র ২.২ পাউন্ড ৪৭টি ১০মেগাটন হাইড্রোজেন বোমা বানানোর জন্য যথেষ্ট। ওখানে নাকি এমন একটি সরল যন্ত্র আবিষ্কার করা হয়েছে যা চাকতি আর বল দিয়ে তৈরী। যন্ত্রের বলের চিপে ঐ মৌলটি রাখা হলে সময়কে স্থির করে রাখা যায়। এই বিষয়ে পরীক্ষা চালিয়ে সফলতাও এসেছে। তার মতে ঐ মৌল পদার্থটি বলের চিপে রাখামাত্র তা কোন এক প্রক্রিয়ায় অ্যান্টিম্যাটার তৈরী করে এবং তারফলে বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপাদিত হয়। অ্যার্টিম্যাটার রিয়েক্টরে শক্তি উৎপাদনের ফলে বস্তুর নিজস্ব মহাকর্ষ বলের সৃষ্টি হয় এবং নিজস্ব শক্তিতে তা বিদুৎবেগে ছুটতে পারে। এবং এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ওখানে ফ্লাইং সসার তৈরীর গবেষনা চলছে। তবে বব সবচেয়ে বড় ধাক্কা দেন এই বলে যে সেখানে নাকি ভীনগ্রহীবাসীদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি ফ্লাইং সসার আছে। আর ওই ধবংস হয়ে যাওয়া ফ্লাইং সসার থেকে প্রাপ্ত মৃত এলিয়েনটির ব্যবচ্ছেদ করা হয়। তারা জানতে পারে, ঐ প্রাণীটি এসেছে রেটিকুলাম-৪ নামক জ্যোতিষ্ক থেকে। প্রাণীটির উচ্চতা সাড়ে তিনফুট। লোমহীন শরীর কালো বড় বড় চোখ এবং শরীর কৃশকায়। দেহ ব্যবচ্ছেদ করে ফুসফুস ও হৃৎপিন্ডর বদলে বিশাল এক পতঙ্গ পাওয়া গেছে। এ বিতর্কের এখানেই শেষ নয়। এরিয়া৫১ নিয়ে চলমান বিতর্কের সবচেয়ে বড়টি হল মানুষের চাঁদে যাওয়া নিয়ে। অনেকের ধারনা মানুষ কখনও চাঁদে যায়নি। বরং পুরো নাটকটি সাজানো হয়েছে এই এরিয়া-৫১ এর ভিতর। মজার ব্যাপার হচ্ছে এত বিতর্ক চললেও আমেরিকান সরকার এসব কোনোকিছুই স্বীকার করেনি আজপর্যন্ত। তাতে সন্দেহ না কমে বরং আরো বেড়েছে।
বব লাজার নামের এক দাবী করে বসেন যে, তিনি কিছুদিনের জন্য এরিয়া ৫১ এরই একটি অংশে কাজ করেছিলেন, যার নাম এস-৪। সেই জায়গাটি এতটাই গোপনীয় যে, ঐ প্রজেক্টে তিনি এবং তার অন্যান্য সহকর্মীদের যে বাসে করে নেয়া হয়েছিলো, তার জানালাগুলো বন্ধ ছিলো যাতে করে তারা যাতায়াতের রাস্তা মনে রাখতে না পারেন।

এস-৪ এর বিমান ছাউনিতে লাজার এমন সব ফ্লাইং সসার দেখতে পেয়েছিলেন, যেগুলো কোনোভাবেই পৃথিবীতে তৈরি হতে পারে না বলে দাবী লাজারের। সেগুলোর শক্তি সরবরাহ করা হচ্ছিলো এন্টিম্যাটার রিঅ্যাক্টরের মাধ্যমে, জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিলো লালচে-কমলা বর্ণের একটি পদার্থ যার নাম ‘এলিমেন্ট-১১৫’। সসারটি এতটাই শক্তিশালী গ্র্যাভিটি ওয়েভ তৈরি করছিলো যে, সেটার উদ্দেশ্যে কোনো গলফ বল ছুঁড়ে মারলে সেটাও ফিরে আসছিলো!

একবার যখন তিনি এস-৪ এর একটি হলওয়ে ধরে যাচ্ছিলেন, তখন পাশের একটি ঘরের ছোট জানালা দিয়ে সামান্য সময়ের জন্য উঁকি দেন তিনি। তখন ঘরের ভেতরে ছোট, ধূসর বর্ণের একটি প্রাণীকে সাদা কোট পরিহিত দুজন মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন তিনি! পরে অবশ্য তার পেছনে আসা প্রহরীর ঝাড়ি খেয়ে বেচারা সেখান থেকে সরে যেতে বাধ্য হন।


লাজারের মতে, সামরিক খাতে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে তৈরি করছিলো ইউএফও (আনআইডেন্টিফাইড ফ্লায়িং অবজেক্ট)! দুর্ভাগ্য বলতে হবে লাজারের। একবার বন্ধুদের নিয়ে তিনি লুকিয়ে সেসব সসারের টেস্ট ফ্লাইট দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে যান। এরপরই তার চাকরি চলে যায়।
১৯৯৭ সালে এমন দাবি করেছিলেন ভিক্টর নামে আরেক ব্যক্তি। তিনি এরিয়া ৫১ এ চাকরি করেন বলে দাবি করেছিলেন। তিনিও এলিয়েনদের জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারটি দেখেছিলেন বলে জানান। এমনকি তিনি একটি ঝাপসা ভিডিও করেছিলেন যেখানে দেখা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর হাতে গুলি খাওয়া এক বহির্জাগতিক পাইলটের সাথে টেলিপ্যাথির মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা চালাচ্ছেন এরিয়া ৫১ এর একজন অফিসার।
মহাকাশচারী নীল আর্মস্ট্রংয়ের এই কথাটি স্থান করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। তবে এরিয়া ৫১ কনস্পিরেসি থিওরিস্টদের মতে, অ্যাপোলো-১১ দিয়ে চাঁদে অবতরণের ঘটনাটি স্রেফ ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই না!
এ ধারণাটির প্রবক্তা কনস্পিরেসি লেখক বিল কেসিং। তার মতে, ষাটের দশকের শেষের দিকে নাসার বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন যে, তীব্র তেজষ্ক্রিয়তার জন্য চাঁদের বুকে অবতরণ করা কোনো মানুষ আর বেঁচে ফিরতে পারবে না! কিন্তু এতদিন ধরে চালানো এই প্রোগ্রামও বাতিল করা সম্ভব ছিলো না। তাই তারা আশ্রয় নেয় ইতিহাসের অন্যতম সেরা জালিয়াতির!


এজন্য অ্যাপোলো-১১ জনগণের দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাওয়ার পরই গোপন একটি মিলিটারি এয়ারক্রাফটে করে ক্রুদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো পূর্বপ্রস্তুত একটি মুভি স্টেজে! এর কিছুদিন পরে সেখানেই স্থাপন করা সব ক্যামেরার সামনে অভিনয় করেন নীল আর্মস্ট্রং এবং বাজ অলড্রিন। এরপর সেই ভিডিওই বিশ্বজুড়ে প্রচারের ব্যবস্থা করা হয় নাসার পক্ষ থেকে।
এরিয়া ৫১ এ যে আসলে কী আছে সেই সম্পর্কে জনগণের ধারণা বেশ কম। এই কম ধারণা থেকেই পরবর্তীতে জন্ম নিয়েছে নানা কল্পনার শাখা-প্রশাখা।
এই যেমন মাটির তলার বাঙ্কারটির কথা বলা যায়। কোনো কোনো কন্সপিরেসি থিওরিস্টের মতে, এরিয়া ৫১ এ মাটির নিচে বিশাল বাঙ্কার গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। আর সেখানেও রয়েছে প্রযুক্তির অত্যাধুনিক আশীর্বাদপুষ্ট বিমানের আনাগোনা। সেই বিমানগুলোকে সেখানে লুকিয়ে রাখা হয় যাতে করে স্যাটেলাইটের মাধ্যমেও সেগুলোর কোনো হদিস কেউ না পায়। কারো মতে সেই বাঙ্কারগুলো ৪০ তলা ভবনের সমান উঁচু!
কারো কারো মতে, এরিয়া ৫১ এ আসলে একসাথে কাজ করছে আমেরিকান সরকার এবং ভিনগ্রহের প্রাণীরা।
তাদের ধারণানুযায়ী, সেখানে দুই পক্ষের মিলিত প্রচেষ্টায় মানুষ ও এলিয়েনের এমন সংকর প্রজাতি বানাতে কাজ চলছে যাদের দেখলে মনে হবে তারা মানুষ। কিন্তু শারীরিক ও মানসিকভাবে তারা হবে সেই এলিয়েনদের মতোই! তারাই নাকি ভবিষ্যতের পৃথিবীতে নেতৃত্ব দিবে। অনেকে আবার কল্পনার ডানাকে আরো অনেক দূর প্রসারিত করে বলে যে, এখানে যে সংকর প্রজাতির জন্ম দেয়া হচ্ছে, তারা আসলে এলিয়েন নিয়ন্ত্রিত। ভবিষ্যতে যদি কোনো কারণে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের দরকার পড়ে, তাহলে এলিয়েনরা গবেষণাগারে জন্মানো এসব সংকর প্রাণীর অঙ্গই ব্যবহার করবে!


আমেরিকার ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের তথ্য মোতাবেক, গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মেঘের পরিবর্তন করে বৃষ্টিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায় কিনা তা নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছিলো। আবার ১৯৬২ থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ন্যাশনাল ওশানিক এন্ড অ্যাটমস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ কমানোর জন্য কাজ করেছিলো, যদিও তাদের সেই গবেষণা ততটা ফলপ্রসূ হয় নি।
এ থেকেই অনেকে ধারণা করে থাকে যে, আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটানোর জন্য এমন বিভিন্ন পরীক্ষাও চলে এরিয়া ৫১ এ।
বলা হয় এই সব পরিক্ষায় দুর্ঘটনাবসত সুনামির সৃষ্টি হয়।
বর্তমানে এই প্রজেক্টটি  হার্প(HAARP) নামে পরিচিত।  
ম্যাজেস্টিক ১২’ নামে সুপরিচিত একটি টার্ম আছে, যা দিয়ে আমেরিকার একটি গোপন দলকে বোঝায়। বিভিন্ন বিজ্ঞানী ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত সেই দলটি নাকি গত ছয় দশক ধরে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা করার জন্য যাতে আমাদের এই ধরণীটি একইসাথে মানুষ এবং অভিজাত এলিয়েনরা পরিচালনা করতে পারবে!

ম্যাজেস্টিক ১২ নাকি ইতোমধ্যেই এলিয়েনদের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছে। ১৯৪৭ সালে সূত্রপাত হওয়া এ প্রজেক্টের মাধ্যমে এলিয়েনদের বিভিন্ন প্রযুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের হাতে এসেছে বলে দাবি কনস্পিরেসি থিওরিস্টদের। বিনিময়ে এলিয়েনরা পেয়েছিলো বিভিন্ন পশুপাখি, এমনকি মানুষের উপর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা চালানোর অধিকার!
মাঝে মাঝেই আমাদের ইচ্ছা করে অতীতে ফিরে গিয়ে নিজের ছোটবেলার সেই সত্তাটাকে একবার দেখে আসতে, কৈশোরের রঙিন সময়গুলোতে ফিরে যেতে কিংবা জীবনে নেয়া ভুল সিদ্ধান্তগুলো অতীতে গিয়ে কোনোভাবে পাল্টে দিতে। এছাড়াও অতীতের বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের সাথে সামনাসামনি দেখা করতে কিংবা অতীতের বিখ্যাত কোনো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হতেও ইচ্ছা করে কারো কারো। শুধু অতীতের কথাই বা বলছি কেন? বর্তমান নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় থাকা মানুষগুলো মাঝে মাঝেই জানতে চায় তাদের ভবিষ্যতে কী আছে তা জানতে। এ সবই সম্ভব হতো যদি সময় পরিভ্রমণ নামক বিষয়টি সম্ভব হতো।

এবার আসা যাক টেলিপোর্টেশনের কথায়। সায়েন্স ফিকশন গল্প ও সিনেমার পাগলেরা এ বিষয়টির সাথে পরিচিত অনেক আগে থেকেই। মুহুর্তের মাঝেই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যেতে পারার বিষয়টিকেই সাধারণত বলা হয় টেলিপোর্টেশন। এর মাধ্যমে পদার্থ ও শক্তি উভয়েরই স্থানান্তর সম্ভব বলে মনে করা হয়। মানব কল্পনার এ বিষয় দুটো নিয়ে এরিয়া ৫১ এ কাজ চলছে বলে মনে করেন অনেকে।