Pages

Saturday, 4 August 2018

পৃথিবীর একটি অমিমাংসিত রহস্য - ভয়নিখের রহস্যময় পান্ডুলিপি

পান্ডুলিপি কথাটা শুনলেই চোখের সামনে ধুলি ধুসর কত গুলো কাগজের সমষ্টি ভেসে উঠে, যা একজন লেখকের বহু সাধনার ফসল, একজন প্রাকাশকের কাঙ্খিত জিনিস অথবা একজন পাঠকের কৌতুহল, প্রচীন পান্ডুলিপি সংগ্রহ করা বা সংরক্ষন করা অনেকের পেশা। পান্ডুলিপি কিনে চড়া দামে বিক্রি করা এক লাভজনক ব্যাবসাও বটে ।কিন্তু কিছু পান্ডুলিপি ঘিরে তৈরী হয়েছে অনেক অনেক রহস্যময়তা আর গল্প গাথা। তেমনি এক পান্ডুলিপি "ভয়নিখের পান্ডুলিপি"।

পৃথিবীতে যত রহস্যময় বস্তু আছে তার ভেতরে ভয়নিখের পান্ডুলিপি অন্যতম। ভয়নিখের পান্ডুলিপি পাওয়া যায় আজ থেকে প্রায় ৮৫ বছর আগে। পোলিশ-আমেরিকান প্রত্নতাত্তিক পুস্তকবিক্রেতা উইলফ্রিড ভয়নিখের হাতে এই পান্ডুলিপিটি আসে ১৯১২ সনে। তার নামানুসারেই বইটি 'The Voynich Manuscript' বা ভয়নিখের পান্ডুলিপি নামে পরিচিত। ভয়নিখ নিউ ইয়র্ক শহরের  পুরানো বই ব্যাবসায়ী ছিলেন, যার নেশা আর পেশা ছিল পুরানো পান্ডুলিপি সংগ্রহ করে পরে সুযোগ মত চড়া দামে বিক্রি করা।এ ভাবেই পুরানো বইর মধ্যে থেকে হঠাৎ করেই ভয়নিখ পেয়ে যান আলোচ্য পান্ডুলিপি।

  এই পান্ডুলিপির সাথে তার নাম চিরদিনের জন্য জড়িয়ে গেছে। রহস্যময় এই পান্ডুলিপি নিয়ে এত গবেষনা আলোচনা হয়েছে যার শেষ নেই । কিন্তূ এত গবেষনা করেও এর মূল রহস্য আজ পর্যন্ত কেউ বের করতে পারেনি। এটি একটি ২৪০ পৃষ্ঠার একটি বই যার ভাষা সম্পূর্ণ অজানা, পরিচিত কোন ভাষার সাথেই এর ভাষার মিল পাওয়া যায়নি। জটিলতা আরও বাড়িয়েছে এর মাঝে আঁকা ছবিগুলো। এর পাতায় পাতায় আঁকা বিচিত্র সব রঙিন চিত্র, ডায়াগ্রাম, বিশেষ করে গাছপালার ছবিগুলো, যা এই পৃথিবীর কোন প্রজাতির সাথেই মেলেনা। ফলে পাঠোদ্ধার করা হয়ে পরেছে আরও দুরূহ।

পান্ডুলিপির লেখকের পরিচয় অজানাই রয়ে গেছে তবে পান্ডুলিপির কাগজের কার্বন ডেটিং করে জানা গেছে এর পৃষ্ঠাগুলি ১৪০৪ থেকে ১৪৩৮ এর মধ্যে তৈরি করা হয়েছে। ধারনা করা হয় উত্তর ইতালির কোন স্থানে এটা লেখা হয়েছে। পান্ডুলিপি নিয়ে গবেষনা করা অনেকে প্রত্নতত্ত্ববিদ অনেক রকম তত্ত্ব দিয়েছেন। কারও ধারনা, এটি ঔষধ প্রস্তত প্রনালীর কোনবই, কারও আবার ধারনা এটি কোন অপরসায়নবিদের (alchemist) পান্ডুলিপি। অনেকের ধারনা এটা পৃথিবীর কারও লেখা না, ভিনগ্রহের কোন অতিথির ভাষায় লেখা পান্ডূলিপি এটি!

 তবে কেউই নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেন নি। কাজেই এটি এখনও "বিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় হস্তলিখিত পান্ডুলিপি" হিসেবেই রয়ে গেছে। গুজবের একটি হল, পান্ডুলিপিটি সে সব রহস্যময় আলকেমিদের কোন একজনের যারা অপরসায়নের মাধ্যমে সোনা তৈরীর চেষ্টা করতেন এবং পান্ডুলিপিতে সেই সোনা তৈরীর গোপন কথা বলে দেয়া হয়েছে। আবার কেউ কেউ মনে করতেন পান্ডুলিপিতে জোতিবিদ্যার কথা লেখা আছে। মহাকাশ বিদ্যার গো্পন রহস্য এই পান্ডুলিপিতে লেখা আছে বলে কেউ কেউ নিঃসন্দেহ।

আবার একদল মনে করেন পৃথিবী তৈরীর গুপ্ত কথা এখানে লেখা আছে। যারা আত্না এবং পরোলৌকিকতা নিয়ে নাড়াচাড়া করেন তাদের জোড় দাবী এই পান্ডুলিতে আত্নার গোপন রহস্য, মৃত্যুর ওপারের কথা বলা হয়েছে, আরো লেখা আছে কিভাবে আত্মাকে ডেকে আনা যায় তার পূরো গোপন প্রক্রিয়া।

রহস্য আরো ঘনীভূত হল যখন গবেষনার পর মোটামুটি জানা গেল পান্ডুলিপিটি সত্তরের দশকের বিখ্যাত মধ্যযুগের ইংরেজ রজার বেকনের।১৬৬৬ সালের, মার্কির শিক্ষাগুরু বিখ্যাত বিজ্ঞানী অ্যামেনসিয়াস কির্চার কে মার্কির একটি চিঠি থেকে স্পষ্ট বুজা যায় পান্ডুলিপিটি সত্যি রজার বেকনের। বেকন রহস্যময় ব্যাক্তি হিসাবে পরিচিত ছিলেন আর নিজেও অনেক রহস্যময়তার জন্ম দিয়েছেন। মধ্যযুগের এই পন্ডিত অংশগ্রহণ করেননি এমন কোন শাখা নেই। পদার্থবিজ্ঞান, গনিত, অপরসায়ন, চিকিৎসা বিজ্ঞান, ভৌত বিজ্ঞান, জোতিষশাস্ত্র সর্বোপরি আধুনিক বিজ্ঞানের এমন কোন শাখা নেই যা নিয়ে তিনি ভাবেননি। বিজ্ঞানের বর্তমান অনেক আবিসস্কার তিনি সেই সত্তর দশকে লিখে রেখে গেছেন তার “মিরাবিলিস” নামক বইয়ে। যেগুলোর অনেক গুলোই পরবর্তিকালে সত্যি বলে প্রমানিত হয়েছে। অনেক ভবিষ্যত বানী করছে নস্ত্রাদামুর মত যা মিলে গেছে। তিনি যে আত্নার সাথে কথা বলতেন এবং তাদের কাছ থেকে ভবিষ্যতের কথা শুনতেন এ কথাও সমসাময়িক অনেকের লেখায় আসছে। আলকেমিষ্টদের সোনা তৈরীর কথা তিনি বিশ্বাস করতেন।

নানারকম বিস্ময়কর ক্ষমতার অধিকরী রজার বেকনের পান্ডুলিপি পাওয়া গেছে শুনে নড়েচড়ে বসলেন গবেষকরা এর অর্থোদ্বারের জন্য। কিন্ত হাজার চেষ্টা করেও তারা “ক” অক্ষর ও বুজতে পারলেন না। কেননা পান্ডুলিপিতে ব্যাবহার করা হয়নি এমন কোন বিষয় নেই। সংখ্যা, ফুল, ফল, জ্যামিতিক নকশা, গ্রহ নক্ষত্র ছবি থেকে পদার্থ, আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের এ হেন বিষয় নাই যা তিনি ওই পান্ডুলিপিতে লিখে যাননি। এক মহাদূর্বোধ্য ধাধা।


কিন্তু এই ধাধা দেখেও থেমে থাকলেন না গবেষ্করা, অনেক চেষ্টা চরিত্রর পর যা জানা গেল পান্ডুলিপিটির মূল মালিক ছিলেন রোমান সম্রাজ্যের দ্বিতীয় সম্রাট রুডলফ। রুডলফ জানতেন এটি রজার বেকনের লেখা। তাই তিনি তা যত্নের সাথে সংরক্ষন করেন। ১৬১২ সালে সম্রাট দ্বিতীয় রুডলফ মারা গেলে অনেক হাত ঘুরে সেটি প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিখ্যাত বিজ্ঞানী মার্কাস মার্কির হাতে আসে। তিনি তা অত্যান্ত যত্নের সাথে সংরক্ষন করেন।

এরপর ইতালির রোম থেকে ১৬ মাইল দূরে সিসোরোর প্রাসাদের ধবংসাবশেষের মধ্যে থেকেই সম্ভবত আত্নপ্রকাশ করে। সুযোগ সন্ধানী ভায়োনিখের দূর্দান্ত নেশার কারনে ওটা স্বাভাবিক ভাবে তার হাতে আসে। অবশ্য প্রচুর টাকার নিলামে। ভয়নিক ওটা বৈধ ভাবেই মনড্রাগন কলেজের কাছ থেকে কিনে নেন ১৯১২ সালে।

ভয়নিখের এই রহস্যময় পান্ডুলিপি নিয়ে অতিসাম্প্রতিক এক গবেষনায় পান্ডুলিপি গবেষক ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের রবার্ট ব্রুমবাও আবিস্কার করেন এতে আলকেমীর ওপর বিক্ষিপ্ত কিছু কথা ও আধ্যত্নিক কিছু জটিল সংকেত আছে। যার অনেক কিছুই তিনি বুঝতে পারেন নাই। সম্ভবত অমরত্বের একটা ব্যাপারেও আভাস দেয়া আছে। এত কিছুর পর ও কম্পিউটারের এই উৎকর্ষতার যুগেও ভয়নিখের এই পান্ডুলিপি এখন ও রহস্যের আধার।


এই পাণ্ডুলিপি সম্পরকে কিছু তথ্য -

-- অগুনতিবার চেষ্টা করা হয়েছে এর ভাষা গুলি সমাধান করার কিন্তু প্রতিবার এ প্রচুর তর্ক ও বিতর্কের মধ্যে থেকে গেছে  ও কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি, অনেকে বলেন, এর ভিতরে অন্তর্নিহিত ল্যাটিন, চাইনীজ, ফোনেটিক উৎস
সম্প্রতি স্টিফেন বক্স , ইংল্যান্ডের বেডফোর্ডশাযার বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লায়েড লিংগুষ্টিকের অধ্যাপকের দাবি তিনি ১৪ টি অক্ষর উদ্ধার করতে পেরেছেন যা তাকে ১০ টি শব্দের সমাধান করতে সাহায্য করেছে, তিনি মনে করেন এগুলি অন্য বিশেষজ্ঞদের সাহায্য করবে।


--- এই বইটির ৫ টি ভাগ আছে ,
১.উদ্ভিদবিদ্যা সম্পর্কীয় ,
২. মহাকাশবিদ্যা ,
৩. প্রাণিবিদ্যা ,
৪. ঔষধবিদ্যা,
৫.অন্তিমভাগ - যার এখনো সমাধান হয়নি

--- এটা মানা হয় যে এই বইয়ের সমাধান করার ক্ষমতা কেবল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়া ক্রিপ্টোগ্রাফারদের ছিল.

--- মার্সেলো মন্তেমুরো, ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটির ফিজিসিস্ট সম্প্রতি এই  বইটির গবেষণা করে, কম্পিউটারএর কিছু স্ট্যাটিসটিকাল স্টাডি ও তথ্য প্রকাশ করে দেখান যে এটি গুজব না, সত্যি এই বইটি একটি নির্দিষ্ট ভাষায় লেখা।

No comments:

Post a Comment