Pages

Sunday, 31 March 2019

কোডেক্স গিগাস বা শয়তানের ধর্মগ্রন্থ


জ্ঞানের আঁধার বই রহস্যের জট খুলে দেয়। সামনে নিয়ে আসে জানা অজানা তথ্য। তবে কোডেক্স গিগাস নামক বইটি কয়েক শতাব্দী ধরে বিশ্ববাসীকে রহস্যের মায়াজালে ডুবিয়ে রেখেছে । বইটি মধ্যযুগীয় বৃহত্তম পাণ্ডুলিপি হিসেবে পরিচিত।

ল্যাটিন শব্দ কোডেক্স গিগাজ। যার অর্থ: বিশাল আকারের বই। হ্যা, আকারের দিক থেকেও এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বই, অন্য কথায় একে “শয়তানের বাইবেল” বলা হয় এটি ৩৬.২ ইঞ্চি লম্বা, ১৯.৭ ইঞ্চি চওড়া এবং ৮.৬ ইঞ্চি পুরু। ১৩শ শতাব্দীর প্রথম অংশে হারম্যান রিকুলাস নামক চেকোশ্লাভাকিয়ার এক সন্ন্যাসী এই কোডেক্স গিগাস লিখেছেন।

১৬৫ পাউন্ড ওজনের শয়তানের বাইবেলের যা কমপক্ষে ১৬০টি গাধা বা খচ্চড়ের চামড়ার ওপর লিখিত। বইটিতে ৬০০ পৃষ্টা আছে। আর তিন ফুট লম্বা। কমপক্ষে ২ জন মানুষ লাগে এই বই কে স্থানান্তারিত করতে, জোর করে কেউ চেষ্টা করলে গুরুতর আহত হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
বইটির শেষদিকের অনেকগুলো পৃষ্ঠার হদিস মেলেনি। ইতিহাসবিদদের মতে, ইচ্ছাকৃতভাবে পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে।

স্রষ্টার বিপক্ষতার পাশাপাশি বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা পদ্ধতির বর্ননা দেয়া আছে বইটিতে কিভাবে কালাজ্বর, মৃগী রোগ ভালো হবে সে ব্যাপারে লেখা আছে আরো এর পাশাপাশি কিভাবে চোর ধরতে হবে ডাইনি কিভাবে চেনা যাবে সে সবও লেখা আছে।। ভয়ঙ্কর রোগের অভিশাপ ও মুক্তি, আত্মাকে বশীকরণ ও লালন-পালন, কালা জাদুর মন্ত্র সহ নানান বিষয়ে সমাধান দেওয়া আছে এতে।

ইতিহাসবিদরা ইতিমধ্যে পুরো পাণ্ডুলিপির লেখা উদ্ধার করে ফেলেছেন। তাদের মতে, কোডেক্স গিগাস একটি মধ্যযুগীয় জ্বলজ্যান্ত বিশ্বকোষ। পুরো বাইবেলটি লেখা হয়েছে ল্যাটিন ভাষায়। পাণ্ডুলিপির শুরুতে পবিত্র ওল্ড টেস্টামেন্ট সংযুক্ত আছে। ধর্মগ্রন্থ বাইবেল ছাড়াও ফ্লেভিয়াস জোসেফাস নামক এক পণ্ডিত রচিত The Jewish War and Jewish Antiquities গ্রন্থ, সেইন্ট ইসিডোর রচিত একটি বিশ্বকোষ (Encyclopedia), যাজক কোমাক রচিত The Chronicle of Bohemia গ্রন্থ এবং বাইবেলের নতুন টেস্টামেন্ট সংযোজিত রয়েছে।

কিছু ছোট রচনাও এতে রয়েছে। প্রথমটি অনুশোচনা বা প্রায়শ্চিত্তের উপর লেখা আর এটা রয়েছে স্বর্গচিত্রের ঠিক আগে। দ্বিতীয়টি জ্বিন ছাড়ানোর উপর, আর এর অবস্থান শয়তানের প্রতিকৃতির ঠিক পরে। ছোট রচনার সবশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে একটা বর্ষপঞ্জিকা, যাতে রয়েছে সাধু ও স্থানীয় বোহেমিয়ান ব্যক্তির তালিকা যাদেরকে ঐ সময় স্মরণ (স্মরণার্থে উৎসব পালন) করা হত। কিছু হারিয়ে যাওয়া বা পান্ডুলিপি থেকে সরিয়ে ফেলা কাজও রয়েছে। সম্ভবত: সেগুলো ছিল ৬ষ্ঠ শতকে লেখা সাধু বেনেডিক্টের আইন, সন্যাস জীবন-যাপনের জন্যে অত্যাবশ্যকীয় পথ নির্দেশিকা।

বইটির এমন নামকরণের পেছনে রয়েছে অদ্ভুত এক পৌরানিক কাহিনী। হারম্যান নামে বোহেমিয়ার (বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্র) বেনেডিক্ট পোডলাজাইসের আশ্রমে একজন সন্ন্যাসী ছিলেন। একদিন তিনি আশ্রমের নিয়ম ভঙ্গ করে বসেন। নিয়ম ভঙ্গের পাপ হিসেবে তাকে কঠিন শাস্তি দেয়া হয়। শাস্তি হল একটা বদ্ধ কুঠুরীতে তাকে আজীবন নিঃসঙ্গ অবস্থায় কাটাতে হবে। হারম্যান মেনে নেয় এই শাস্তি।

এক পর্যায়ে সে মঠাধক্ষ্য কে তার পাপের শাস্তি লাগবের জন্য প্রস্তাব দেয় সে এক রাতের মধ্যে তার অর্জিত জ্ঞান যা আছে মানুষের কল্যানে তা নিয়ে সে একটা বই লিখবে। যে বইতে সৃষ্টিকর্তা আর মঠের গুনগান থাকবে থাকবে মানুষের বিভিন্ন উপকার কিভাবে হয় সেব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য। মঠাধক্ষ্য হারম্যান এর আর্জি কবুল করে।

তিনি মাঝ রাত আবধি এসে দেখতে পান মাত্র অর্ধেক পাতা লিখতে পেরেছেন। হতাশায় হারম্যান ওই মাঝ রাতে নিজের রক্ত দিয়ে শয়তান কে একটা চিঠি লিখে বসেন। চিঠিতে তিনি শয়তানের কাছে এই বলে সাহায্য কামনা করেন যে, শয়তান যদি তাকে এই বই লিখে দেয় তবে তিনি তার আত্মা শয়তান কে সপে দেবেন। সাড়া দেয় শয়তান। স্ব-শরীরে হাজির হয় শয়তান। শুরু হয় কোডেক্স গিগাস লেখা।

উষার আগেই লেখা শেষ হয়ে যায় এই বিশাল বইটি। নিজেকে প্রমান দেবার জন্য নিজ হাতে শয়তান তার ছবি বইটির ২৯০ নং পৃষ্ঠায় এঁকে রেখে যায়। শয়তানের সাহায্যে লিখা বলেই একে শয়তানের বাইবেল বলা হয়।

কোডেক্স গিগাস নিয়ে প্রচুর গবেষনা চলছে। সুইডেন জাতীয় গ্রন্থাগারের গবেষকদের মতে, যদি লেখক পুরো সপ্তাহ জুড়ে প্রতিদিন প্রায় ৬ ঘণ্টা ধরে লিখে থাকেন, তাহলেও বইটি শেষ করতে তার লেগে যাবে প্রায় ত্রিশ বছর। তবে এটা নিশ্চিত করা হয়েছে এই কোডেক্স গিগাস এক জন মানুষের হাতে লেখা। যা আধুনিক হ্যান্ড রাইটিং এক্সপার্টরা বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমান করেছে। তবে এর লেখার ব্যাপ্তি কাল নিয়ে মতভেদ আছে, তবে বলা হয় খুব কম সময়ে এটি লেখা। সময় যত ই লাগুক এটা একজনের হাতে লিখিত এ নিয়ে কোন সন্দেহ নাই। সেই একজন কি হারম্যান না কি শয়তান নিজে সেটা এখনো কেউ জানে না।

পাণ্ডুলিপিতে ব্যবহার করা হয়েছে একই ধরনের কালি, যা তৈরি হয়েছে পোকামাকড়ের ঝুলকালি দিয়ে। আর রং হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন কীটের শরীরের নানান রং এর তরল। এতে প্রমানিত হয় যে, লেখকের কীট-পতঙ্গ সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা ছিল, আর তাই সে তাদের শরীর থেকে প্রয়োজনীয় রংগুলো সংগ্রহ করে নিতে পেরেছে।

বইর হিসাব অনুযায়ী এই বই ১২২৯ সালের শেষের কোন এক রাতে এটা লেখা শেষ হয়। কোডেক্স গিগাস যে মঠে লিখিত হয়েছিল সে মঠ “হুসাইত বিদ্রোহ” র যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যায় ১৫ শতকে। এর পর এই বই ১৪৭৭-১৫৯৩ পর্যন্ত ব্রোমভ মনাষ্টরিতে ছিল। বইটির প্রতি মোহ দেখে সম্মানস্বরুপ প্রাগের সন্ন্যাসীরা প্যারাগুয়ের রাজা রুডলফদ্বিতীয়কে বইটি কিছুদিনের জন্য উপহার দেয়। রাজাও  বইটি ফেরত দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধার নেন ১৬৯৪ সালে।


বইটি ১৪৭৭-১৫৯৩ পর্যন্ত ব্রোমভ মনাষ্টরিতে ছিল। বইটির প্রতি মোহ দেখে সম্মানস্বরুপ প্রাগের সন্ন্যাসীরা প্রাগ সম্রাট রুডলফ কে বইটি উপহার দেয়। তিনি প্রাগ শহরে নিয়ে আসেন বাইবেলখানা। কিন্তু তার সেই প্রতিশ্রুতির কথা বেমালুম ভুলে যান তিনি। ১৬১৮ সালের দিকে চেক প্রজাতন্ত্রে যুদ্ধ বেঁধে যায়। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে চলা যুদ্ধে চেকরা অনেক কিছুই হারিয়েছে।

এই পুস্তকটি নিয়ে নানা কুসংস্কার চালু রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, যারা এটিকে নিজেদের অধিকারে এনেছে, তাদের উপর ভর করেছে অশুভ শক্তি। হয় তাদের মস্তিস্ক বিকার ঘটেছে অথবা তারা ধ্বংস হয়েছে যুদ্ধে, অপঘাতে অথবা মড়কে।সম্রাট রুডলফই তো জলজ্যান্ত প্রমান।

১৬৪৮ সালে প্রাগের সাথে ৩০ বছরের যুদ্ধ শেষে বিজয়ী সুইডিশ সৈন্যরা এই বই লুঠ করে ১৬৪৮ সাথে ষ্টকহোমে সুইডিশ রয়াল লাইব্রেরীতে নিয়ে যায়। ৭ ই মে ১৬৯৭ সালে সুইডেনের রাজ প্রাসাদের লাইব্রেরীতে এক মারাত্মক আগুন লাগে। এই বই রক্ষিত ছিল। আগুনে বইটির পুরা পুড়ে যাবার আগেই জানালা দিয়ে এটাকে উদ্ধার কর্মীরা নীচে ফেলে দিতে সমর্থ হয়। কিন্তু ক্ষতি ততক্ষনে অনেক হয়ে গেছে। কিছু পাতা পুড়ে গেছে। কিছু পাতা নীচে পড়ার সময় বতাসে উড়ে যায়। এই পৃষ্টাগুলো এখনো পাওয়া যায় নাই।  বর্তমানে এটি সুইডেনের জাতীয় গ্রন্থাগার স্টকহোমে সংরক্ষিত রয়েছে।

৩৫৯ বছর পর এই কোডেক্স গিগাস সুইডেন থেকে আবার প্যারাগুয়ে আনা হয় এক বছরের চুক্তিতে প্রদর্শনীর জন্য ২০০৭ সালে। পরে ২০০৮ সালে আবার সুইডেন কর্তৃপক্ষ আবার তাদের বই ফিরিয়ে নেয়.

No comments:

Post a Comment