Pages

Monday, 30 March 2020

সিনেমা নয়, বাস্তবের উন্মাদ নাৎসি বৈজ্ঞানিক এবং আর্জেন্টিনায় তার তৈরী দুর্গম দ্বীপ-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যা পৃথিবীজুড়ে বহু ক্ষয়ক্ষতি এবং আতঙ্ক ছড়িয়ে ছিল, সেই  যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে আর্জেন্টিনা দেশটি স্বাধীনতার সাথে সাথে শিল্প এবং অর্থনীতির বৃদ্ধি করতে চেয়েছিল, লক্ষ ছিল পৃথিবীর শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

তৎকালীন স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপতি যুয়ান পেরণ যুদ্ধের পর চারিদিকে ছড়িয়ে যাওয়া বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে এমন কয়েকজন কে খুঁজছিলেন যারা নতুন প্রজেক্ট এর সন্ধানে আছে যা দেশকে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করবে এবং যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর অনেক অস্ট্রিয়ান এবং জার্মান বৈজ্ঞানিক আর্জেন্টিনায় ও দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য এলাকায় সবার আড়ালে এসে আত্মগোপন করেছিল। এদের মধ্যে অ্যাডলফ ইচমান ও জোসেফ মেঙ্গেলের মতো বড় বড় নাৎসী নামও ছিল।
এরকম সব দজ্জাল বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে একজন ছিল চেকোস্লোভাকিয়া জন্মানো অস্ট্রিয়ান বৈজ্ঞানিক রোনাল্ড রিখটার। তিনি প্রথম দাবি করেন যে তিনি নিউক্লিয়ার ফিউশন এনার্জি রহস্য ভেদ করতে পেরেছেন যার ফলে খুব সুলভে অসীমিত পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করা যাবে এবং এরপর তিনি নাৎসিদের পার্টিকেল অ্যাক্সিলারেটর ডেভেলপ করতে সাহায্য করেছিলেন।

এইভাবে ঘটনাটি সূত্রপাত হয় যাতে আমাদের কল্পবিজ্ঞান চলচ্চিত্রে দেখা পাগল বৈজ্ঞানিক এবং তার পরীক্ষাগার ও খলনায়ক এর মত বিভিন্ন ভয়ানক স্তরে ঘেরা দ্বীপপুঞ্জ সবই ছিল।

রিখটার ইউরোপ থেকে নকল পাসপোর্টে আর্জেন্টিনায় একদল অন্যান্য জার্মান বৈজ্ঞানিক এবং ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে পালিয়ে এসেছিল। তাদেরকে আর্জেন্টিনার সরকার বিনা বাধায় সক্রিয়ভাবে স্বাগত জানিয়েছিল এবং সরকার থেকে তাদের কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়ার জন্য সমস্ত সুযোগ-সুবিধা জিনিসপত্র এবং স্থান দেওয়া হয়েছিল যাতে আর্জেন্টিনার উন্নতি হয়। রিখটার ডক্টর পেদ্রো মাতিস এর সঙ্গে করে তার নিউক্লিয়ার ফিউশনের স্বপ্নটি আবার তুলে ধরেন, যেটা তখনও তারা সম্পাদন করতে পারেনি। সেই সময়ই তিনি জার্মান এরোনোটিকাল ইঞ্জিনিয়ার কুর্ত ট্যাংক কে নিয়ে আসেন যিনি নাৎসিদের আকাশযানগুলি তৈরি করতে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন। 
জুয়ান পেরোন 

 মিটিং এর সময় রিখটার খুব উৎসাহ সহকারে তার বিস্ময়কর আবিষ্কারের বর্ণনা করেন যা খুবই সুলভে অসীম শক্তির যোগান দেবে এবং এর জন্য ইউরেনিয়াম এর দরকার পড়বে না কেবলমাত্র কিছু খুবই প্রাথমিক এবং সহজলভ্য বস্তু যেমন হাইড্রোজেন, লিথিয়াম, বেরিয়াম ইত্যাদি দিয়ে শুরু করা যাবে। যতক্ষণে রিখটার তার বক্তৃতা সম্পন্ন করেছিল ততক্ষনে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট রাজি হয়ে গিয়েছিল। এমনকি রিখটারের কথাগুলোর সেরকম ভিত না থাকলেও তার দাবি ও বিশ্বাস এত জোরালো ছিল যে আর্জেন্টিনা সরকার তাকে পুরোপুরিভাবে সবকিছুর বন্দোবস্ত করে দিল। 1949 সালে তাকে সানকারলোস -দে-বারি  লোচের কাছে ভুয়াভিলেক এর মধ্যে অবস্থিত প্রত্যন্ত স্থানে হিউমুল নামে একটি গোটা দ্বীপ দিয়ে দেওয়া হলো যাতে সে 'থারমো ট্রন' নামক তার ফিউশন যন্ত্র তৈরি করতে যা কিছু চায় করতে পারবে।

এইভাবে প্রজেক্ট হিমুল শুরু হয় যাতে সরকার প্রচুর অর্থ যোগান দিতে থাকে যাতে কোন খরচ বাকি থেকে যায় না। একটি আঁকাবাঁকা ভাবে বিশাল এলাকা নিয়ে তৈরি প্রাঙ্গণ যাতে বিশাল কংক্রিটের তৈরি 40 ফুট উঁচু বাঙ্কার এবং তার সাথে অনেকগুলি রিয়াক্টর তৈরি করা হলো যার খরচ প্রায় 300 মিলিয়ন ডলার ছিল। এর সাথে বহু পালিয়ে আসা বৈজ্ঞানিক কে কাজে রাখা হল এবং গবেষণাটি কে আরো কার্যকর করে তুলতে বহুমূল্য যন্ত্রপাতি কেনা হল।  যেমন- একটি 'ফুল-ব্লোন পার্টিকেল অ্যাক্সিলারেটর' যা সেই সময় পুরো দক্ষিণ আমেরিকায় মাত্র একটি ছিল।
এই গোপন গবেষণাগারের সবকিছু পাহারা দেওয়ার জন্য এক ধরনের বাহিনী থাকতো যারা অনেকটা জেমস বন্ড চলচ্চিত্রের মতোই ছিল। 1951 সালের মধ্যে গবেষণাগার তৈরি হয়ে যায় এবং বাইরের পৃথিবী অগোচরে দ্বীপের জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে বৈজ্ঞানিকরা তাদের কাজ শুরু করে দিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মূলত একটি ছোটখাটো সূর্য তৈরি করা যেটি সহজলভ্য ও অসীমিত শক্তির যোগান দেবে এবং যা পৃথিবীর সকল পদার্থবিদের স্বপ্ন ছিল। একটা এমন সময় ছিল যখন প্রোজেক্টের মাঝে তারা খুঁজে পেল  রিঅ্যাক্টরের নকশাতে কিছু গলদ আছে যার ফলে সেটি ছিড়ে আবার নতুন করে শুরু করতে বাধ্য হতে হয় এবং পুরো প্রজেক্টটা একটা পয়সার ব্ল্যাক হোলে এসে দাঁড়ায়; কিন্তু কোন স্পষ্ট সাফল্যের ইঙ্গিত না থাকা সত্ত্বেও পয়সার যোগান বন্ধ থাকেনি।
রিখটার ও পেদ্রো মাতিস 

এতকিছু সামগ্রী এবং পয়সা প্রজেক্ট এর পেছনে লাগলেও ভবিষ্যৎ ধোঁয়াশা ছিল কিন্তু তবুও রিখটার সাফল্য সম্পর্কে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছিল যদিও সে কিভাবে এগুলি কাজ করবে তাও পর্যন্ত তখনও বলেনি এবং বৈজ্ঞানিকজগৎ ধীরে ধীরে তার থেকে দূরত্ব বাড়াতে শুরু করেছিল। বাইরের জগত থেকে ঘটনাটির তদন্ত করার জন্য অনেক সাংবাদিক এবং মানুষদের পাঠানো হয়েছিল কিন্তু রিখটারের গুন্ডা বাহিনীর কাছে সকলে ব্যর্থ হয়ে যায়। কোন তথ্য পাওয়া যায়নি যে তারা সেই দ্বীপে কি করছিল এবং বেশিরভাগ বৈজ্ঞানিক সমাজ ভ্রুকুটি তুলে চেয়েছিল। এই ব্যয়বহুল প্রোজেক্টের তিন বছরের মাথায় প্রথম  রিখটার সামনে এসে সবার উদ্দেশ্যে ঘোষণা করে যে সবাই যার পেছনে প্রচুর টাকা ও সময় ব্যয় করে অপেক্ষা করছিল সেই ফলাফল এসেছে তিনি ঘোষণা করলেন মূল ফিউশন সম্পন্ন করা গেছে। রিক্সার যথেষ্ট জয়ী ভঙ্গিমায় বিশ্বের সম্মুখে ঘোষণা দিল যে সে তার লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে এবং সেইদিন খুব শিগগিরই আসবে যখন পারমাণবিক এই শক্তিকে বা এনার্জি কে দুধের বোতল এর মত ছোট প্যাকেটে বিক্রি করা যাবে। এই খবরটি বিশ্বের চারিদিকে খবরের শিরোনামে এসে গেল এবং অনেকেই আশান্বিত হল যে সকলের কাছে ভবিষ্যতে এই স্বল্পমূল্যে পারমাণবিক শক্তি একদিন পৌঁছে যাবে। যদিও এই ঘোষণা সন্দেহজনক হিসাবে অনেক ভ্রুকুটির  সম্মুখীন হয়েছিল। গবেষণার কিছু যন্ত্রপাতি দেখে বোঝা যায় এবং সেখানকার কোন এক প্রযুক্তিবিদ গোপনে দাবি করেন যে এই গবেষণা কেবলমাত্র থেমে গেছে এক্সপেরিমেন্ট করার সময় একটি ত্রুটির কারণে এবং এটাও ঠিক ছিল যে রিকটার আবার নতুন করে গবেষণাটি শুরু করতে অনুমতি দেবে না অথবা কারোর সাহায্য নেবে না আবার এই আবিষ্কারটি সে খুব গোপনে করেছিল, ফলে  অন্য কেউ এ নিয়ে সাহায্য করতে পারতো না। এতকিছুর পর রিখটার পুরনো রিয়াক্টর কে খুলে তার জায়গায় নতুন করে আরও উন্নত মানের রিয়াক্টর তৈরি করার আদেশ দেন যাতে সেই ত্রুটিটি আর না হয়। দুর্ভাগ্যবশত রাষ্ট্রপতি জুয়ান প্রেরণের সন্দেহ বেড়ে যায় এবং তিনি তদন্ত করার জন্য তার নিজস্ব বাহিনী পাঠান যারা দাবি করে যে তারা পারমাণবিক ফিউশন সম্পন্ন করার স্বপক্ষে কোন প্রমাণ খুঁজে পায়নি। বরঞ্চ তারা কিছু সূত্র খুঁজে পায় যাতে জানা যায় রিখটার তার পরীক্ষার ফলাফল কে অতিরঞ্জিত করার জন্য এলাকার আশেপাশে লাউড স্পিকার লাগায় একাউষ্টিক ওয়েভের সৃষ্টি করে ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে। এবং দেখা যায় অনেক যন্ত্রপাতি একে অপরের সাথে ঠিকমত যুক্ত করা ছিল না যা দেখে বোঝা যায় এটা পারতপক্ষে জালিয়াতি ছিল।
আর্জেন্টিনা সরকারের কাছে এটা যথেষ্ট ছিল প্রজেক্টর বন্ধ করে দেওয়ার জন্য এবং 1952 সালে সব বন্ধ করে দেওয়া হয়।
রিখটার কে গ্রেফতার করা হয় এবং কংগ্রেসের থেকে তার উপর বিভিন্ন মামলা করা হয়, এদিকে স্বৈরাচারী প্রেরণ কেও 1955 সালে গদিচ্যুত করা হয়। এই জালিয়াতির পরেও এর পাশাপাশি অনেকগুলি ফিউশন রিক্টর প্রজেক্ট শুরু করা হয় এমনকি এই প্রজেক্ট এর পরিমাণ বেড়ে যায় এই সময়।
আমরা এখনো নিউক্লিয়ার ফিউশান পেয়ে উঠতে পারিনি এবং এটা সেই কল্পনা কারি শক্তি উৎপাদন থেকে গেছে যা আগেও ছিল।

এখনো শিমুল দ্বীপে সেই প্রয়োগ শালার অবশিষ্ট গুলি রয়ে গেছে এবং সেখানে ঘোরার জন্য এবং ইতিহাসের সর্ব বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক জালিয়াতি দেখার জন্য বোট ভাড়ায় দেওয়া হয়। অনেকেই ভাবতে থাকবে রিক্তার কোন উন্মাদ ছিল, বুজরুক ছিল জালিয়াত শিল্পী ছিল নাকি সে সত্যিকারেরই কোন কিছুর পিছনে এগিয়ে চলেছিল। সেকি ফগ জোচ্চোর ছিল নাকি লোকে তার প্রতিভা না বুঝতে পেরে ভুল বুঝে তাকে বন্ধ করে দিয়েছিল? পদার্থবিদ এডওয়ার্ড টেলার খুব সুন্দরভাবে রিখটার সম্পর্কে বর্ণনা করে বলেছিলেন কেউ যদি রিখটারের লেখা একটি লাইন পড়ে সে বুঝতে পারবে সে প্রতিভাবান ছিল। পরের লাইন পড়লে সে মনে করবে রিখটার পাগল ছিল। রিখটারের হাতে সত্যিই কিছু ছিল কি ছিল না তবুও তার এবং দ্বীপের জঙ্গলে তার ভয়ঙ্কর দুর্গের কথা ইতিহাসের অস্বাভাবিক ঘটনা গুলির মধ্যে উল্লেখিত হয়ে থাকবে।

No comments:

Post a Comment