Pages

Sunday, 26 April 2020

লালবাগ কেল্লার রহস্যময় সুড়ঙ্গ--

পৃথিবীজুড়ে রহস্যের অন্ত নেই এবং উপমহাদেশীয় অঞ্চলেও এমন কিছু রহস্য রয়েছে যা আমার মনে হয় প্রচার পেলে পৃথিবীর অন্যান্য বিখ্যাত রহস্য গুলোকে টক্কর দিতে সক্ষম।
আজ আমরা বাংলাদেশের অবস্থিত ঢাকার ভেতরে দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম -- ঐতিহাসিক 'লালবাগ কেল্লার' একটি রহস্যময় সুরঙ্গ নিয়ে আলোচনা করছি যার কথা হয়তো অনেকেই কমবেশি শুনে থাকবেন।

এই লালবাগ কেল্লা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত যা সপ্তদশ শতকের অসমাপ্ত মুঘল দুর্গ স্থাপত্যের মধ্যে একটি। এই সময় ঢাকায় সুবেদারদের থাকার জন্য কোন স্থায়ী ব্যবস্থা ছিল না এবং যেহেতু স্বল্প সময়ের জন্য দায়িত্ব পালন করতে তারা যাতায়াত করতেন তাই স্থায়ী ভবন নির্মাণে তেমন উৎসাহ দেখেননি দেখাননি। সুবেদারদের থাকার ব্যবস্থা ছাড়াও, ঢাকাকে পর্তুগিজ অধিগ্রহণ এবং আর্কানিজ জলদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য 1678 সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু করেছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র মুঘল সুবেদার - আজম শাহ; যিনি পরবর্তীকালে নিজেও সম্রাট পদাধিকারী হয়েছিলেন।তিনি জটিল এক নকশা অনুসরণ করে দুর্গের নির্মাণকাজ শুরু করেছিলেন এবং তার নামকরণ করেছিলেন 'কিল্লা আওরঙ্গবাদ' কিন্তু পরের বছরই সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে দিল্লি ডেকে পাঠান ফলে দুর্গের কাজ অসমাপ্ত রেখে তাকে ফিরে যেতে হয়। আজম শাহ বাংলায় কেবলমাত্র 15 মাস ছিলেন।

তার উত্তরসূরী মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খাঁ এরপর ঢাকায় আসেন; এটি তার দ্বিতীয়বার ছিল এবং যুবরাজ আজম শাহ তাকে লালবাগ দুর্গের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।1680 সালে পুনরায় নির্মাণ কাজ শুরু করলেন শায়েস্তা খাঁ, কিন্তু 1684 সালে তার মেয়ে পরী বিবি অকস্মাৎ মারা গেলে তিনি এটিকে অশুভ মনে করলেন এবং নির্মাণ কাজ পুনরায় বন্ধ হয়ে গেল। 
এর পরিবর্তে তিনি পরিবিবির জন্য এক চিত্তাকর্ষক সমাধি সৌধ নির্মাণ করেন, যার নাম হয় 'পরিবিবির মাজার'; এটি রাজমহল পাহাড়ের কালো ব্যাসাল্ট , রাজপুতানার সাদা মার্বেল এবং বিভিন্ন রকমের টাইলস দিয়ে তৈরি। সমাধি কক্ষে একটি চাইনিজ ক্রস প্যাটার্নে তৈরি পাথরের চন্দন কাঠের কারুকার্য দিয়ে তৈরি দরজা অতিক্রম করে ঢুকতে হয়। 

এছাড়া মুঘল আমলের অন্যতম একটি নিদর্শন এখানকার মসজিদ এই মসজিদটি এখনও স্থানীয় মানুষেরা কোন টিকিট ছাড়াই যেতে পারেন। 

পশ্চিম দিকে গভর্নর শায়েস্তা খানের জন্য একটি দোতলা বাড়ি তৈরি হয়েছিল। এতে হাম্মাম এবং দর্শকদের জন্য হলঘর আছে। মাঝের ঘরটিতে একটি অসাধারণ ফোয়ারা আছে। এছাড়া এখানে একটি অসাধারন মিউজিয়ামও আছে।

লালবাগ দুর্গের প্রায় 12 শতাংশ নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিল এবং দুর্গের দক্ষিণ পূর্ব দেয়ালের সাথে যুক্ত করে দুর্গের নিয়ম অনুযায়ী একটি ভূগর্ভস্থ পথ নির্মাণ করা হয় ।

লালবাগ কেল্লা নিচে অনেকগুলি সুড়ঙ্গের খোঁজ পাওয়া গেছে। বলা হয়, এই সুড়ঙ্গে কেউ ঢুকলে সে নাকি আর ফিরে আসেনা। সম্ভবত এর মধ্যে একটি সুরঙ্গ বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে পরিতক্ত জিনজিরা কেল্লা অব্দি গিয়েছে এবং অন্যান্য সুরঙ্গগুলি স্থানীয় মতে খুব সম্ভবত আক্রমণকারীদের থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। কোন কোন স্থাপত্যবিদদের মত অনুযায়ী, এই পথ 18 কিলোমিটার দূরে টঙ্গী নদী পর্যন্ত চলে যায়; আবার কেউ বলে এটি জলাধারের মুখ এবং এর ভিতরে একটি বড় চৌবাচ্চা রয়েছে।

1857 সালে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। এই সময়ে ঢাকার লালবাগ কেল্লায় 200 জন সিপাহী ছিল। সেই সময় স্থানীয় সিপাহিদের ইংরেজরা 'কালা সিপাই' বলে ডাকত। যখন মে মাসে মিরাটে বিদ্রোহের খবর ঢাকায় পৌঁছায় তখন স্থানীয় ইংরেজরা ভীত হয়ে গেছিল। ঢাকায় চারদিকে গুঞ্জন শুরু হয়েছিল। লালবাগের সিপাহীরা এই সময় চুপচাপ ছিল। কিন্তু আশংকিত ও চিন্তিত হয়ে লেফটেন্যান্ট লুইস ও লেফটেন্যান্ট এটিবেউস এর নেতৃত্বে একদল ইংরেজ বাহিনী কেল্লার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এদিকে কেল্লার কালা সিপাহীরা সেই খবর পেয়েছিল এবং সন্দেহ করেছিল, যে আক্রমণ হতে পারে; অতএব যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। যেহেতু অস্ত্রাগার বন্ধ ছিল তাই স্থানীয় সিপাহীরা খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারেনি। অস্ত্র ও যোগানের অভাবে তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল।যখন এখানে হেরে যাওয়া সিপাহীদের ঘিরে ফেলা হয়, তখন তারা সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে লুকানোর বা পালানোর চেষ্টা করেন কিন্তু তাদের বা তাদেরকে আক্রমণ করে এগোনো ব্রিটিশ সৈন্যরা কেউ আর ফিরে আসেনি। এই সময়ে অনেক মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল এবং তাদের দেহগুলি কেল্লার পূর্বদিকে কুয়ার মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছিল। বাকি সিপাহিদেরকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। এরপর কেল্লার সেই রাস্তা মানুষেরা আর ব্যবহার করত না। স্থানীয়দের মতে রাত্রের দিকে দূর থেকে মানুষের চিৎকারের শব্দ ভেসে আস্তে শোনা যেত এবং কুয়োর জল অনেক বছর ধরে লাল রংয়ের হয়েছিল।শোনা যায়, পরবর্তীকালেও অনেক মানুষ এই কুয়ায় লাফিয়ে ডুবে গেছে। স্থানীয়রা আর কখনো  কূয়াটিকে ব্যবহার করেনি।  

এরপর ব্রিটিশ শাসন চলাকালীন কিছু অধিকারিকরা পরীক্ষা করার জন্য এখানে দুটি কুকুরকে চেনে বেধে প্রবেশ করান। এই দুটি কুকুরের কেউই ফিরে না আসায় তারা চেন ধরে টান দেন এবং কেবলমাত্র তাদের গলায় বাঁধা চেন ও হাড়গোড় ফিরে আসে; কুকুরগুলোকে আর দেখতে পাওয়া যায় না। এরপর পরীক্ষা করার জন্য দুটি হাতিকেও  তারা ভেতরে ঢুকিয়ে ছিলেন কিন্তু তারাও নাকি ফিরে আসেনি। এরপর ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে এই সুরঙ্গ পথ সিল করে দেওয়া হয়েছিল। 1910 সালে লালবাগ কে প্রাচীন স্থাপত্য হিসাবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে আনা হয়। শোনা যায়, এক যুবক এই সুড়ঙ্গের ভেতর ঢোকার চেষ্টা করেছিল কিন্তু ফিরে আসতে পারেনি।  
মোগলদের দ্বারা নির্মিত দুর্গ রহস্য নতুন কিছু না বর্তমানে বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত ও পাকিস্তানেও এরকম অনেক রহস্যময় মুঘল নির্মিত দুর্গ ও সুরঙ্গ অস্তিত্ব পাওয়া যায়। 

বিভিন্ন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় এই সুড়ঙ্গের পেছনে। যেমন- দিল্লির লালকেল্লায় মুঘল আমলে তৈরি একটি সুরঙ্গ দুর্গের পূর্ব দিক থেকে যমুনা নদী অবধি পৌছে যায়। 

আবার পাকিস্তানের অন্যতম রহস্যময় লাহোর কেল্লাতে শাহাজানের শাসনকালে তৈরি বিভিন্ন সুরঙ্গ দেখতে পাওয়া গেছে। যদিও এগুলিও কেন তৈরি হয়েছিল, কোথায় গেছে এখনো পরিস্কার ভাবে জানা যায়নি।  প্রত্নতত্ত্ববিদরা এখনো কাজ করছেন। কিছু গবেষকের মতে এই সুড়ঙ্গের মধ্যে কোন একটি দিল্লির দুর্গের সাথে যুক্ত। জানা গেছে, এর মধ্যে একটি সুরঙ্গ মুঘল শাসক জাহাঙ্গীরের সমাধি স্থানে যায় এবং অন্য কয়েকটি সুরঙ্গ তখনকার দিনে রানী এবং রাজকন্যাদের যাওয়া-আসার জন্য ব্যবহার করা হতো।  যদিও এই লাহোর কেল্লা এবং লালবাগ কেল্লার মধ্যে একটি মিল আছে সেটি হল বিভিন্ন সময়ে এগুলি পুনর্নির্মাণের কাজ করা হয়েছিল ; যার ফলে অনেক সময় পুরনো নকশা ও নির্মান পরিত্যাগ করে আবার নতুন নকশা অনুযায়ী বানাতে হয়েছিল। হয়তো এই জন্যই পূর্বে নির্মিত কোনো কক্ষ বা নির্মাণ সুরঙ্গ হিসাবে পরিতক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে। এছাড়াও এই সুরঙ্গ গুলিতে অনেক সময় শাসকেরা গুপ্তধন বা অন্যান্য সম্পদ লুকিয়ে রাখার জন্য গোপন কক্ষ ব্যবহার করতেন। 

ব্রিটিশ সরকার ধারণা করেছিলেন, যে হয়তো সুরঙ্গ কোন এক প্রকার গ্যাস বা কেমিক্যাল আছে যা দেহকে গলিয়ে দেয় এবং কেবলমাত্র হার পড়ে থাকে।
যদিও বাংলাদেশের লালবাগ কেল্লা পরবর্তীকালে কোন প্রত্নতাত্ত্বিক খনন না হওয়ার ফলে এই সুড়ঙ্গের রহস্য রহস্যই থেকে গিয়েছে।

No comments:

Post a Comment