Pages

Sunday, 21 June 2020

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রহস্যময় ভুতুড়ে বাহিনী (Ghost Army )--

মিত্রপক্ষের দেশগুলি অর্থাৎ 'এলাইড'রা এবার একটু আলাদা রকমের চিন্তাভাবনা শুরু করলো
এই সময়টা খুবই উত্তেজনাপূর্ণ সময় ছিল যেখানে তারা একটি অপ্রতিরোধ্য শত্রুর সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছিল তাই কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা বাধ্য হয়ে একটু উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনার সাহায্য নিচ্ছিল, তারা বিভিন্ন রকম অদ্ভুত প্রকারের পরিকল্পনার সাহায্য নিয়ে ছিল; যেমন - বাদুর বোমা, পায়রা দ্বারা পরিচালিত মিসাইল, বোমা বহনকারী কুকুর, মৃতদেহকে গুপ্তচরবৃত্তির কাজে লাগানো, এমনকি প্যারাসুটিং কুকুরের বাহিনী। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল ইউএসএ'র তৈরি এক বাহিনী যারা অভিনয়, স্পেশাল ইফেক্ট খুব বুদ্ধিমত্তার সাথে ব্যবহার করত

1944 সালে ইউএস আর্মির একটি ইউনিট গঠিত হয় যাদের 23 তম হেডকোয়ার্টারের স্পেশাল বাহিনী বলা হত এবং তাদের কার্য খুব অসাধারন ছিল তাদের মাল্টিমিডিয়াম কৌশলগত ছলচাতুরি বা প্রতারণার ব্যবহার করতে হতো এবং শত্রুপক্ষের কাছে নিজেদের আসল বাহিনী হিসাবে ছলনা করে তাদের দিকে শত্রুদের নজর নিয়ে আসা অথবা ভয়ের সৃষ্টি করা এবং আসল সেনাবাহিনীর গতিবিধি থেকে তাদের দূরে রাখা।

এটা এমন একটি ইউনিট ছিল যেখানে সৃজনশীলতার জন্য পুরস্কার দেওয়া হতো এবং এখানে যোদ্ধা সৈনিক এর জায়গায় তারা আর্টিস্ট, আর্কিটেক্ট, অভিনেতা, সেট ডিজাইনার, ইঞ্জিনিয়ারদের উপর কেন্দ্রীভূত করে নিয়োগ করা হতোএই সকল শিল্পীদের বিভিন্ন আর্ট স্কুল, এডভার্টাইজিং এজেন্সিদের মাধ্যমে খুঁজে বের করা হতো। যদিও এদের মধ্যে কিছু সত্তিকারের আর্মিতে কর্মরতদেরও নেওয়া হতো যেমন- 406 তম কমব্যাট ইঞ্জিনিয়ার ডিভিশন থেকে-- যারা নিরাপত্তা দায়িত্বে ছিল, 603 তম ক্যামোফ্লাজ ইঞ্জিনিয়ার বাহিনী থেকে এবং 332 তম সিগন্যাল সার্ভিস কোম্পানি স্পেশাল বাহিনী থেকে তাদের সাহায্য করার জন্য। এই বাহিনীকে 'ঘোস্ট আর্মি' বলা হত যারা বিভিন্ন কলাকৌশল বা ছল চাতুরীতে পরিপূর্ণ ছিল।

তারা নকল উর্দি বা ইউনিফর্ম পড়তো, নকল পরিচয় পত্র বা পরিচয় চিহ্ন সমৃদ্ধ এবং তাদের যন্ত্রপাতি গুলি এবং অস্ত্রশস্ত্র গুলি নকল ছিল, ফাঁপা নকল যুদ্ধের ট্যাংক, নকল আর্টিলারি, নকল যুদ্ধ বিমান।
এই ধারণাটি আমেরিকানরা 1942 সালে ব্রিটিশদের থেকে পেয়েছিল যখন তারা 'অপারেশন বার্তাম কোড' নামে আল আলামিনের যুদ্ধে একই রকম কলাকৌশল ব্যবহার করেছিল।তাদের সংগ্রহে ফাঁপা বা নকল খেলনা ছিল। যেমন- ট্যাংক, কামান, জিপ, ট্রাক, এয়ারপ্লেন যেগুলি সব এক বিশেষ কম্প্রেসার দিয়ে হাওয়া ভরা ছিল এবং যা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সাজিয়ে ফেলা যেত। এই নকল গাড়ি এবং অস্ত্রশস্ত্র গুলি এত নিখুঁতভাবে তৈরি করা হত এবং খুবই আসল দেখাতো, এমনকি ফাঁপা ট্যাংক গুলির জন্য চলাচলের নকল ছাপও তৈরি করা হতো যা দূর থেকে বা উপর থেকে দেখে আসল মনে হতো। এর সাথেবিশালাকৃতির স্পিকারে নকল আওয়াজও তৈরি করা হতো, যা শুনে মনে হতো এক বিশাল ইনফ্যান্ট্রি ইউনিট বা এয়ারফিল্ড উপস্থিত হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন পরিস্থিতি অনুযায়ী এগুলির পরিবর্তন করা হতো । এই সকল কিছুর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, শত্রুর কাছে আসলের মত দেখতে এক নকল সেনাবাহিনী বানানো, মাত্র 1100 সংখ্যক মানুষের হলেও তাকে দেখতে বহুগুণ বিশাল মনে হতো । এমনকি নকল গাড়ির মধ্যে মাত্র দুজন সৈনিক বসে থাকত এবং কৌশলের মাধ্যমে দেখানো যেটি সেনা ভর্তি গাড়ি ছিল। এছাড়া নকল অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে কিছু আসল আর্টিলারি এবং গাড়ি রাখা হতো কিছুটা বাস্তবতা দেওয়ার জন্য।

এমনকি শোনা যায়  এই ইউনিট আসল ইউনিটের আসল অপারেটরদের মিমিক্ করে বা গলা নকল করে নকল রেডিও ট্রান্সমিশন প্রেরণ করত যা মিথ্যা ও ভুল ভাল তথ্যে ভর্তি থাকতো। এর সাথেই তারা বিভিন্ন রকম ধোঁয়া এবং আলোর ঝলকের ব্যবহার করে বিভ্রমের সৃষ্টি করত। রিক বেয়ার এই ইউনিটের ওপর একটি বই লিখেছিলেন, যার নাম ছিল 'দ্য গোস্ট আর্মি অফ ওয়ার্ল্ড ওয়ার 2' ।

এই বাহিনীর কাজ করার প্রক্রিয়া খুবই জটিল ছিল এবং 'ক্যাম্প পাইনে' একত্রিত হওয়ার পর এই ইউনিটটি ইউরোপের উদ্দেশ্যে রওনা দিল, তাদের এই কার্যকলাপ ফলপ্রসূ হয় কিনা দেখার জন্য। ঠিক 'ডি ডে' এর আগে 1944 সালের মে মাসের প্রথম দিকে 'ঘোস্ট আর্মি' ইউনাইটেড কিংডম এর স্ট্র্যান্ড ফোর্ডের কাছে অবতরণ করলো এবং নরম্যান্ডির জন্য তাদের গোপন কার্যকলাপ শুরু করে দিল। পরবর্তীকালে তারা ফ্রান্স এবং রাইন ভ্যালিতে কাজ করেছিল। কখনো কখনো ফ্রন্টলাইন এর বিপদজনক সীমানায় তারা কাজ করেছিল।

তাদের সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ সম্ভবত 1945 সালের মার্চে ঘটেছিল। এই সময় তারা 40,000 সৈনিকের দুইটি ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের অনুকরণ করে তাদের সাজসরঞ্জাম বানিয়েছিল। যার ফলে জার্মানরা ভাবতে বাধ্য হয় যে, সেইখান থেকেই আক্রমণটি আসবে। যদিও আমেরিকা আসলে এর আরো দক্ষিণ দিকে, রাইন নদীর ধার দিয়ে 30 এবং 79 তম ইনফ্যান্ট্রি ইউনিটকে আক্রমণ করতে পাঠিয়েছিল এবং তারা বলতে গেলে কোনো বাধা ছাড়াই ভিতরে চলে যেতে সক্ষম হয়েছিল। যুদ্ধ শেষ এর রিপোর্ট অনুযায়ী এই ঘোস্ট আর্মি 22 টি আলাদা আলাদা মিশনে সাফল্য অর্জন করেছিল। এই কার্যকলাপের তারা হয়ত তাদের কিছু সংখ্যক সদস্যকে হারিয়েছিল কিন্তু এই সকল অসাধারণ কৌশল ও চাতুরী মাধ্যমে তারা হাজার হাজার সৈনিক ও মানুষের প্রাণ বাচিয়েছিল।

যুদ্ধের পরে 23 তম হেডকোয়ার্টারের এই স্পেশাল ট্রুপদের বেঁচে থাকা সদস্যদের এই কার্যকলাপের বিষয়ে গোপন থাকতে শপথ নেওয়ানো হয়, তাদের এই কলাকৌশলের সামগ্রী লুকিয়ে রাখা হয় এবং পুরো অপারেশন 'ক্লাসিফায়েড' তকমা দেওয়া হয়। এই ইউনিটের সাথে যুক্ত বহু মানুষ পরবর্তীকালে আর্ট বা কলা জগতে প্রচুর সাফল্য পায়। যেমন- বিখ্যাত ফ্যাশন আইকন বিল ব্লাস, ফটোগ্রাফার আর্ট কেন এবং আর্টিস্ট এলসওয়র্থ কেলি। কয়েক দশক ধরে এই বাহাদুর ও সৃজনশীল কলাকুশলীদের কথা কেউ জানত না কিন্তু 1996 সালে যখন সরকার থেকে এই প্রজেক্টটি ডি ক্লাসিফাইড করা হয় তখন সারাবিশ্ব এদের সম্পর্কে জানতে পারে। যদিও প্রজেক্ট এর অনেক কিছু এখনো টপ সিক্রেট রাখা হয়েছে। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একটু আলাদা ধরনের ঐতিহাসিক ঘটনা গুলির মধ্যে বিখ্যাত হয়ে থাকবে।

No comments:

Post a Comment