Sunday, 6 September 2020

মধ্যপ্রাচ্যের রহস্যময় প্রাচীন সমুদ্র দানব --

প্রাচীন এবং আধুনিক সাহিত্যের ইতিহাসের বিভিন্ন স্থানে সমুদ্রের দানবদের বর্ণনা পাওয়া গেছে ।  বর্তমানের কমিক বুকে 'একোয়া ম্যান' এবং 'এইচ পি লাভ ক্রাফট' এর মাছ এবং মানুষের মাঝামাঝি দেখতে এক প্রাণী যাকে 'ডিপ ওয়ান্' বলা হয়; এছাড়া আরবিয়ান নাইটের গল্পে দেখা যায়। 
এই গল্প গুলি কতটা সত্যিকারের হতে পারে?

বর্তমানে একবিংশ শতাব্দীতে মিডিল ইস্ট এর সীমান্তে - ইরান, আজারবাইজান এবং রাশিয়ার মাঝামাঝি স্থানে ক্যাস্পিয়ান সি কে ঘিরে এই ধরনের প্রায় তিন প্রকার সমুদ্রের সাথে যুক্ত প্যারানরমাল কাহিনী ঘুরে বেড়াচ্ছে।  ঐতিহাসিক এই ঘটনাগুলির বৈজ্ঞানিক ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়নি। প্রথম অস্বাভাবিক বিষয়টি হলো ক্যাস্পিয়ান সি-এর ধারের বিভিন্ন শহরের অদৃশ্য হওয়া বা হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা; এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে 'খাজার খাগেনাতের' ঘটনা। এটি একটি শহর ছিল, যা এগারোশো শতকের দিকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ ছিল; কিন্তু হঠাৎ করে কোনো চিহ্ন ছাড়াই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় ঘটনাটি এসেছিল এক প্রকার অবিনাশী হাঙ্গর বা সার্কের রূপে - যার মানুষের রক্তের প্রতি ভীষণ লোভ ছিল এবং তৃতীয়টি এসেছিল 90 দশকের প্রথম দিকে, এই সময় ইউ এফ ও এর দেখতে পাওয়ার একাধিক ঘটনার বিবরণ পাওয়া গিয়েছিল। 



শেষ রহস্যটি এসেছিল এক প্রকার রহস্যময় প্রজাতির থেকে যাকে 'রুনান শাহ' বলে জানা যায়। 
এক ধরনের মনুষ্য রুপি সামুদ্রিক প্রাণী যা প্রচুর নাবিক এবং সমুদ্রের তৈলখনিতে কাজ করা শ্রমিকদের দেখা দিয়েছে বলে জানা যায়।  প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, এরা নিজেদের আশেপাশের জল গুলি স্বচ্ছ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এবং এদের সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর মাছ দলবেঁধে ঘোরে। এই রহস্যজনক বস্তুটিকে জলে এবং স্থলে উভয় জায়গাতেই দেখতে পাওয়ার ঘটনা শোনা যায়।

2005 সালের মার্চ মাসে  'জিন্দেগি' নামক ইরানিয়ান সংবাদপত্রে এদের প্রত্যক্ষদর্শীর একটি বিবরণ প্রকাশিত হয় প্রত্যক্ষদর্শী বাকু নামক একটি জাহাজের কর্মী ছিল, যেটি ক্যাস্পিয়ান সিতে যাতায়াত করতো। একটি সাক্ষাৎকারের জাহাজের ক্যাপ্টেন জো ফার্গুসন দাবি করেন, এই প্রাণীটি বেশ কিছু সময় ধরে তাদের জাহাজের সাথে সাথে সাঁতরে যাচ্ছিল। প্রথমদিকে তারা ভেবেছিল এটা হয়তো কোন বিশালাকৃতির মাছ হবে; কিন্তু পরে তারা লক্ষ্য করেন, এর পাখনাগুলো অন্য ধরনের, দেহের উপরিভাগে দুটি হাতও দেখা যাচ্ছিল। এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হওয়ার পরেই বিভিন্ন স্থান থেকে এই প্রাণী সম্পর্কে আরো বিভিন্ন বিস্তারিত বর্ণনা উঠে আসতে থাকলো। এগুলি সেই সকল প্রত্যক্ষদর্শীদের থেকে যারা অনেককাল ধরে কাস্পিয়ান সাগরের কর্মরত ছিলেন এবং বেশিরভাগ বর্ণনাগুলো একে অপরের সাথে মিলে যাচ্ছিল। যার ফলে এটি কোন কল্পিত বস্তু বলে মনে করা সম্ভব হচ্ছে না। সকল প্রত্যক্ষদর্শীরা এই মানুষরূপী প্রাণীটির বর্ণনা দিয়েছিল - এটি 5 থেকে সাড়ে পাঁচ ফুটের কাছাকাছি লম্বা এবং পেশীবহুল গঠন এর আংগুল এবং পা আছে এবং এর মাথায় কালো এবং সবুজ রঙের কেশ দেখা যায়। এদের নাকের আকৃতি অনেকটা ডলফিন এর চঞ্চুর মত। এর মুখ খুব বড় আকৃতির  এবং চোয়ালযুক্ত নয়। দুর্ভাগ্যবশত,  অনলাইনে এর কোন ফটো বা ভিডিও পাওয়া যায়নি এবং যে ফটো এবং ভিডিও গুলো দাবি করে এগুলি কাস্পিয়ান সি এর 'মারমেড' বা 'মৎস্য মানবের' ছবি সেগুলি কতটা বিশ্বাসযোগ্য তা প্রশ্ন রেখে যায়।



এই প্রাণীগুলিকে প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত বহুবার দেখা গেছে এবং তাই জন্য ইতিহাসের পাতায় সবচেয়ে বেশি তথ্য বা বিবরণসমৃদ্ধ রহস্যময় প্রাণীদের মধ্যে এরা উল্লেখ্য। 2004 সালে আসতারা এবং লের্নকুরান শহরের মাঝামাঝি গ্রামে বসবাসকারী এক মৎস্যজীবী এই রুনান শাহকে দেখার কথা জানায়। রাশিয়ান প্যারানরমাল এক্সপার্ট পল স্টোনহিল যিনি হিস্ট্রি চ্যানেলের 'এনসিয়েন্ট এলিয়েন্স' সিরিজের উল্লেখযোগ্য কন্ট্রিবিউটর ছিলেন, তিনি 2002 সালে দাবি করেন, এই বছরের জুলাই মাসে একজন আজারবাইজানের ব্যবসায়ী এবং তার গ্রিক অতিথিরা সমুদ্র ভ্রমণকালে দেখতে পান একটি ছোট নৌকায় এই দুই মনুষ্যরূপি সামুদ্রিক প্রাণী অন্য একটি সমুদ্রের প্রাণীকে কিছু খাওয়াচ্ছিল; কিন্তু তাদের একটু কাছে যাওয়ার পরেই তারা লাফিয়ে সমুদ্রে ডুবে যায়। ব্যবসায়ীটি এই সামুদ্রিক প্রাণী গুলোকে 'সোয়াদেল' নামে উল্লেখ করেন যার অর্থ - 'পিপল অফ দ্যা সী' বা 'সমুদ্রের বাসিন্দা' .
এছাড়াও স্টোনহিলের মতে, রাশিয়ার কাছের উত্তর কাস্পিয়ান সিএ কর্মরত তৈলখনির কর্মীদের কাছেও এই প্রাণীগুলি সুপরিচিত। 1980 সাল থেকে এই অঞ্চলে ড্রেজিংয়ের কাজ হয়ে চলেছে। এখানকার বহু কর্মীরা মনুষ্য রুপি সামুদ্রিক প্রাণীদের প্রত্যক্ষ বিবরণ দিয়েছেন। বেশিরভাগ মতেই এই প্রাণীগুলি ভীতু প্রকৃতির হয়ে থাকে; যদিও বেশ কয়েকবার এখানে কাজ করতে আসা মহিলাদের গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে। এখানকার কর্মীরা এর জন্য এই সামুদ্রিক প্রাণীকে দায়ী করেছিল এবং একটি প্রত্যক্ষ বিবরণে জানা গিয়েছে, এক দম্পতি স্থলভাগের এই প্রাণীগুলির দ্বারা শারীরিকভাবে আক্রমণের শিকার হয়েছিল।



কয়েক দশক আগে গেলেও কাছাকাছি কাবিলিয়া এবং রাশিয়াতে এই রুনান শাহএর বিবরণ পাওয়া যায়। 1928 সালে 'লেক অফ ভেদলোজেরও' এর স্থানীয় বাসিন্দারা পরপর বেশ কিছু সময় ধরে এই প্রাণীদের দেখতে পাওয়ার ঘটনা দাবী করতে থাকেন এবং পেত্রজাভোডসক ইউনিভার্সিটির এক গবেষক দল এখানে ঘটনাটির তদন্ত করতে আসেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাদের গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল গোপন করে রাখা হয় এবং এই গবেষক দলের সদস্যদের বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয়।  1930 সালের সময়কালীন সোভিয়েত লেবার ক্যাম্পে তাদের মৃত্যু ঘটে।

লিখিতভাবে সবচেয়ে প্রথম দিকের বর্ণনা গুলির মধ্যে একটি পাওয়া যায় কাফর্নিয়া নামক এক আরবের ঐতিহাসিকের লেখায়; আনুমানিক প্রায় 894 খ্রিস্টাব্দে সমকালীন তিনি 'আজা এল মালকোকত' নামক তার গ্রন্থে এক প্রকার মৎস্য মানবের বিস্তারিত বিবরণ দেন, যা পরবর্তীকালে 1871 সালে 'চিকাগো ফিল্ড নিউজলেটারে' প্রকাশিত হয়। তার বর্ণনা অনুযায়ী, কাস্পিয়ান সমুদ্রে একটি বড় মাছ ধরা পরে এবং প্রিন্স সেলিমের উপস্থিতিতে একে উন্মুক্ত করা হয় এবং এর ভেতরে একটি মৎস্য মানব পাওয়া যায়। "এই প্রাণীটি এক ধরনের পাজামা জাতীয় পোশাক পড়েছিল, যা চামড়ার তৈরি ছিল এবং তার হাঁটু পর্যন্ত লম্বা ছিল. সে তার হাতটি কখনো মুখের উপর রাখছিল আবার কখনো তার চুলের ওপর এবং খুব ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল; কিন্তু বেশিক্ষণ জীবিত থাকতে পারেনি।"



'মিস্টেরিয়াস ইউনিভার্স' ওয়েবসাইট অনুযায়ী, 1998 সালে স্যামদ জাফারভ নামে এক ফিশ পোচার এক হাঙ্গর এর মত রহস্যময় প্রাণীর বর্ণনা দেয়, যা তাঁর এবং তাঁর সঙ্গীদের আতঙ্কিত করে তুলেছিল। কাস্পিয়ান সাগরের পূর্ব দিকে ফোর্ট চিভস্যাঙ্কর কাছে তার বন্ধুকে নিয়ে স্পিয়ার ফিশিং এ বেরিয়েছিযেন। এই সময় তারা টর্পেডোর মত বিশালাকৃতির মাছ দেখতে পেয়েছিল। প্রথমে তারা ভেবেছিল এটি কোন হাঙ্গর হতে পারে এবং তার বন্ধুটি সেই প্রাণীটির মাথায় স্পিয়ার বা ভালা ছুড়ে মেরেছিল কিন্তু সে ব্যর্থ হয়েছিল এবং এই প্রাণীটি তার সেই ভয়ঙ্কর চোয়াল দিয়ে তার বন্ধুটিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছিল। এই সময় সে কোনোক্রমে নৌকাটি সমুদ্রের ধারে নিয়ে আসতে সক্ষম হয় এবং অন্যান্য কর্মীরা তাকে টেনে বাইরে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়।  সঙ্গে সঙ্গে তাকে একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তাকে ব্লাড ট্রান্সফিউশন দেওয়া হয় এবং তার একটি পা হাটু থেকে কেটে বাদ দিতে হয়। যখন তাকে প্রশ্ন করা হয়, তাকে কে আক্রমণ করেছিল; তার মতে এটি কোনোভাবেই হাঙ্গর হতে পারেনা। এটা ঠিক যে, কাস্পিয়ান সিএ কোথাও হাঙ্গর থাকার তথ্য পাওয়া যায়নি।



এছাড়াও 90 দশকের প্রথম দিকে ইউ এফ ও দর্শনের বিভিন্ন ঘটনা এই অঞ্চলটিকে একটি রহস্যময় স্থান করে তুলেছে।  2017 সালে তুর্কির ভ্যান ইউনিভার্সিটি ভ্যান লেকের তলায় 3000 বছরের পুরনো আর্মেনিয়াম ক্যাসেলের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায়। এর ফলে এই অঞ্চলে একটি সরকারি তদন্ত শুরু হয়। তাদের মতে, আজারবাইজান এবং বাকুর কাছাকাছি ক্যাস্পিয়ান সি এর গভীরে এরকম বহু রহস্যময় শিলালিপি সমৃদ্ধ পাথর খুঁজে পাওয়া গেছে। এইগুলি একটি আইসল্যান্ড এবং দুর্গের আশেপাশে পাওয়া গেছে।  1306 সালে এক ভূমিকম্পের কারণে গঠিত সুনামিতে এগুলির সমুদ্রে তলিয়ে যায়। গবেষক এবং ভাষাতত্ত্ববিদদের মতে এই লিপিগুলি পার্শিয়ান এবং আরবিক এ লেখা, কিন্তু দুর্বোধ্য। যতটা উদ্ধার করা হয়েছে, শতানীক শক্তি এবং প্রাকৃতিক ধ্বংসাত্মক শক্তিগুলি থেকে রক্ষা করার জন্য এই স্থানটি কোন প্রাচীন প্রযুক্তিতে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল।
কিছু কিছু শিলায় মানুষের, পশু পাখি,র দানবের এবং এলভদের চিত্র পাওয়া যায়। এগুলি এই অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক উভয় প্রকার সত্তার বিবরণ দেয়। মনে হয়, প্রাচীনকালের এই অঞ্চলে বসবাসকারী বাসিন্দারা নিয়মিত এই রহস্যময় সামুদ্রিক প্রাণী গুলির সম্মুখীন হতো এবং তাদের থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য যাদুবিদ্যার সাহায্য নিত। এই আবিষ্কারগুলি এবং এই অঞ্চলের রহস্যময় প্রাণীদের ধর্ষণের ঘটনা একটি থিওরি এনে দেয় যা বর্ণনা করে, হয়তো এখানে অর্থাৎ কাস্পিয়ান সাগরের তলায় এম্ফিবিয়ানদের একটি সম্পূর্ণ সভ্যতার অবস্থান ছিল বা আছে।



অনেকেই মনে করে এই অস্বাভাবিক ঘটনাগুলি সুপারন্যাচারাল এবং ইকোলজিক্যাল হুমকি বা সতর্কতা। সাম্প্রতিক কিছু বছর ধরে ক্যাস্পিয়ান সাগরে তৈল উৎপাদন এবং সমুদ্রের তলার আগ্নেয়গিরির সক্রিয়তার কারণে ফ্লোরা এবং ফনার রিপ্রোডাকশন ভয়ানক ভাবে কমে গিয়েছে। কিছু স্থানীয় আজহারী মাঝির মতে এই অঞ্চলে তৈল উৎপাদনে নিরন্তর ড্রিলিং এর ফলে একটি শক্তিকে জাগিয়ে তুলেছে যা মানুষের ধারণারও বাইরে এবং এই শক্তিগুলি সমুদ্রকে তার ইকোলজিক্যাল ভারসাম্য রক্ষা করতে ব্যবস্থা নেবে.....

আপনার কি মনে হয়?

No comments:

Post a Comment