আদা বা Ginger পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী এবং জনপ্রিয় মসলা বা গুল্মজাতীয়র মধ্যে অন্যতম পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন রকম ভাবে একে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
আদার গল্পটি প্রায় 5,000 বছরেরও বেশি পুরনো। প্রাচীন চিনা দার্শনিক কনফুসিয়াস চিকিৎসা ক্ষেত্রে এর উল্লেখযোগ্য অবদানের কথা বর্ণনা করেছিলেন এবং রোমানদের কাছে এটি ধন সম্পদ এবং উর্বরতার প্রতীক ছিল।
আদার প্রথম উৎপত্তি খুঁজে পাওয়া যায় প্রাচীন চীনের দক্ষিণ অংশে; সেখান থেকে এটি ছড়িয়ে পড়ে ভারত, মালুকু আইসল্যান্ড, এশিয়ার অন্যান্য অংশ এবং পশ্চিম আফ্রিকায়। ইউরোপ প্রথম এইগুলোকে দেখতে পায় প্রথম শতাব্দীর সময় যখন প্রাচীন রোমানরা ভারতের সাথে বাণিজ্য করতো। যখন এর পতন ঘটে ইউরোপ এই মসলার কথা ভুলেই গিয়েছিল, যতক্ষণ না মার্কোপোলো তার প্রাচ্য দেশগুলিতে যাত্রাকালীন এইগুলি কিনে নিয়ে এসেছিল। পনেরশো শতাব্দীতে নিউ ওয়ার্ল্ডে এটি আবার পুনরাবিষ্কৃত হয়। আদা ক্যারিবিয়ানে কিনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে এটি খুব সহজে বেড়ে উঠতে শুরু করে। বর্তমানে ভারতে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি আদা উৎপাদিত হয় যার পরিমাণ প্রায় 11,09,000 টনের কাছাকাছি।
আদা কেনার সময় কিছু সতর্কতাঃ
আদা সব সময় তাজা অবস্থায় কেনা উচিত যেগুলি মসৃণ ত্বক ও সুগঠিত হয়, এছাড়া একটু তুলনামূলকভাবে ভারী হয়। যেহেতু টাটকা আদা কেনাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য, সেহেতু অল্প পরিমাণে সবসময় কেনা উচিত যাতে বাড়িতে অনেক সময় ধরে পড়ে থেকে এর কার্যকারিতা কমে না যায়।
দাগ যুক্ত নরম বা আঁশযুক্ত আদা কেনা থেকে বিরত থাকা উচিত, এছাড়া ভেজা বা হালকা ভেজা রকমের আদা কিনবেন না কারণ এতে ছাতা ধরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
কিভাবে বাড়িতে আদা রাখবেন--
আদা সাধারণ ঘরের তাপমাত্রায় দুদিন পর্যন্ত বেশ ভালোই থাকতে পারে কিন্তু আপনি যদি এটিকে কেটে ফেলেন তাহলে চেষ্টা করবেন এটিকে রেফ্রিজারেটরে রেখে দেওয়ার যাতে এর স্বাদ ও গন্ধ নষ্ট না হয়। একটি কাপড়ে ভালো করে মুড়ে সেটিকে প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে যতটা সম্ভব বাতাস মুক্ত অর্থাৎ আঁটোসাঁটো করে বেঁধে ফ্রিজারে বা রেফ্রিজারেটরে রাখার চেষ্টা করবেন। এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় আদাকে কেটে ভদকা বা অ্যালকোহলের ডুবিয়ে সংরক্ষণ করা, গতানুগতিক পদ্ধতিতে মাটিতে পুঁতে রাখা ইত্যাদি প্রক্রিয়াতেও সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে।
আদার উপকারিতা--
--আদা বমি বমি ভাব এর ক্ষেত্রে খুবই উপকার দেয় যেমন -- সার্জারি অথবা কেমোথেরাপির পর বমি বমি ভাব এছাড়া মাতৃত্বকালীন বমি বমি ভাব ইত্যাদি ক্ষেত্রে খুব ভালো উপকার দেখা গেছে তবে বেশি পরিমাণ আদা খাওয়া উচিত না এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।
--মাসেল পেন বা পেশীর ব্যথা এর ক্ষেত্রে আদা উপযোগী।
--গাঁটে ব্যথা বা স্টিফনেস এর ক্ষেত্রে আদা কিছুটা নিরাময় দিতে পারে।
--হার্টের সমস্যা এবং সুগারের সমস্যা আদা কিছুটা নিরাময় দিতে পারে।
--বেশকিছু প্রকার ক্যান্সার, যেমন- প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সার, ব্রেস্ট ক্যান্সার এবং ওভারিয়ান ক্যান্সারের ক্ষেত্রে আদার উপকারী তা দেখা গেছে। তবে এ নিয়ে আরো গবেষণা দরকার।
--কিছু পরীক্ষায় দেখা গেছে আদার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং বায়ো একটিভ পদার্থগুলি আমাদের মস্তিষ্কের ইনফ্লেমেটরি প্রতিক্রিয়াগুলি আটকাতে সাহায্য করে ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
--আদার অ্যাক্টিভ উপাদান 'জিঞ্জেরল' ইনফেকশনের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে এছাড়া আদার রস বিভিন্ন প্রকারের ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি আটকায়।
--গবেষণায় দেখা গেছেখাবার খাওয়ার এক ঘন্টা আগে 1.2 গ্রাম আদার পাউডার খাওয়ার ফলে হজম শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং খুব দ্রুত আমাদের পাকস্থলী খালি করতে সাহায্য করে।
--একটি পুরনো গবেষণায় দেখা গেছিল আদা, লেবু এবং ব্রাউন সুগার এর মিশ্রণ মদ্যপান করার আগে খেলে মদ্যপান পরবর্তী হ্যাংওভার বা মাথা ধরা, বমি, ডায়রিয়া ইত্যাদি সম্ভাবনা কমে যায়।
--যে যেসকল ডায়াবেটিস রোগীদের হাই ব্লাড প্রেসার আছে, লিকার চায়ের সাথে সামান্য আদা খাওয়ার ফলে ব্লাড প্রেসারে সামান্য উপকারিতা দেখা যায় গেছে।
সাধারণ ক্ষেত্রে আদা স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী এবং নিরাপদ কিন্তু বেশি পরিমাণে খেলে কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে, যেমন--
--গর্ভাবস্থা--
গর্ভাবস্থাকালীন আদা খাওয়া নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক দেখা যায়। সাধারণত 1 থেকে 3 শতাংশ পরিমাণ আদা এই সময় খাওয়া নিরাপদ কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে দিনে 1500 মিলিগ্রামের বেশি খাওয়া উচিত নয়। বমি বমি ভাব এর জন্য বেশি পরিমাণ আদা খেলে গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে। তবে বেশির ভাগ গবেষণায় সকালে বমি বমি ভাব এর জন্য অল্প পরিমাণ আদা খাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
--সাধারণত ডেলিভারির কিছু আগে থেকে আদা খাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয় কারণ এর ফলে রক্তপাতের বৃদ্ধি হতে পারে।
--বেশি পরিমাণ আদা সেবনের ফলে ডায়রিয়া হতে পারে কারণ এটি ইন্টেসটাইন এর মধ্যে দিয়ে খাদ্য এবং মল এর চলাচল এর গতি বৃদ্ধি করে ফলে ইন্টেসটাইন বিশ্রাম পায় না।
--রক্তপাত--
আদায় এন্টি প্লেটলেট প্রপার্টি থাকার জন্য বেশি পরিমাণ খাবার ফলে রক্তপাতের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
--বেশি পরিমাণে আদা খেলে বুক জ্বালা বা অম্বল হতে পারে
--যারা ব্লাড প্রেসার এর জন্য ঔষধ সেবন করছে তাদের আদা খাওয়া বেশি পরিমাণে খাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয় কারণ, এর ফলে হার্টের সমস্যা বৃদ্ধি পেতে পারে এবং হৃদস্পন্দন অনিয়মিত হতে পারে।
--যেহেতু এটি ব্লাড সুগার লেভেল কম করতে সাহায্য করে তাই ডায়াবেটিস এর ওষুধের সাথে এটি খেলে ব্লাড সুগার লেভেল অতিরিক্ত কমে গিয়ে হাইপোগ্লাইসেমিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
--এছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওরাল এলার্জি সিনড্রোম এর কারণে আদা খেলে মুখে চুলকানি বা জ্বালা হতে এবং খাদ্যের স্বাদ হারানো ইত্যাদি দেখা গেছে।
*** আমার এই পোস্টটি বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে গঠিত। আপনার যদি কোন শারীরিক সমস্যা থাকে তবে নিয়মিত আদা খাওয়ার পূর্বে অবশ্যই নিজের চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে এটি সেবন করবেন। এই পোষ্টের বিভিন্ন সূত্র লিঙ্কগুলি দিলাম ---
১. https://www.webmd.com/vitamins/ai/ingredientmono-961/ginger
২. https://www.medicalnewstoday.com/articles/265990
৩. https://timesofindia.indiatimes.com/life-style/food-news/7-side-effects-of-ginger-you-must-be-aware-of/photostory/71594784.cms?picid=71594894
৪.https://www.stylecraze.com/articles/dangerous-side-effects-of-ginger/