Tuesday, 9 June 2020

পৃথিবীর অন্যান্য প্রজাতির মানুষের বিলুপ্তি রহস্য --

এইবারের পোস্টটা একটু অন্যরকম লাগতে পারে, এই পোস্টটা আপনাকে হয়তো ভাবাবে যে আজ আমরা যে ভিনগ্রহী বা অন্যান্য বুদ্ধিমান প্রজাতি নিয়ে উৎসাহ দেখাই, তা সত্যি হতে পারতো আমাদের সাথেই আমাদের মতো বুধ্ধিমান প্রজাতির বসবাস করতো কিন্তু হয়তো আমাদের দোষেই তারা নেই অথবা আমরা সেই দোষ না করলে হয়তো আমাদের অস্তিত্ব আজ থাকতো না। 


তিন লাখ বছর আগে পৃথিবীর বুকে 9 প্রকার মনুষ্য প্রজাতি হেঁটে বেড়াত। এখন কেবলমাত্র এক প্রকারের বর্তমান। 'নিয়ান্ডার্থল' বা 'Homo Neanderthalensis' -- এরা মূলত শিকারি ছিল এবং ইউরোপের ঠান্ডা প্রান্তর গুলিতে নিজেদের অভিযোজিত করে ফেলেছিল। কাছাকাছি 'ডেনিসোভান' এশিয়াতে বসবাস করছিল এবং আরো আদিম প্রকৃতির 'হোমো ইরেকটাস' ইন্দোনেশিয়ায় বসবাস করত এবং 'হোমো রোডেসিএনসিস'রা মধ্য আফ্রিকায় বসবাস করত। কিছু ক্ষুদ্রাকার মস্তিষ্কের প্রজাতিরাও  তাদের সাথে টিকে ছিল; যেমন- সাউথ আফ্রিকার 'হোমো নালেদি', ফিলিপিন্সের 'হোমো লুজনেন্সিস' এবং ইন্দোনেশিয়ার 'ফ্লোরেশিয়েন্সিস' - যাদের 'হবিট' ও বলা হত। এছাড়া ছিল চীনের রহস্যময় 'রেড ডিয়ার' গুহামানবেরা।আমরা খুব দ্রুত এই সকল অন্যান্য প্রজাতির গুলোকে খুঁজে পেয়েছি এবং আশা করি আরও কিছু খুঁজে পাওয়া বাকি আছে। বর্তমানে এরা সকলেই বিলুপ্ত। 
হোমো ইরেক্টাস 

এই সকল অন্যান্য প্রজাতিদের হারিয়ে যাওয়া বিজ্ঞানের ভাষায় একটি 'মাস এক্সটিংশন' এর লক্ষণ। কিন্তু সেরকম কোনো বড় রকমের পরিবেশগত বিপর্যয়, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত, আবহাওয়ার পরিবর্তন, উল্কাপাত এ জাতীয় কিছু এই সময় পাওয়া যায়নি। কিন্তু এই সময়টির মধ্যে একটি ঘটনা ঘটেছিল যা এদের বিলুপ্তির কারণ বলে মনে করা হয় সেটি হলো এক নতুন প্রজাতির ছড়িয়ে পড়া; যা 26,0000 থেকে 35,0000 বছর আগে ঘটেছিল দক্ষিণ আফ্রিকায় এবং এই প্রজাতি ছিল 'হোমোসেপিয়েন্স'। বর্তমান মনুষ্য প্রজাতির আফ্রিকার বাইরে ছড়িয়ে পড়া 'ষষ্ঠ মাস এক্সটিংশন' এর কারণ। 40,000 বছরের একটু বেশি সময় ধরে এই পর্যায়ক্রমে 'আইস এজ' বা শৈত্য যুগের স্তন্যপায়ী প্রাণীদের বিলুপ্তির সাথে রেইন ফরেস্ট গুলির ধ্বংস এই সভ্যতার কারণে হয়েছিল। আমরা সত্যি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রজাতি। আমরা রোমশ ম্যামথদের, গ্রাউন্ড শ্লথ, Moas দের বিলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত শিকার করে গিয়েছিলাম, আমরা খেত খামার করার জন্য অরণ্য এবং সমতল ভূমি ধ্বংস করেছিলাম।পৃথিবীর অর্ধেক স্থলভূমির আমরা পরিবর্তন ঘটিয়েছি, আমরা পৃথিবীর আবহাওয়া পরিবর্তন ঘটিয়েছি।

কিন্তু আমরা সবচেয়ে ভয়ংকর ছিলাম অন্যান্য প্রজাতির মানুষদের পক্ষে। কারণ, আমরা ভূমি এবং সম্পদ সংগ্রহের জন্য তাদের সাথে প্রতিদ্বন্দিতা করেছিলাম। ইতিহাসে ভর্তি ভর্তি এরকম উদাহরণ আছে যেখানে মানুষরা যুদ্ধ করেছে এবং অন্যান্য দলকে উৎপাটন করে, স্থানচ্যুত করে, এলাকা দখল করেছে। রোমের কার্থেজ ধ্বংস করা থেকে শুরু করে পাশ্চাত্য দেশের আমেরিকা দখল, অস্ট্রেলিয়ায় ব্রিটিশ কলোনাইজেশন এর উদাহরণ, এছাড়া ইরাক, বস্নিয়া, রওয়ান্ডা, দারফুর এবং মায়ানমারের সম্প্রতিকালে জেনোসাইড অর্থাৎ জাতিগত বিলুপ্ত করা আমরা দেখতে পেয়েছি। 
নিয়ান্ডারথাল ও হোমো সেপিয়েন্স

মনুষ্য স্বভাবে ভাষা এবং অস্ত্র ব্যবহারের মতই যুদ্ধে বা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়া এবং জেনোসাইড ঘটানো একটি বিতর্কিতভাবে সহজাত ঘটনা। এমন কোন ভারী যুক্তি পাওয়া যায়নি যার থেকে আমরা ভাবতে পারি প্রথমদিকের হোমোসেপিয়েন্সরা কম অধিগ্রহণকারী, কম হিংস্র, সহনীয় বা নম্র ছিল।
বিভিন্ন দার্শনিক প্রাচীনকালের 'হান্টার গ্যাদারা'র বা শিকারি প্রকৃতির মনুষ্য প্রজাতি কে শান্তিপ্রিয়, উদার স্বভাবের, দেখিয়ে চিত্রায়িত করেছেন এবং তর্ক করেছেন যে, আমাদের স্বভাব নয় -- আমাদের পরিবেশ, শিক্ষা-সংস্কৃতি হিংস্রতা সৃষ্টি করে। কিন্তু ঐতিহাসিক তথ্য, ফিল্ড স্টাডি এবং প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য বর্ণনা করে যে, পুরাতন প্রজাতিদের  যুদ্ধ খুবই তীব্র, প্রাণঘাতী ছিল যা ছড়িয়ে পড়েছিল। তারা গরিলা প্রক্রিয়ায় যুদ্ধ যেমন- 'রেড' বা 'অ্যাম্বুষ' বা আচমকা হামলা করা, তার সাথে নিওলিথিক অস্ত্রশস্ত্র যেমন-- মুগুর, বর্ষা, কুঠার, ধনুক ইত্যাদির সাথে যথেষ্ট কার্যকরীভাবে ধ্বংস সাধন করতে সক্ষম হয়েছিল। এই গোষ্ঠী গুলি বা সমাজ গুলির মধ্যে হিংস্রতা, যুদ্ধ, মানুষের মৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল এবং এই যুদ্ধ গুলিতে প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তুলনায় মানুষ প্রতি অনেক বেশি আহত ও নিহতের ঘটনা ঘটেছিল।
হোমো নালেদি 

প্রত্নতাত্ত্বিক দের পাওয়া কঙ্কাল এবং বিভিন্ন আর্টিফ্যাক্ট দেখলে বোঝা যায় যে প্রাচীনকাল কতটা হিংসাত্মক ছিল। উত্তর আমেরিকার 9000 বছরের পুরনো 'কেনেউইক ম্যান' যার পেলভিসে বর্শা বিদ্ধ করা হয়েছিল। কেনিয়ার 10 হাজার বছরের পুরনো 'নাটারুক' সাইটে 27 জন পুরুষ মহিলা ও শিশুদের নির্মম নরসংহার এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। 

অন্যান্য মানব প্রজাতিগুলি তুলনামূলক ভাবে বেশি শান্তিপ্রিয় ছিল এমনটা নয়। যেমন- পুরুষ শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে হিংসাত্মক ঘটনা দেখে অনুমান করা যায় মানুষের বিবর্তনের সাথে বহু আগে থেকেই যুদ্ধ শব্দটি জড়িয়ে রয়েছে। 'নিয়ান্ডার্থল' এর অস্থিগুলি থেকে যুদ্ধর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ 'ট্রমা প্যাটার্ন' লক্ষ্য করা গেছে। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে বাস্তবিক অস্ত্র এবং তার ব্যবহার 'হোমো সেপিয়েন্স' দের একটি মিলিটারি অ্যাডভান্টেজ দিয়েছিল। প্রাচীন হোমোসেপিয়েন্সদের অস্ত্রাগারে সম্ভবত 'জাভেলিন' এবং 'স্পিয়ার থ্রোয়ারস' এর মত নিক্ষেপ করার অস্ত্র বা 'প্রজেক্টাইল ওয়েপন' ছিল। এছাড়া 'থ্রোয়িং স্টিক' এবং 'ক্লাবস' ছিল।
এছাড়া জটিল সরঞ্জাম এবং সংস্কৃতি আমাদের আরও সাহায্য করেছিল একটি ব্যাপক পরিসরে পশুপাখি এবং শস্য চাষাবাদ করতে, বড় গোষ্ঠীকে খাদ্য যোগান দিতে এবং আমাদের প্রজাতিকে সংখ্যার দিক থেকে একটি কৌশলগত প্রাধান্য দিতে।
ডেনিসোভান 

কিন্তু গুহাচিত্রে, খোদাই করা নিদর্শন এবং মিউজিক্যাল যন্তপাতিগুলিতে আরো ভয়ঙ্কর ইঙ্গিত পাওয়া গেছে; 'জটিল চিন্তাভাবনা এবং যোগাযোগ করার ক্ষমতা'। আমাদের সহযোগ করা, পরিকল্পনা , কৌশল, পরিচালনা করা এবং ছলনা করার ক্ষমতাই আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অস্ত্র।

ফসিল রেকর্ড গুলির অস্পষ্টতার জন্য এই ধারণাগুলিকে পরীক্ষা করা কঠিন। কিন্তু ইওরোপে যেটি একমাত্র স্থান যেখানে তুলনামূলক ভাবে সম্পূর্ণ আর্কিওলজিকাল রেকর্ড পাওয়া যায়, সেখানকার ফসিল বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, আমাদের আসার কয়েক হাজার বছরের মধ্যে 'নেয়ান্ডার্থালরা' নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।  কিছু ইউরেশিয়ান মানুষের মধ্যে 'নিয়ান্ডারথাল' ডিএনএর ট্রেস পাওয়া গেছে যা প্রমান করে, তারা বিলুপ্ত হওয়ার আগে আমরা কেবলমাত্র তাদের স্থান দখল করিনি, আমরা তাদের সংস্পর্শেও এসেছিলাম এবং প্রজননও করেছিলাম। 

এছাড়াও প্রাচীন মানুষদের সাথে অন্যানদের সংস্পর্শে আসার অন্যান্য নিদর্শন পাওয়া গেছে। পূর্বের এশিয়ান, পলিনেশিয়ান এবং অস্ট্রেলিয়ান গোষ্ঠীদের মধ্যে ডেনিসোভানদের ডিএনএ পাওয়া গেছে। 
অনেক এশিয়ান বাসিন্দাদের মধ্যে অন্যান্য প্রজাতির ডিএনএ পাওয়া গেছে। যেমন -"হোমো ইরেকটাসের"। আফ্রিকান জিনোমে অন্য 'আর্কাইক' প্রজাতির ডিএনএ পাওয়া গেছে। 
এই বিভিন্ন প্রজাতির সাথে আমাদের প্রজননের তথ্য বা চিহ্ন থেকে বোঝা যায় এই প্রজাতি গুলি আমাদের সংস্পর্শে আসার পরই বিলুপ্ত হয়। কিন্তু কেন আমাদের পূর্বপুরুষরা তাদের নিকটাত্মীয়দের ধ্বংস বা নির্মূল করেছিল ?

এর উত্তর জড়িয়ে আছে আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে। অন্যান্য প্রজাতিগুলির মতো মানুষও বংশবৃদধি করে চলেছিল।কিন্তু ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, আমরা প্রতি ২৫ বছরে আমাদের সংখ্যা দ্বিগুন করেছিলাম এবং একসময় আমরা সঙ্গবদ্ধ  শিকারীরূপে নিজেদের পরিণত করেছিলাম। আমাদের শিকার করার কেউ ছিল না। 

শিকারি বা প্রিডেটর আমাদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে না রাখার ফলে এবং যথাযথ পরিবার পরিকল্পনার অভাবে জন বিস্ফোরণের সৃষ্টি হয় এবং  রসদের অভাব দেখা দেয়। এরপরে আরো বৃধ্ধি, খরা, প্রতিকূল আবহাওয়া, অন্যান্য বিভিন্ন কারণে যখন খাদ্যের অভাব দেখা দেয়, খাদ্যের জন্য গোষ্ঠীগুলির মধ্যে সংঘর্ষ লেগে যায় এবং এলাকা দখল শুরু হয়। এর ফলে যুদ্ধই একমাত্র ও সবচেয়ে কার্যকরী উপায় থেকে যায় যা জনসংখ্যাকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে।

আমারা সম্ভবত কোনো পরিকল্পনা করে অন্যান্য প্রজাতিদের নির্মূল করিনি। এগুলি সভ্যতার একটি সংবদ্ধতার নমুনা ছিল যা যুদ্ধের রূপ পায়। এর অন্তিম পরিণামে অর্থাৎ আক্রমণের পর আক্রমণ , 
পরপর হানা দেয়া, এভাবে এলাকার পর এলাকায় আধুনিক মানুষ তার শত্রুর বিরুদ্ধে জয় ছিনিয়ে গেছে এবং তাদের স্থান দখল করেছে। তবুও নেয়ান্ডার্থালদের বিলুপ্ত হতে অন্তত কয়েক হাজার বছর লেগে যায়।  এর কারণ, প্রাচীন হোমসেপিয়েন্সদের সব সুযোগ সুবিধা ছিল না। যদিও তারা সংখ্যায় বেশি ছিল এবং চাষ আবাদ তাদের যোগান দিতো এবং বিভিন্ন মহামারী রোগ যেমন - স্মল পক্স , Flu এবং হাম - তাদের প্রতিপক্ষকে  বিধ্বস্ত করে দিয়েছিলো। কিন্তু এতো সময় পর নিয়েন্ডারথালরা আমাদের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল, এত সময় ধরে আমাদের আটকে রাখার অর্থ দাঁড়ায়, তারা অবশ্যই আমাদের বিরুদ্ধে অনেক যুদ্ধে জয় লাভ  করেছিল। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, তাদের বুধ্ধিমত্তার 
সাথে আমাদের তেমন দূরত্ব ছিল না।

আজকে আমরা আকাশের দিকে তাকাই আর ভাবি এই বিশ্বে আমরা একা কিনা, কল্পবিজ্ঞান দেখে আমরা অবাক হয়ে ভাবি যে, অন্য বুধ্ধিমান প্রাণীর সাথে দেখা হলে তা কেমন হবে, যারা আমাদের মতোই, কিন্তু আমরা নই।  এটা খুবই দুঃখজনক যে একসময় আমরা এটা করেছিলাম বা এটা ঘটেছিলো এবং তার ফলে তারা আজ নেই। 

No comments:

Post a Comment