পশ্চিম আজারবাইজানের 'তাখত ই সুলেমায়ার' তিন কিলোমিটার পশ্চিমে দানবদের কারাগার অবস্থিত। প্রাচীন প্রবাদ অনুযায়ী, এই স্থানটি রাজা সুলেমান বা প্রফেট সুলেইমা রাক্ষসদের বন্দী রাখতে ব্যবহার করতেন।
তিনি একটি ভয়ানক দৈত্যকে বন্দি করে রেখেছিলেন; যখন সে সোলেমানের বিশেষ রিং চুরি করার চেষ্টা করেছিল। এই বিশেষ রিংটি তাকে ঈশ্বর দিয়েছিলেন যা তাকে এমন সকল জাদুকরী ক্ষমতার অধিকারী করে তুলেছিল যা সাধারণ মানুষের ধারণার বাইরে ছিল। এই রিংটি 'সিল অফ সলমন' নামে পরিচিত যার সাহায্যে তিনি জ্বীনদের পরিচালিত করতেন। 2017 সালের প্রথম দিকে তুরকিশ অধিকারীদের প্রাপ্ত রিংটিকে বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যমে সেই সোলেমানের রিং বলে মনে করেছিল কিন্তু পরে দেখা যায় এটি কেবল মাত্র সেই রিংটির 500 বছরের পুরনো অনুকরণ মাত্র।
যাই হোক না কেন এটা অস্বীকার করা যায় না যে ইতিহাসের গোলকধাঁধায় ঘুরে বেড়ানো এই রিংটি কেবলমাত্র সাধারণ মানুষদের নয়, বিভিন্ন দেশের সরকারদেরও কৌতূহলের কেন্দ্র। কারণ এই বস্তুটির ওপর আধিপত্য পাওয়া মানে স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক উভয় প্রকার শক্তিগুলির ক্ষমতাপ্রাপ্ত হওয়া।
প্রাচ্য থেকে শুরু করে পাশ্চাত্য উভয়ের ইতিহাস জুড়েই রিং বা আংটি ক্ষমতার প্রতীক হিসাবে একটি বিশেষ নিদর্শন রেখে গেছে; বিশেষ করে কলাবিদ্যা থেকে শুরু করে সাহিত্য এবং চলচিত্র , আইন, জাতি এবং জাদুবিদ্যায়।
তবে অন্তত ইসলামিক এবং ইহুদি মতবাদে 'সীল অফ সলোমান' এখনো অব্দি জানা সবচেয়ে শক্তিশালী বস্তু।
সুলেমান অত্যন্ত শ্রদ্বেয় ছিলেন ও তার ক্ষমতার কারণে তার সাথে যুক্ত বহু ধ্বংসাবশেষ ও বস্তুকে হাজার বছর পর এখনো অনুসসরণ করা হয় যার মধ্যে একটি হলো তার জাদুকরী আংটি।
'সিল অফ সলোমনের' গল্পগুলির উৎস খুঁজে পাওয়া কঠিন কিন্তু অনেক ইতিহাসবিদরা মনে করেন মধ্যযুগের আরবের লেখকরা এটিকে নিয়ে যে শ্রুতিকাহিনী বর্ণনা করেছেন, সেগুলি থেকে এর হেক্সাগ্রাম ডিসাইন পাওয়া যায় যার থেকে একটি পেন্টাগ্রাম পাওয়া যায়।
যেহেতু হেক্সাগ্রামের ব্যবহার ইহুদি গুপ্তলেখনীগুলোতে প্রায়শই ব্যবহার করা হতো তাই বেশিরভাগ বিষেশজ্ঞদের মতে, এই চিহ্নটি আরবিক সাহিত্য থেকে কাবালিস্টিক সাহিত্যে প্রবেশ করেছে।
দানবদের উপর সলোমনের ক্ষমতাপ্রাপ্তির কাহিনী "দ্য ম্যাজিক্যাল ট্রিটিস অফ সলোমন" এবং "কে অফ সলোমন" নামক দুটি শক্তিশালী প্রাচীন জাদুবিদ্যার বইতে পাওয়া যায়।
তাখত ই সুলেমায়ার |
ম্যাজিক্যাল ট্রিটিস অফ সলোমন গ্রন্থটিতে পাওয়া যায়, সলমনের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক একটি জিনের দ্বারা নির্যাতিত হয় এবং সে তার অর্ধেক বেতন এবং খাবার নিয়ে নেয়, এমনকি ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল চুষে তার আয়ুও শুষে নেয়। এটা জানতে পেরে সলোমন কি করবে বুঝতে না পেরে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে থাকেন এবং তখন আর্কেঞ্জেল মাইকেল তাকে এই রিংটি দেন।
এই রিংটিতে পেন্টাগ্রামের আকৃতির ঈশ্বরের চিহ্ন ছিল যা সলমনকে দানবদের উপর অধিপত্য দিয়েছিলো।
যুদিও খৃষ্টান মতে, তিনি সেই দানবটিকে জব্দ করেছিলেন, যে তার প্রধান তত্বাধায়ককে নির্যাতন করছিলো এবং তিনি দানবদের প্রধানকে তলব করেছিলেন। তার রিংটি ব্যবহার করে তিনি এরপর সেই দানব প্রধানকে আদেশ করে এক এক করে বহু সংখক দানবদের তার সামনে এনে জড়ো করেছিলেন। এরপর রাজা সলোমন এক এক করে তাদের সকলকে জিজ্ঞসাবাদ করেছিলেন, তাদের নাম, ঠিকানা, উৎস এবং কোন শব্দগুলিতে তাদের উপর আধিপত্য পাওয়া যায় তা জেনেছিলেন।
মনে করা হয় এই অমূল্য জাদুকরী রিংটি সুলেমানের দেহের মতোই কবর দেয়া হয় এবং কিংবদন্তি অনুযায়ী, যে এই আংটিটি খুঁজে পাবে সে এই দুনিয়াতে রাজত্ব করবে।
বিভিন্ন চলচিত্রে, গল্পের বই বা টেলিভিশন শোগুলোতে প্রায়শই যেমন দেখা যায়, বিভিন্ন মানুষ এবং সংস্থা, ভ্যাটিকান থেকে শুরু করে ১৯৪০ সালের জার্মান সরকারও এইজাতীয় শক্তিশালী বস্তুর প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ প্রকাশ করেছিল বলে জানা গেছে।এমনকি জার্মান সরকারের সকল প্রকার কিংবদন্তির প্রতি এক বিশেষ আগ্রহ ছিল।
২০১৬ সালের মার্চ মাসে প্রাগ এর 'ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ দ চেক রিপাবলিকে' ১৩০০০ টি গুপ্তবিদ্যা ও ডাকিনিবিদ্যার বইয়ের সংগ্রহ পাওয়া গিয়েছে যা এস এস চিফ 'হেনরিক হিমলারের' ছিল।
১৮০০ সাল থেকে ইউরোপে মডার্ন লিবারেশন স্টান্ডপয়েন্ট বেড়ে উঠছিলো এবং ইতিহাসবিদ নিকোলাস গুডরিক ক্লার্কের দাবি, জার্মানির গুপ্তবিদ্যার প্রতি আগ্রহ এরই রিএকশনের অংশ ছিল।
তাদের মধ্যপ্রাচ্যের গুপ্তবিদ্যা ও রহস্যগুলির প্রতি আগ্রহের কারণ ছিল আধুনিক পৃথিবী মিথ্যা ও স্যাটানিক আদর্শের উপর দাঁড়িয়ে আছে এটা প্রমান করা।
কামরান ফকিরের 'দ রাইস অফ দ এন্টিক্রিস্ট' অনুযায়ী, ১৯৪০ সালে মিডল ইস্ট বা মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় জার্মান গতিবিধির বেশিরভাগ উদ্দেশ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যের ও আফ্রিকার সেইসব প্রাচীন বস্তু সংগ্রহ করা যা অতিপ্রাকৃত শক্তি সমৃদ্ধ। উদাহরণস্বরূপ বলা হয়, তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গালফ এর উত্তর প্রান্তে প্রভাব বিস্তার করার বিরুদ্ধে আরব ন্যাশনালিস্টদের কাছে আপিল করেন, কারণ ছিল -একটি প্রাচীন সুমেরিয়ান 'স্টারগেট' দখল করা যা ১৯২০ সাল সময়কালীন ইরাকে আবিষ্কৃত হয়।
বলা হয় এই সামগ্রীগুলো যে কোনো দুটি স্থানের মধ্যে কৃত্তিম ওয়ার্মহোল তৈরী করতে সক্ষম ছিল।
যার মাধ্যমে কেউ মহাকাশের যে কোনো স্থানে সহজে যেতে সক্ষম হবে এমনকি বিভিন্ন রিয়ালিটি ও ডাইমেনশনেও যেতে পারবে।
এছাড়া অনেকেই জানেন জার্মানরা তন্ত্র ও গুপ্তবিদ্যা সম্পর্কিত লাইব্রেরি তৈরির জন্য বিশেষ প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন এমনকি ভ্যাটিকানের থেকেও এর জন্য মদত নেয়া হয়। হেনরিক হিমলার বিশ্বাস করতেন পুরাতন গুপ্তবিদ্যার শক্তি জার্মানকে পৃথিবীতে রাজত্ব করতে সাহায্য করবে।
মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন গুপ্তবিদ্যার প্রতি অন্যন্য যে রহস্যময় সংস্থাগুলি আগ্রহ রাখতেন তাদের মধ্যে উলেখ্য ছিল কাবালা এবং নাইট টেম্পলার। ১১১৮ এ জর্দানে ত্রুসেড চলাকালীন 'হিউজ দে পায়েন' নামক এক ফ্রেঞ্চ নাইট নাইট টেম্পলার গঠন করে। অর্ডারটি গঠনের পর থেকেই বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সম্প্রদায়ের সাথে তারা যোগাযোগ স্থাপন করতে থাকে যারমধ্যে ছিল আব্রাহামিক বিশ্বাসী যাদুকরেরা। সবচেয়ে বিখ্যাত যে বস্তুটির সাথে তাদের নাম জড়িয়ে ছিল তা হলো 'দ আর্ক্ অফ কোভেন্যান্ট'। হিব্রু বাইবেল এবং ইসলামিক স্কলারদের মতে আর্কটি হলো এমন একটি সিন্দুক যাতে ফলকের উপর ১০টি স্বর্গীয় কমান্ডমেন্ট খোদাই করা আছে। স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যাচ্ছে কেন এই শক্তিশালী বস্তু যা হয়তো ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী বস্তুগুলির মধ্যে একটি তা নাইট টেম্পারদের টার্গেট হবে। মনে করা হয় এক সময়ের জন্য প্রফেট সুলেমান এর দায়িত্বে ছিলেন। আর্কটির মতোই তার রিংটিও নিজের ক্ষমতার জন্য বিভিন্ন জল্পনা ও আগ্রহের কেন্দ্র হয়, কিন্তু এই ক্ষমতা বুঝতে গেলে জাদুকরী ক্ষমতার দরকার।
মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যে কোনো রকমের অনুশীলন করা অবৈধ মনে করা হয় কারণ, এর অনুশীলনকারীকে জ্ঞানত বা অজ্ঞানত জিনের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়। যদিও সলোমনের ক্ষমতা কোনো জিনের থেকে নয় বরং ঈশ্বরের থেকে প্রাপ্ত ছিল যা পরবর্তী কালে তার সংগ্রহের শক্তিশালী বস্তুগুলিতে দেখা যায়।
কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, 'ম্যাজিকাল ট্রিটিস অফ সলোমন' এবং 'কে অফ সলোমন' বইগুলি সঠিকভাবে বুঝতে পারলে এর পাঠকও সুলেমান বা সলোমনের মতো জিনের উপর ক্ষমতালাভ করতে পারবে। কিন্তু এর পাঠকরাও কি সলোমনের মতো সমান ফলাফল পাবে? ধর্মগতভাবে অবশ্যই নয় কারণ তারা ঈশ্বরের প্রফেট নয়। তবুও তারা কি কিছুটা হলেও অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার প্রভাব পাবে ? এ বিষয়ে ভ্যাটিকান সহমত পোষণ করে। তাদের গোপন সংগ্রহে একটি বই হলো গ্রান্ড গড়িময়রে যা কে অফ সলোমন অবলম্বনে লেখা হয়েছিল, এটি দ রেড ড্রাগন বলেও পরিচিত।এই বইটি বিব্লিক্যাল হিব্রু ও আরামিক ভাষায় প্রথম ১৭৫০ সালে প্যালেস্টাইনে পাওয়া যায়।
বলা হয় এটির স্বয়ং শয়তানকে ডেকে পাঠানো অথবা প্রতিরোধ করা, কাজ করানোর ক্ষমতা আছে।
মনে করা হয়, এই বইটি পোপ হনোরিয়াস iii ১২০০ সালে একটি শয়তান জিনের দ্বারা আবদ্ধ হয়ে
লিখেছিলেন এবং এই জিনটি পোপকে ব্যবহার করে পৃথিবীজুড়ে স্যাটানিক শক্তি ও প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছিলো। তাই অন্য কথায় এই বইগুলি ও অন্যান্য গুপ্ত সামগ্রীগুলি স্যাটানিক ও ধ্বংসাত্মক দিকে ব্যবহার করা যায়। সবশেষে বলা যায় এগুলি শক্তির বিভিন্ন রূপকের মতো যেখানে ব্যবহারকারী মনে করে সে শক্তিকে ব্যবহার করছে কিন্তু বাস্তবে এই শক্তির দ্বারা ব্যবহারকারী ব্যবহৃত হয়।
No comments:
Post a Comment