Sunday, 13 December 2020

আমাজনের রহস্যময় হারিয়ে যাওয়া সভ্যতা--

 আমাজন রেইনফরেস্টে 2 একর জমি জুড়ে একটি পাহাড় আছে যাকে 'মন্টেগ্রেনেড' বলা হয় এটাকে দেখে পাহাড় ছাড়া অন্য কিছু মনে হতো না। একটু বেশি খাড়া মনে হতো কিন্তু এর বেশি নয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে এটিকে উপেক্ষিত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছিল এরপর ধীরে ধীরে পেরুর শহরগুলি বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং আমাজনের জঙ্গলের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ধীরে ধীরে এই স্থানটিতে কৃষকরা তাদের ঘর স্থাপন করার জন্য কাজ শুরু করে। 

যখন বাড়ি তৈরি করার জন্য তারা খনন করতে শুরু করলো, তারা বেশ কিছু পুরনো পাত্র খুঁজে পেল।  তারা বুঝতে পারলো এগুলো বহু পুরনো; পরবর্তীকালে পরীক্ষা করার পর জানা গেল এগুলি হাজারখানেক বছরের পুরনো। স্বাভাবিকভাবে এরপর তাদের জমি গুলি একটি আর্কিওলজিক্যাল সাইটে পরিণত হল। 



2010 সালে আর্কিওলজিস্ট কুইরিনো অলিভেরা এবং তার গবেষকদল মন্টেগ্রেনেড পাহাড়টিতে খননকার্য শুরু করতে লাগলো; খুব শীঘ্রই তারা বুঝতে পারলো এই স্থানটি একদমই একটি পাহাড় নয়। 

এটি আসলে একটি বিশাল আকৃতির পিরামিড, যা আমাজন রেইন ফরেস্টের এক হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার দ্বারা নির্মিত হয়েছিল এবং এটি 3000 বছরেরও বেশি পুরনো এরপর এই মন্টেগ্রেনেড সব হিসাব পাল্টে দিলো। প্রথমবারের মতো আমাজন রেইন ফরেস্টের প্রাচীন সভ্যতা সম্পর্কে একটি শক্ত প্রমাণ পাওয়া গেল। 
এর আগে মনে করা হতো আমাজনের রেনফরেস্ট এমন একটি স্থান যেখানে পা রাখা খুব সাহসিকতার কাজ। আর্কিওলজিস্টরা মনে করতেন যে প্রাচীনকালে হয়তো কিছু মানুষ সেখানে বসবাস করত কিন্তু তারা আলাদাভাবে থাকত এবং ভ্রাম্যমাণ যাযাবর ছিল; যারা বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়াতো এবং খুব স্বল্প সময়ের জন্য বসতি স্থাপন করত। 




যখন স্প্যানিশ অভিযাত্রীরা প্রথমবার দক্ষিণ আমেরিকা পৌঁছেছিলেন তারা লিখেছিলেন, বিশাল বিশাল আকৃতির আমাজনের শহরের কথা এবং সেখানে র একেকটি ভর্তি খামার যা পুরো এক নৌবহরের খাদ্যের প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট। কিন্তু তাদের এই গল্পের স্বপক্ষে পরবর্তীকালে তেমন কিছু ভিত্তি বা প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এতদিন পর্যন্ত এমন কোন আর্কিওলজিক্যাল প্রমাণ পাওয়া যায়নি যা এটা প্রমান করে যে আমাজনে কেউ ঘর তৈরি করে বাস করেছিল বা বেশিদিন থেকে ছিল।

মন্টেগ্রেনেডের এই আবিষ্কারটি পুরো দেশটির ইতিহাস বদলে দিয়েছিল। মনে করা হয় এই সভ্যতার সবচেয়ে পরিপূর্ণ সময়ে আমাজনে প্রায় 5 মিলিয়নের উপর মানুষ বসবাস করত। তারা একটি সভ্যতা এবং সংস্কৃতি তৈরি করেছিল যা সময়ের সাথে সাথে সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যায়। এখন কেবলমাত্র তাদের হাড় বা অস্থী থেকেই আমরা এই লোকগুলির সম্পর্কে জানতে পারব।




যে মানুষগুলো মন্টেগ্রেনেড তৈরি করেছিল, আর্কিওলজিস্ট এর মতে তারা একটি অত্যন্ত উন্নত সম্প্রদায় বা সমাজের অংশ ছিল। তারা কেবলমাত্র একটি পিরামিড তৈরি করে ছেড়ে দেয় নি, তারা প্রথমদিকে অন্তত 1000 বছর আগে পিরামিড তৈরি করে, তারপর পুনর্গঠন করে এবং অন্তত 8 বার এটির পুনর্নির্মাণ হয়। এই সাম্রাজ্যটি কয়েক হাজার বছরের পুরনো ছিল যা একই স্থানে অবস্থান করছিল।

তারা নিজেদের জনতাকে রক্ষা করার জন্য 6 ফিটের দেওয়াল তৈরি করেছিল এবং সাম্রাজ্য শাসনের জন্য বিভিন্ন অফিস তৈরি করেছিল, নদীর ধার বরাবর তারা সমানভাবে ঘর তৈরি করেছিল, তাদের নিজস্ব একটি জটিল ধর্ম ছিল এবং তাদের একটি প্রশস্ত ব্যাবসায়িক নেটওয়ার্ক ছিল যা পুরো পেরু জুড়ে সম্প্রসারিত ছিল।






এদের ইতিহাস হাজার হাজার বছরের পুরনো কিন্তু আমরা এদের সম্পর্কে যা কিছু জানতে পেরেছি তা কেবল মাত্র এই স্থান থেকে পাওয়া ধ্বংসাবশেষ থেকে কিন্তু এই বিশাল আকৃতির জমিটি তাদের সম্পর্কে অনেক রহস্য রেখে গেছে। 
পাথরকে সর্পিল আকৃতির করে খোদাই করে অনেকটা বিশাল আকৃতির সাপ বা শামুকের মতো গোলাকার আকৃতির মন্দির পাওয়া গেছে, আপনি যার মধ্যে দিয়ে গোলকধাঁধার মতো হেঁটে হেঁটে যেতে পারবেন। আপনার প্রতিটি পদক্ষেপ আপনাকে নিচের দিকে নিয়ে যাবে এবং যখন আপনি একেবারে এর কেন্দ্রে পৌঁছাবেন, তখন আপনি প্রায় 40 ফিট নিচে থাকবেন। এই সর্পিল আকৃতির স্থানের কেন্দ্রতে এখানকার মানুষেরা আগুন জ্বালাত; খুব সম্ভবত ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করা হতো এবং এতে ওষুধেরও প্রয়োগ করা হতো। আর্কিওলজিস্টরা চামচ এবং হামালদিস্তা পেয়েছেন যার মধ্যে তখনও ভিলকা নামক মাদকজাতীয় বিজের অবশিষ্টাংশ ছিল। এই বীজগুলি এখান উৎপাদিত হয় না, এরা যেখানে উৎপাদিত হয়েছিল, সেখান থেকে এদেরকে আমদানিকৃত করা হয়েছিল এবং এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে এই সভ্যতার যথেষ্ট বিস্তৃত একটি ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক ছিল। 

অলিভেরার মতে, এখানকার আদিবাসীদের সর্পিল আকৃতির প্রতি আকর্ষণ কারণ এই বীজগুলি হতে পারে। এই ধরনের বীজগুলি সেবন করে আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ার পর ঠিক সর্পিল আকারে বিভিন্ন আলো দেখতে পাওয়া যায়।
যেসকল পূজারীরা এখানে থাকতেন তারা হয়তো এটিকে কোন প্রকার ধ্যান বা সাধনার কাজে ব্যবহার করতেন এবং এই নেশা বা আচ্ছন্নতা তাদের পুরো জাতিকে বদলে দিয়েছিল।




সর্পিল বা প্যাঁচানো আকৃতি এখানকার মানুষের কাছে নেশার মতন ছিল। এই সভ্যতার ধ্বংসাবশেসের  ভেতর প্রচুর শামুকের খোলস সব জায়গায় ছড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। যখন কেউ দেহত্যাগ করতেন, তাদের দেহকে এগুলো দিয়ে ঢাকা হত এবং তাদের সমাজের সব জায়গায় এই আকৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সম্ভবত তারা বিশ্বাস করতো এই ভিলকার বীজ সেবন করার মাধ্যমেই ঈশ্বরের কাছে যাওয়া যায়। 

মন্টেগ্রেনেডের থেকে এক মাইলের কাছাকাছি দূরত্বে গবেষকরা দ্বিতীয় পিরামিডটি খুঁজে পেয়েছিল কিন্তু এটি একটি অতন্ত অন্ধকার কাহিনী তুলে ধরে। দ্বিতীয় পিরামিডটির তলায় 22 টি শিশুর অস্থি পাওয়া যায়। বেশিরভাগ অস্থি গুলি থেকেই অপুষ্টি এবং রোগগ্রস্তর চিহ্ন পাওয়া যায়। 
তারা যখন অত্যন্ত অসুস্থ এবং মৃতপ্রায় হয়ে গিয়েছিল তখন তাদের এখানে নিয়ে আসা হয়। এটি শহরের এমন একটি স্থান যেখানে মা তাদের প্রিয় কিন্তু মৃতপ্রায় অসুস্থ সন্তানদের ওঝা বা তান্ত্রিকের কাছে নিয়ে আসতো ওঝা বা তান্ত্রিকরা এদের চিকিৎসা করত না। এদের কাছে এমন কোন জাদুকরী বিদ্যা ছিলনা যার দ্বারা তারা শিশুদেরকে সুস্থ করতে পারত তাই, এখানে বেশিরভাগ শিশু যাদের আনা হতো তারা সাহায্য পেত না কেবলমাত্র তারা কুরবানী বা বলির নিদর্শন হিসাবে রয়ে গিয়েছে।




শিশুদের এই অস্থিগুলোয় নৃশংসতার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। ছয় বছর বয়সে শিশুকে তার পোষা ইঁদুরের সাথে কবর দেওয়া হয়েছিল এবং একটি জায়গায় একজন যুবতী মাতা এবং তার সাথে নবজাতক শিশুর শিরচ্ছেদ করা অস্থি পাওয়া গিয়েছে। এছাড়া পাওয়া গিয়েছে সেই পুরোহিত বা ওঝার অস্থি, যে এদেরকে কুরবানী করেছে। আর্কিওলজিস্টরা তার নাম দিয়েছে 'দা লর্ড অফ স্নেইলস' এবং সে হয়তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন ছিল  যে 2800 বছর আগে মারা গিয়েছিল এবং তার সমাধি অত্যন্ত চাকচিক্যময় ছিল। দেহটি মাথা থেকে পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত 180 টি শামুকের খোলা দিয়ে ঢাকা দেওয়া ছিল এবং তার মুখটি উপরে সূর্যের দিকে মুখ করা ছিল।

এখানে যে সকল মানুষের বসবাস করত তাদের একটি লেখাও পাওয়া যায়নি। যদি তারা স্বাক্ষর হয়ে থাকে, তবে আমরা জানি না তারা কিভাবে বা কি লিখতো! আমরা তাদের নাম জানিনা, এমনকি জীবন, ভালোবাসা এবং মৃত্যু সম্পর্কে তাদের চিন্তা ধারাও জানতে পারিনি। তারা কেন আমাজনে এসেছিল এবং কেন তাদের পতন হয়েছিল তা জানা যায়নি।  এতদিন পর্যন্ত এদের অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি অথবা আমাজনে কোন প্রাচীন সভ্যতা ছিল বলেও ধারণা ছিল না। আমরা কেবলমাত্র কতগুলি ধ্বংসাবশেষ এবং অস্থি খুজে পেয়েছি কিন্তু প্রায় 2000 বছর ধরে ভুলে যাওয়া মানুষদের জন্য সেগুলিই অনেক।

No comments:

Post a Comment