হিমালয়
রেঞ্জ আকারে যেমন বড়, তেমনি
বিশাল এর সাথে মিশে
থাকা রহস্যের সীমা-পরিসীমা।
ভূত থেকে শুরু করে লোহিত
তুষার,যোগী, অমর
মানব আরও কত গল্পই না প্রচলিত
আছে হিমালয়কে ঘিরে। তবে সেসব
গল্পের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়তা
লাভ করেছে ইয়েতিরা।
‘ইয়েতি’
নামটা পরিচিত লাগছে? ‘তিব্বতে
টিনটিন’ পরেছিলেন
ছোটবেলা? এখন
মনে পড়ছে ? হিমালয়
পর্বতমালায় বসবাস করা মানুষের
মতো দু’পেয়ে কিন্তু বিসালাকার
এক অদ্ভুত প্রাণীর
নামই হচ্ছে, 'ইয়েতি'।
এলাকা ভেদে
তাদের নাম Michê, Dzu-teh, Migoi,
Mi-go, Mirka , Kang Admi , JoBran ( তিব্বতে
টিনটিনে ইয়েতিকে মিগু বলা
হত) , এবং প্রায়
সবগুলো নামই ভাল্লুকের সাথে
জড়িত, এমনকি
ইয়েতি শব্দটিও মেতি-র
অপ্রভংশ, যার
অর্থ ভাল্লুক।
‘ইয়েতি’
নামটা এসেছে তিব্বতি ভাষা
থেকে; বাংলা করলে
অনেকটা হয় ‘পাথুরে ভল্লুক’!
হিমালয়ের মানুষরা
আগে বলতো, ইয়েতিরা
সারাক্ষণ বিশাল একটা পাথর
নিয়ে ঘুরে বেড়াতো, আত্মরক্ষা
নয়তো শিকার করার জন্য। আর
শিস দেয়ার মতো এক রকম শব্দ
করতো। ওই পাথর নিয়ে ঘুরে
বেড়ানোর জন্যই হয়তো ওদের
নাম দিয়ে ছিলো পাথুরে ভল্লুক
বা ইয়েতি। এই ‘ইয়েতি’ নামটা
জনপ্রিয় হয়ে গেলেও ওদের
কিন্তু আরো অনেকগুলো নাম আছে।
এই যেমনঃ ‘মেহ-তেহ’
মানে মানুষরূপী ভাল্লুক,
‘মি-গো’,
মানে বন্যমানুষ,
‘ক্যাং আদমি’ বা
'তুষারমানব',
‘জোব্রান’ বা 'মানুষখেকো'।
উত্তর
আমেরিকার বড় পা ওয়ালা জীব
অর্থাৎ বিগ ফুটের কিংবদন্তির
সাথে ইয়েতির তুলনা করা যায়।
নেপাল,
চীন, ভারত,
বাংলাদেশও পাকিস্তানের
মানুষ ইয়েতির অস্তিত্বে
বিশ্বাস করেন। মনে করা হয়,
এই জীব চমরী গাইকেও
তুলে নিতে পারে।
‘বড়
পা’ বা বিগ ফুট হলো
ইয়েতির মার্কিন মুলুকের
আত্মীয়। এগুলোকে দেখা যায়
দক্ষিন আমেরিকার
বিভিন্ন স্থানে।
স্থানীয়দের
মতে এদের উচ্চতা হলো ৭ থেকে
১০ ফুট ও ওজন ৫০০ পাউন্ড। লোমশ
শরীর, লম্বা হাত ও
মানুষের মতো দুপায়ে হাঁটে।
১৬ ইঞ্চি চওড়া এদের পায়ের
ছাপ! বিগফুটের সপক্ষে
এ পর্যন্ত যে সব প্রমাণ উত্থাপিত
হয়েছে সেগুলোর সব কটি জাল
হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
বিগফুটের
যে বংশধর কানাডায় থাকে,
সেগুলোকে বলা হয়
সাসকোয়াচ। একই রকম দেখতে,
যদিও সবসময়
দেখা যায় না।
ইয়েতির
কাহিনী সবচেয়ে বেশী নেপালে
শোনা গেলেও এটি আসলে নেপালের
স্থানীয় কিংবদন্তী নয়!
এটি তিব্বতের বিস্তৃত
মালভূমি আর বন্ধুর পর্বতে
বসবাসকারী কিছু গোত্রের
লোককথার চরিত্র,
তারা যখন নানা
গিরিখাদ পার হয়ে অনেক আগে
হিমালয় ডিঙ্গিয়ে নেপালে
এসে বসতি স্থাপন করে,
তাদের সাথে সাথে
আসে সেই লোকগাঁথা,
সংস্কৃতি,
ইয়েতির গা ছমছমে
গল্প।
শোনা
যায়, মহামতি
আলেক্সজান্দার ৩২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে
সিন্ধু উপত্যকা জয়ের সাথে
ইয়েতি অভিযানের
জন্য খুব ইচ্ছুক
ছিলেন। তবে স্থানীয়রা তাকে
বলেছিল, এই প্রাণী
নিম্নচাপ ও বেশি
তাপমাত্রায় বেঁচে থাকতে
পারবে না।
সমতলের
মানুষের কাছে ইয়েতির বিশ্বাসযোগ্য
খবর প্রথম পৌছায় ১৮৩২
খ্রিষ্টাব্দে। নেপালের প্রথম
ব্রিটিশ রেসিডেন্ট বি.এইচ.
হাডসনের বর্ণনার পর
ইয়েতির ব্যাপারে সারা বিশ্ব
আগ্রহী হয়ে ওঠে, তিনি
হিমালয় অঞ্চলের অজ্ঞাত এক
প্রাণীর বর্ণনা দিলেন যে এটি
নাকি মানুষের মতো সোজা হয়ে
হাঁটে, সারা শরীর
লম্বা চুলে ঢাকা এবং কোন লেজ
নেই। মি. হডসনের
বিবরণ তখন খুব একটা সারা ফেলতে
পারেনি। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দির
গোড়ার দিকে ইয়েতি সারা
বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
১৮৯৯
সালে লরেন্স ওয়েডেল নামের
এক অভিযাত্রী দাবি করেন তিনি
ইয়েতির পায়ের ছাপ দেখতে
পেয়েছেন। অভিযানের
সময় তার সাথে থাকা
গাইডের কাছেও তিনি ইয়েতির
পায়ের ছাপের কথা শোনেন।
কিন্তু সেটি তুষারমানবের
কিনা সে ব্যাপারে তিনি সন্দিহান
ছিলেন।
এর
পরে ১৯১৩ সালে একদল
চৈনিক শিকারি হিমালয়ের তুষার
ঢাকা অঞ্চলে শিকারে বের হয়
এবং পরে দাবি করে তারা হিমালয়ের
তুষারাচ্ছাদিত অঞ্চলে বানরের
কদাকার থ্যাবড়া মুখাকৃতি,
সারা শরীরে কয়েক
ইঞ্চি লম্বা রূপালী হলদে চুল,
মানুষের মতো হাঁটাচলা
করে এবং অসাধারণ শক্তিশালী
প্রাণীকে প্রত্যক্ষ করেছেন।
বানরের সাথে এর মিল
থাকলেও আকৃতিতে এরা বানরের
চেয়ে অনেক বিশাল।
দু’পেয়ে প্রাণীটি অনেকটা
মানুষের মতোই চলাফেরা করে
এবং দেখে সহজেই ধারণা করা যায়
প্রাণীটি অসাধারণ শক্তিশালী।
১৯২১
সালে কর্নেল সি.কে
হাওয়ার্ড বেরির নেতৃত্বে
একদল অভিযাত্রী তিব্বতের
মধ্য দিয়ে এভারেস্ট অভিযানে
যান এবং সে উদ্দেশে সমুদ্রপৃষ্ঠ
থেকে প্রায় ২০ হাজার ফুট ওপরে
পৌঁছান। সেখানে তারা হিমবাহের
নিকটে কয়েকটি বিশাল আকৃতির
মানুষের পায়ের ছাপের মতো
পদচিহ্ন লক্ষ্য করেন। তুষারশৃঙ্গ
এভারেস্ট থেকে মাত্র ৭৮৬ ফুট
নিচে অবস্থিত জায়গাটির
নাম রংবুক যেটি অশান্ত ও
রহস্যময় স্থান নামে পরিচিত।
জায়গাটির আয়তন ২৬৫ বর্গকিলোমিটার
এবং সব সময় সেখানে প্রচন্ড
ঝড়ো হাওয়া বয়।
১৯২২
সালের দিকে বেশ ক’জন পর্বতারোহী
ঠিক একই জায়গায়
অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন।
সেই অভিযাত্রী
দলটিতে আলেকজান্ডার কিউলাস্ক
নামক একজন চিকিৎসক
ছিলেন। সেখানে আকস্মিক কিউলাস্ক
অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপর
কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি
মারা গেলেন। মারা যাওয়ার
সময় তিনি বার বার প্রলাপ
বকছিলেন। প্রলাপের সময় এক
লোমশ দানবের কথা বলছিলেন।
১৯২৩
খ্রিষ্টাব্দে এভারেষ্ট
অভিযাত্রী ব্রিটিশ মেজর
অ্যালেন ক্যামেরন জানিয়েছিলেন
অভিযান চলাকালে হিমালয়ের
হিমরেখার উর্ধ্বে খাড়াই শৈল
প্রাচীরের গা ঘেসে সঙ্কীর্ণ
পথে সারিবদ্ধ মানবাকৃতি
প্রাণীর একটা দলকে মন্থর গতিতে
চলতে দেখেছিলেন।
১৯২৫ সালে
আলোকচিত্রী ও রয়্যাল জিওগ্রাফিকাল
সোসাইটির সদস্য এন.এ
তোশবাজি একটি ছবি প্রকাশ করেন।
ওই ছবিতে স্পষ্টভাবে দেখা
যায়, মানুষের আকৃতির
একজন কুঁজো হয়ে হাঁটছে।
তিনি বলেন,
“তুষারের বিপরীতে
তাকে কালো দেখাচ্ছিল এবং যতোটা
আমি দেখতে পেয়েছি, তার
শরীরে কোনো কাপড় ছিল না।”
১৯৩৭
খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ অভিযাত্রী
ফ্রাঙ্ক স্মিদি তিব্বত গিয়ে
১৪ হাজার ফুট উঁচুতে এই প্রাণীর
অতিকায় পদচিহ্ন দেখতে
পেয়েছিলেন। তিনি পদচিহ্নগুলোর
মাপ নিয়ে দেখেছিলেন সেগুলো
লম্বায় ছিল প্রায় ১৩ ইঞ্চি
এবং চওড়ায় ছিল প্রায় ৫
ইঞ্চি।
দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের সময় পোলিশ সৈন্য
সোয়ামির রেউচ সাইবেরিয়ার
একটি বন্দীশিবির থেকে পালিয়ে
হিমালয় পেরিয়ে ভারতে এসেছিলেন।
আসার পথে একবার তাকে পথে বাধা
দিয়েছিল দুই ইয়েতি।
১৯৫০
খ্রিঃ নেপালের প্যাঙবোচি
অঞ্চলে একটা মমীকৃত হাতের
তর্জনী, বৃদ্ধাঙ্গুলের
অস্থিসন্ধি আর খানিকটা চামড়া
পাওযা গেলেও বিজ্ঞানীরা তা
পরীক্ষা করে ইয়েতি জাতীয়
প্রাণীর সম্ভাবনা একেবারে
উড়িয়ে দেন।
১৯৫১
সাল, হিমালয় অভিযাত্রী
এরিক শিপটন প্রায় ৫,৫০০
মিটার উচ্চতায় গৌরীশঙ্কর
শৃঙ্গের নিকটবর্তী অঞ্চলে
একই ধরণের পদচিহ্ন দেখতে পেয়ে
তার ছবি তুলে নিয়ে আসেন এবং
সংবাদপত্রে সেই ছবি ছাপা হলে
পৃথিবীতে আরো একবার আলোড়ন
সৃষ্টি হয়। এই ছবি দেখে
বিজ্ঞানীরা নানা যুক্তি
দেখালেও তখন তেমন কোনো সিদ্ধান্তে
তারা আসেননি এরপর ইয়েতি
সম্পর্কে জানার আগ্রহ বেড়ে
যায় বিশ্ববাসীর। তিনি যে
পায়ের ছাপটি আবিষ্কার করেন,
তা প্রস্থে প্রায়
১৩ ইঞ্চি ছিল।
১৯৫৩
সাল, স্যার এডমন্ড
হিলারি ও শেরপা তেনজিং নোরগে
জয় করলেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ
পর্বতশৃঙ্গ ‘মাউন্ট এভারেস্ট’।
আর তারপর অকপটে স্বীকার করে
নিলেন, পথে তারা বড়ো বড়ো অনেকগুলো পায়ের
ছাপ দেখেছেন।এই পায়ের ছাপগুলো
কিন্তু প্রমাণ হিসেবে নিতান্ত
ফেলনা নয়। এই পায়ের ছাপগুলো
নিয়ে ভালো রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষাও
করেছিলেন। আর তা করে দেখে
গেছে, এগুলো কোনো
বানানো পায়ের ছাপও নয়, কিংবা
অন্য কোনো প্রাণীর পায়ের ছাপও
নয়। অন্য কোনো প্রাণীরই পায়ের
ছাপ এতো বড়ো হতে পারে না।
ওরাংওটাং দু’পায়ে দাঁড়াতে
পারলেও দু’পায়ে হাঁটতেই পারে
না। আর এই পায়ের ছাপ যেই প্রাণীর,
ও চলেই দু’ পা দিয়ে!
এরপর হিলারি ওই প্রাণীর
সন্ধানে এভারেস্ট চূড়াও
আরেকবার অভিযান চালান। তার
দাবি, তার বাবা ওই
প্রাণীকে দেখেছিলেন।
১৯৫৮ সালে পাওয়া
গেল ইয়েতিদের সম্পর্কে আরো
কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। আমেরিকান
তথ্যানুসন্ধানী ডক্টর নরম্যান
ডাইরেনফার্ম এবং অভিযাত্রী
মি. ম্যাকলিনের কাছ
থেকে জানা গেল ইয়েতি নামের
তুষার বানর আসলে নিম্নস্তরের
এক ধরনের মানুষ বা মানব সদৃশ্য
প্রাণী। এরা হিমালয়ের নির্জন
গুহায় বাস করে এবং বাইরে খুব
একটা চলাফেরা করে না। প্রচন্ড
শীত ও বৈরী পরিবেশেও এরা সহজে
টিকে থাকতে পারে। তাদের আনা
বিভিন্ন প্রমাণ থেকে জানা
যায় ইয়েতিদের মধ্যে দুটো
প্রজাতি রয়েছে, এদের
মধ্যে একটি প্রজাতি লম্বায়
৮ ফুট এবং অন্যটির উচ্চতা ৪
ফুটের কাছাকাছি।
১৯৭০ সাল,
বৃটিশ পর্বতারোহী ডন
উইলিয়ামস হিমালয়ের অন্নপূর্ণা
শৃঙ্গে উঠছিলেন। হঠাৎ তিনি
শোনেন কি, কে যেন
কাঁদছে! তার গাইড
শেরপাকে ঘটনাটি কি জিজ্ঞেস
করায় শেরপা বলেছিল, ওটা
নাকি ইয়েতির ডাক। পরে ওই রাতেই
নাকি তিনি এক বিশাল দু’পেয়ে
জন্তুকে তাদের ক্যাম্পের
আশেপাশেই ঘুরঘুর করতে দেখেন।
সকালে উঠে তিনি ওই জন্তুটির
বিশাল পায়ের ছাপও দেখেন। ঠিক
আগের পায়ের ছাপগুলোর মতোই।
আর পরের দিন সন্ধ্যাবেলা তিনি
বাইনোকুলার দিয়ে প্রায় ২০
মিনিট ধরে দেখেন ইয়েতিটাকে,
দু’পেয়ে বনমানুষের
মতো একটা প্রাণী তাদের ক্যাম্পের
আশেপাশেই খাবারের সন্ধানে
ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এমনি করে দিন
দিন ইয়েতি রহস্য আরো ঘনীভূত
হচ্ছিলো। আর যেখানেই রহস্য,
সেখানেই রহস্য উদ্ঘাটনের
জন্য চলে আসেন বিজ্ঞানীরা।
এখানেও তাই হলো। বিজ্ঞানীরা
ইয়েতি রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য
আরো বেশি ক্ষেপে উঠলেন। সেই
সঙ্গে ক্ষেপে উঠলেন সত্যসন্ধানী
দুঃসাহসী সব অভিযাত্রীরাও।
২০০৭ সালে আমেরিকান টিভি উপস্থাপক জশুয়া গেটস তাঁর এক বিশাল দল নিয়ে নেপালে চলে আসলেন; উদ্দেশ্য ছিল ইয়েতি রহস্য উদ্ঘাটন। অনেক ঘুরে ঘুরে তারা শুধু ইয়েতিদের পায়ের ছাপই পেলেন। একেকটা পায়ের ছাপ লম্বায় ৩৩ সেমি, পাশে ২৫ সেমি! এরপর তাদের দল হিমালয়েরই আরেক জায়গায় গেল ইয়েতি খুঁজতে। এবারও তারা পেল শুধুই পায়ের ছাপ। আর দুটো পায়ের ছাপ মিলিয়ে তারা বেশ মিলও পেলো। এমনকি, পায়ের ছাপগুলো এতোই নিখুঁত ছিলো, তারা বলেই দিলো, এই পায়ের ছাপ কোনো দুষ্টু মানুষ বানাতেই পারে না। এটা অবশ্যই সত্যিকারের কোনো প্রাণীরই পায়ের ছাপ।
২০০৭ সালে আমেরিকান টিভি উপস্থাপক জশুয়া গেটস তাঁর এক বিশাল দল নিয়ে নেপালে চলে আসলেন; উদ্দেশ্য ছিল ইয়েতি রহস্য উদ্ঘাটন। অনেক ঘুরে ঘুরে তারা শুধু ইয়েতিদের পায়ের ছাপই পেলেন। একেকটা পায়ের ছাপ লম্বায় ৩৩ সেমি, পাশে ২৫ সেমি! এরপর তাদের দল হিমালয়েরই আরেক জায়গায় গেল ইয়েতি খুঁজতে। এবারও তারা পেল শুধুই পায়ের ছাপ। আর দুটো পায়ের ছাপ মিলিয়ে তারা বেশ মিলও পেলো। এমনকি, পায়ের ছাপগুলো এতোই নিখুঁত ছিলো, তারা বলেই দিলো, এই পায়ের ছাপ কোনো দুষ্টু মানুষ বানাতেই পারে না। এটা অবশ্যই সত্যিকারের কোনো প্রাণীরই পায়ের ছাপ।
এরপর ২০০৮
সালে কয়েক জন জাপানি অভিযাত্রী
তো ইয়েতিদের পায়ের ছাপের ছবি-ই
তুলে নিয়ে আসলো। তাদের যে
দলনেতা, ইয়োশিতেরো
তাকাহাসি, তিনি
নাকি ২০০৩ সালে হিমালয়ে গিয়ে
একটা ইয়েতিকে দেখেও ছিলেন!
তার ইচ্ছা,
ইয়েতির ছবি বা ভিডিও
করে নিয়ে আসা।
কিংবদন্তি
পর্বতারোহী রেইনহোল্ড মেসনারসহ
কয়েকজন বিশ্ববিখ্যাত পর্বতারোহীও
বড় বড় চুলের বানর জাতীয় এ
প্রাণীর মুখোমুখি হয়েছিলেন
বলে দাবি করেছিলেন।
তাদের দাবি,
ভাগ্যের জোরে ইয়েতির
মুখ থেকে বেঁচেছেন তারা।
রেইনহোল্ড মেসনার প্রথম
ব্যক্তি হিসেবে অক্সিজেন
ছাড়াই এভারেস্ট জয় করেন।
শুরু হয়েছিল
গুঞ্জন, তর্ক,
যুক্তি- পাল্টা
যুক্তির মেসনার মুখে কুলুপ
এঁটে একজন যথার্থ গবেষকের মত
কাজে লেগে পড়লেন, এবং
দীর্ঘ দুই দশকের নিবিড়
অনুসন্ধান চালানোর পরে সমস্ত
ফলাফল MY QUEST FOR YETI বইতে
লিপিবদ্ধ করেন।
ইয়েতি কিংবদন্তীর
উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে নিঃসন্দেহ
হবার পর তিব্বতে অসংখ্য
জনপদেব্যপক অনুসন্ধান চালান
মেসনার বছরের পর বছর ধরে,
গোপন সন্ধানে
পৌঁছে যান দুর্গম
মনেস্ট্রিতে যেখানে
তিনটি তুষার মানবের মৃতদেহ
সংরক্ষণ করে রেখেছে লামারা,
কিন্তু তাদের কাছে
তা অতি পবিত্র বস্তু বিধায়
বিদেশীদের সেখানে প্রবেশ
নিষিদ্ধ। মেসনারের এই অনুসন্ধানের
মূলপ্রেরণা ছিল যে এই
কিংবদন্তীর মূলে কোন না কোন
বাস্তব ভিত্তি অবশ্যই আছে,
এটি স্বর্গীয়
দেবদূত বা কল্পকথার শয়তান
না, নিশ্চয়ই
কোন প্রাণীর আদল থেকে,
মানুষের সাথে তার
সংঘর্ষময় ইতিহাস থেকে হাজার
হাজার বছর ধরে ডাল-পালা
গজিয়ে বিশাল মহীরুহতে পরিণত
হয়েছে ইয়েতির গল্প।
বিজ্ঞানীরা
দাবি করেছিলেন, তারা
এই রহস্যঘেরা তুষারমানবের
অস্তিত্ব উদ্ধার করতে সক্ষম
হয়েছেন।জেনেটিক পরীক্ষার
মাধ্যমে ‘ইয়েতি’ র অস্তিত্ব
প্রমাণ করেছেন বিজ্ঞানীদের
একটি দল। তারা পরীক্ষার মাধ্যমে
বের করেছেন, প্রাচীন
মেরু ভালুক বা পোলার বিয়ার
(আকর্টিক সাগরে
ঘেরা আকর্টিক সার্কেলে বাসকরা
মাংসাশী ভালুক) ও
বাদামি ভালুকের যৌথ মিলবন্ধন
রয়েছে এ প্রাণীর মধ্যে।
ইয়েতির সংগৃহীত চুলের নমুনা
পরীক্ষা করে দেখা গেছে,
বংশগতভাবে (জেনেটিক্যালি)
১ লাখ ২০ বছর আগের
প্রাচীন পোলার ভালুকের সঙ্গে
সাদৃশ্য পাওয়া গেছে।
বছরের পর বছর
গবেষণা চালিয়ে ও ডিএনএ টেস্টের
মাধ্যমে এই তথ্য প্রমাণ করেছেন
বিজ্ঞানীরা। অক্সফোর্ড
বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান
জেনেটিক্সের অধ্যাপক ব্রিয়ান
সিকেস এ গবেষণা চালিয়েছেন।
অধ্যাপক
ব্রিয়ান সিকেসের মতানুসারে
ফলাফলটি একেবারেই অপ্রত্যাশিত।
তিনি বলেন,প্রাচীন
পোলার ভালুকের উপস্থিতির
বিষয়টি জানা গেলেও তারা এখনও
হিমালয়ে ঘুরছে কিনা তা বোঝা
যায় না। অধ্যাপক সিকেস জানান,
উপ-প্রজাতির
বাদামি ভালুক হিমালয়ের ওপরে
থাকতে পারে। পূর্বপুরুষ মেরু
ভালুক থেকে বাদামি ভালুকের
উৎপত্তি হতে পারে। এমনকি
বাদামি ভালুক ও প্রাচীন মেরু
ভালুকের বংশধরদের মেলামেশায়
সংকরজাতের হতে পারে এ উপ-প্রজাতির
ভালুক। অধ্যাপক সিকেস হিমালয়ের
উচু অঞ্চলের গ্রামের স্থানীয়দের
কাছে ইয়েতি নামে পরিচিত দুটি
প্রাচীন প্রাণীর চুলের নমুনা
পরীক্ষা করেছেন। এদের একটি
ভারতের লাদাখ ও অন্যটি ভুটানে
পাওয়া গেছে। প্রাণী দু’টির
নমুনা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল
জেনব্যাংক ডাটাবেজে সংরক্ষিত
অন্যান্য প্রাণীর জেনোমের
সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি
দেখতে পেয়েছেন, তার
সংগৃহীত নমুনা নরওয়ের সালবার্ডে
প্রাপ্ত প্রাচীন মেরু ভালুকের
চোয়ালের হাড় থেকে প্রাপ্ত
ফলাফলের সঙ্গে হুবহু মিলে
গেছে।
অক্সফোর্ড
বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান
জেনেটিক্সের অধ্যাপক ব্রিয়ান
সিকেস এ গবেষণা চালিয়েছেন।
বছরের পর বছর ধরে পর্যাপ্ত
পরিমাণে ইয়েতির শারীরিক প্রমাণ
সংগ্রহ করেছেন। হিমালয়ের
গায়ে রহস্যময় ‘বিগফুটের’
বৈজ্ঞানিক ব্যাখা দেয়ার জন্য
এগুলোর অত্যাধুনিক ডিএনএ
টেস্টেও করা হয়েছে।
এদের একটি ভারতের
লাদাখ ও অন্যটি ভুটানে পাওয়া
গেছে। এ দুই প্রাণীর নমুনা
থেকে প্রাপ্ত ফলাফল জেনব্যাংক
ডাটাবেজে সংরক্ষিত অন্যান্য
প্রাণীর জেনোমের (বংশগতি
সম্পর্কিত তথ্য) সঙ্গে
তুলনা করেছে। অধ্যাপক সিকেস
দেখতে পেয়েছেন, তার
সংগৃহীত নমুনা নরওয়ের সালবার্ডে
প্রাপ্ত প্রাচীন মেরু ভালুকের
চোয়ালের হাড় থেকে প্রাপ্ত
ফলাফলের সঙ্গে হুবহু মিলে
গেছে।
এছাড়া ইয়েতি
বলে দাবি কর হয়েছে এমন ৯টি
নমুনার জেনেটিক সিকোয়েন্স
বা বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষন করে
দেখা গেছে তাদের বেশীর ভাগই
হচ্ছে হিমালয়ে বাস করা বিভিন্ন
ভাল্লুকের প্রজাতি। ৯টি নমুনার
মধ্যে ৫টি তিব্বতি বাদামি
ভাল্লুক, ২টি
হিমালয়ের বাদামি ভাল্লুক এবং
১টি নমুনাকে এশিয়ার কালো
ভাল্লুক হিসেবে সনাক্ত করা
হয়েছে।
উল্লেখ্য,
রেইনহোল্ড মেসনার
মাউন্টেইন মিউজিয়ামের সংগ্রহে
থাকা একটি স্টাফ করা ইয়েতির
দাঁতের অংশ পরীক্ষা করে জানা
গেছে সেটি আসলে একটি কুকুরের
দাঁত।
২০১৪ সালে
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের
জেনেসিস্টদের চালানো গবেষণায়
দাবী করা হয়েছিল ইয়েতির নমুনা
গুলোর সাথে প্রাগৌতিহাসিক
মেরু ভাল্লুকের জিনের মিল
আছে।
৩ বছর পর
নিউ ইয়র্ক স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে
ভাল্লুকের জিনত্বত্ত নিয়ে
অধ্যায়নরত শার্লট লিন্ডভিস্ট
আবার পূর্বের গবেষণাটির উপর
নতুনভাবে আলোকপাত করে মেরু
ভাল্লুকের সাথে হিমালয়ের এই
অঞ্চলে বাস করা ভাল্লুকদের
সম্পর্ককে নাকচ করে দেন।
শার্লট লিন্ডভিস্ট
ও রবার্ট সাইক্স দুজনই ‘আইকন
ফিল্মস’ নামক এক ব্রিটিশ
টেলিভিশন প্রোডকশন কোম্পানির
আহ্বানে এই দুটি গবেষণা পরিচালনা
করেন। দুটি গবেষণার কার্যক্রম
নিয়ে টিভি সিরিজ তৈরী করা হয়।
২০১৬ সালে লিন্ডভিস্টের গবেষণা
কর্মের উপর নির্মিত তথ্যচিত্র
অ্যানিমেল প্লানেটে “Yeti
or Not” নামে প্রচারিত
হয়।
পূর্বের
গবেষণাটির ব্যাপারে লিন্ডসিস্ট
বলেন, ‘আগের গবেষণায়
খুবই ক্ষুদ্র মাইটোকন্ড্রিয়াল
জেনোম ব্যবহার করা হয়েছিল।
তাই যথাযথ ফলাফল পাওয়া যাইনি।
কিন্তু এই গবেষণা থেকেই বোঝা
গিয়েছিল তথাকথিত ইয়েতির সাথে
ভাল্লুকের অবশ্যই একটা সম্পর্ক
আছে’।
নতুন এই
গবেষণায় দাবি করা হয়েছে,
প্রায় সাড়ে ৬ লক্ষ বছর
আগে উত্তর আমেরিকা ও ইউরেশিয়া
থেকে নেমে আসা একদল বাদামি
ভাল্লুক থেকে হিমালয়ের বাদামি
ভাল্লুক প্রজাতি আলাদা হয়ে
গিয়েছিল। অন্যদিকে তিব্বতের
বাদামি ভাল্লুক প্রজাতির
উদ্ভব ঘটেছে প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ
বছর আগে।
প্রায় দেড়
বছর ধরে চলা এই গবেষণা থেকে
আরো জানা যায়, তিব্বতে
বাস করা বাদামী ভাল্লুক ও
হিমালয়ে বাস করা বাদামি
ভাল্লুকের মধ্যে যথেষ্ট
পার্থক্য রয়েছে। হিমালয়ের
দূর্গমতাই এই দুই প্রজাতির
মধ্যে কোন রকম সম্পর্ক স্থাপন
করতে দেয়নি।
গবেষকরা
আশা প্রকাশ করেন তাদের এই
গবেষণার ফলে তিব্বত ও হিমালয়ের
দূর্গম অংশে বসবাস করা
বিলুপ্তপ্রায় এই প্রানী গুলোকে
রক্ষায় সকলের দৃষ্টি আকর্ষনে
সক্ষম হবে।
অক্সফোর্ড
বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনতাত্ত্বিকরা
বলছেন, ইয়েতি
বা এ ধরনের প্রাণীর দাবি নিয়ে
এর আগেও ডিএনএ পরীক্ষা হয়েছে।
কিন্তু এখন কোনো প্রাণীর
অস্তিত্ব প্রমাণের কৌশল আগের
চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। বিশেষ
করে, চুল
পরীক্ষার ক্ষেত্রে আধুনিক
ফরেনসিক সায়েন্সের কল্যাণে
পরীক্ষা কৌশলের ব্যাপক উন্নয়ন
ঘটেছে। আধুনিক পরীক্ষা পদ্ধতি
চুলের একটি অংশ থেকে ইয়েতি
বা এমন প্রাণীর অস্তিত্বের
ব্যাপারে যথাসম্ভব সঠিক ফলাফল
উপহার দিয়ে এই বহু প্রাচীন
রহস্যের কূলকিনারা করতে পারবে
বলে আশা করা হচ্ছে।
হিমালয়ের এই
কিংবদন্তীর প্রাণীটাকে নিয়ে
যে কতো গবেষণা আর জল্পনা-কল্পনা
করা হয়েছে! কিন্তু,
মজা কি জানেন?
এই ইয়েতিরা আসলেই
আছে কি নেই এ ব্যাপারে কিন্তু
কখনোই নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
হবেটাই বা কী ভাবে? ওদেরকে
যে এখনো সেভাবে দেখা-ই
যায়নি! আর
বিজ্ঞানীরাও ওদের ব্যাপারে
একমত হতে পারেননি। কোনো বিজ্ঞানী
বলেন, ইয়েতিরা
অবশ্যই আছে। নইলে অমন বড়ো
বড়ো পায়ের ছাপ এলো-ই
বা কোত্থেকে? আবার
অন্য বিজ্ঞানীরা বলেন,
েসব গাঁজাখুরি
গল্প। তবে, ইয়েতি
যে আছে, এটা
যেমন এখনো প্রমাণ করা যায়নি,
তেমনি যারা বলে
ইয়েতি নেই, ওসব
ফালতু গল্প, তারাও
কিন্তু খুব একটা নিশ্চিত হয়ে
বলতে পারেন না যে ইয়েতিরা
আসলেই নেই। ইয়েতি যদি সত্যি
সত্যিই না থাকে, তাহলে
এত দিন হয়ে গেলো,
তবু ওদের গল্প শেষ
হচ্ছে না কেন বলো তো?
সেটাইতো কথা!
ইয়েতিরা আসলেই
আছে, নাকি
মৎসকন্যাদের মতো ইয়েতিও
প্রাচীন মানুষের এক অমর কল্পনা
তার সমাধানের আশায় রইলাম।
No comments:
Post a Comment