ঘুমানোর আগে
ছেলেবেলায় এই
ছড়াটি প্রচুর শুনেছি
, এর
আরও বড় অংশ খুজে পেলাম -
ছেলে ঘুমালো, পাড়া
জুড়ালো
বর্গী এল দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কিসে।।
ধান ফুরল, পান ফুরল
খাজনার উপায় কি?
আর ক’টা দিন সবুর কর
রসুন বুনেছি।।
ধনিয়া পিয়াজ গেছে পচে
সর্ষে ক্ষেতে জল
খরা-বন্যায় শেষ করিল
বর্ষ এর ফসল।
ধানের গোলা, চালের ঝুড়ি
সব শুধু খালি
ছিন্ন কাপড় জড়িয়ে গায়ে
শত শত তালি
ধানের গাছ, বিলের মাছ
যাই কিছু ছিল
নদীর টানে বাঁধটি ভেঙ্গে
সবই ভেসে গেল।
এ বারেতে পাঁচ গাঁয়েতে
দিয়েছি আলুর সার
আর কটা দিন সবুর করো
মশাই জমিদার।
বর্গী এল দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কিসে।।
ধান ফুরল, পান ফুরল
খাজনার উপায় কি?
আর ক’টা দিন সবুর কর
রসুন বুনেছি।।
ধনিয়া পিয়াজ গেছে পচে
সর্ষে ক্ষেতে জল
খরা-বন্যায় শেষ করিল
বর্ষ এর ফসল।
ধানের গোলা, চালের ঝুড়ি
সব শুধু খালি
ছিন্ন কাপড় জড়িয়ে গায়ে
শত শত তালি
ধানের গাছ, বিলের মাছ
যাই কিছু ছিল
নদীর টানে বাঁধটি ভেঙ্গে
সবই ভেসে গেল।
এ বারেতে পাঁচ গাঁয়েতে
দিয়েছি আলুর সার
আর কটা দিন সবুর করো
মশাই জমিদার।
কারও কারও নিশ্চয় মনে
হয়েছে, এই
বর্গি কারা? তাদের
এত ভয় পাওয়ার কী আছে?
মনে হত এরা
কি কোন দৈত্য-
দানব?
কিন্তু হাজার
প্রশ্ন করেও কারও কাছে সঠিক
তথ্যও পেতাম না।
ইতিহাসের পৃষ্ঠা
উল্টিয়ে জানতে পারলাম,
বর্গীরা
আসলে মারাঠা জাতির
এক গোষ্ঠী এবং তারা
কথা বলে মারাঠী ভাষায় ।
মারাঠি ধনগর জাতীয়
লোকেরা অভিযানে যাওয়ার সময়
কেবলমাত্র একটি সাত হাত লম্বা
কম্বল ও বর্শা নিয়ে বের হত।
এই বর্শাকে মারাঠি ভাষায়
বলা হত ‘বরচি’। এই নাম থেকেই
ধনগররা ‘বারগির’ বা ‘বর্গা’
ধনগর বা ‘বর্গি’ নামে পরিচিত
হয়।
আবার অন্য এক
মতানুসারে বর্গি শব্দটি মারাঠি
বারগির শব্দের অপভ্রংশ। বারগির
বলতে মারাঠা সাম্রাজ্যের সেই
সব অশ্বারোহীদের বোঝাত। বর্গি
শব্দটা এসেছে ফারসি ‘বারগিস’
থেকে, যেটার
অর্থ ‘প্রাচীন মারাঠা যোদ্ধা’।
হাতে তাদের থাকত তীক্ষ্ণফলা
বর্শা। মারাঠাদের আসল নিবাস
ভারতের মহারাষ্ট্র শহরে হলেও
দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতজুড়েই
কিন্তু তারা ছড়িয়ে। আলিবর্দি
খাঁ যখন বাংলার সিংহাসনে,
সে সময় দিল্লির
ক্ষমতায়
ছিল মোগলরা। সে সময় এই মারাঠাদের
যোদ্ধা হিসেবে নামডাক ছিল।
পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মোগলদের
সঙ্গে মারাঠাদের ভয়ংকর যুদ্ধ
হয়েছিল। এই মারাঠাদের কিছু
পথচ্যুত সেনাই একসময় পরিচিত
হয়ে যায় বর্গি নামে। ভারতজুড়েই
তারা শুরু করে তাণ্ডব।
বাংলায় তখন
চলছে আলিবর্দি খাঁর যুগ।
আলিবর্দি খাঁ,
যে বাংলার
শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা,
সেই সিরাজউদ্দৌলার
পিতামহ
হলেন এই আলিবর্দি খাঁ। তার
রাজত্বে বাংলার মানুষের অভাব
হয়তো ছিল, কিন্তু
অশান্তি ছিল না তেমন। কিন্তু
একদিন হঠাৎ করেই বাংলার আকাশে
দুর্যোগের ঘনঘটা!
কথা নেই, বার্তা
নেই, একদল লুটেরার
উৎপাত শুরু হয়ে গেল মুর্শিদাবাদের
গ্রামগুলোতে। রাতের আঁধারে
একদল লোক ঘোড়া টগবগিয়ে
হানা দিতে থাকল।
মুর্শিদাবাদ নগরে বাস
করত জগৎ শেঠ নামে এক ধনী সওদাগর
। বর্গীরা তার কাছ থেকে ৩ লক্ষ
টাকা আদায় করে নেয়। তারা গ্রামের
পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে থাকল,
লোকজনকে মেরে-ধরে
সবকিছু কেড়ে নিতে থাকল।
দোকানপাট সব তাদের অত্যাচারে
বন্ধ হয়ে গেল, মানুষজন
ভয়ে ঘর থেকে বেরুনো বন্ধ করে
দিল। শান্ত বাংলা যেন হঠাৎ
করেই আতঙ্কের বাংলা হয়ে উঠল।
আলিবর্দি খাঁ
যখন খবর
পেলেন, মুর্শিদাবাদে
এ রকম বর্গিরা আক্রমণ করেছে।
বর্গিদের ঠেকাতে সৈন্যসামন্ত
নিয়ে ৭ মে নওয়াব আলীবর্দী খান
মুর্শিদাবাদ উপস্থিত হন।।
কিন্তু বর্গিরা ছিল ভীষণ
দুর্ধর্ষ। নবাবের বাহিনীকে
ঘিরে রেখে তারা সব রসদের পথ
বন্ধ করে দেয়। সেবার অনেক
কষ্টে বর্গিদের হাত থেকে
নিস্তার পান নবাব।
ততক্ষণে মুর্শিদাবাদের
অনেকটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার
করে বর্গীরা পালিয়ে গেছে আরও
দক্ষিণে।
সেই তাণ্ডবের ঢেউ
বাংলায় এল কীভাবে? এখানেও
একটু ইতিহাস শোনাতে হচ্ছে।
সম্রাট আওরঙ্গজেব
দক্ষিণ ভারতের সামরিক অভিযানের
সময় মারাঠা রাজ্য ক্ষতিগ্রস্ত
হয়, যার ফলে মারাঠা
সৈন্যরা রোষবশত ভারতবর্ষে
মুগল শাসিত প্রদেশ গুলিতে
লুঠপাঠ আরম্ভ করে। সুবা বাংলা
ছিল যার অন্যতম।
আলিবর্দি খাঁর
শ্যালক রুস্তম জং ছিলেন
উড়িষ্যার উপশাসক (নায়েবে
আজম)।রুস্তম
জং কোন এক কারনে বলে
বসেন, তিনি
খাঁ সাহেবের কতৃর্ত্ব
মানবেন
না। তখনকার দিনে যেটা হতো,
এ রকম বিদ্রোহ
করলে যুদ্ধ ছিল একেবারে
অনিবার্য। তো যুদ্ধ হলো,
সেই যুদ্ধে
রুস্তম ভগ্নিপতির কাছে হারও
মানলেন। আলিবর্দি খাঁ তাঁকে
উপশাসকের পদ থেকে সরিয়ে দিলেন।
রুস্তম তখনকার মতো রণেভঙ্গ
দিলেন, কিন্তু
তক্কে তক্কে ছিলেন কী করা যায়।
সেই সময় নাগপুরের রাজা
ছিলেন রঘুজিৎ ভোঁসলে। রুস্তম
ভোঁসলেকে গিয়ে ধরলেন,
উড়িষ্যা তার ফেরত
চাই-ই চাই। ভোঁসলের
সাহাযে্য রুস্তম আবার উড়িষ্যা
দখল করলেন। কিন্তু রুস্তমের
কপালে বেশিদিন সুখ সইল না।
আলিবর্দি খাঁ আবারও রুস্তমকে
হারিয়ে উড়িষ্যা নিজের কব্জায়
নিয়ে নেন। এদিকে সর্বনাশ যা
হওয়ার তা কিন্তু হয়ে গেছে।
বিপথগামী মারাঠা সৈন্য এসে
পড়েছে বাংলায়। সালটা ছিল
১৭৪২। তারা এসেই শুরু করে
দারুণ অত্যাচার। নিরীহ মানুষজনকে
ধরে ধরে মেরে ফেলতে থাকে। এই
বর্গিদের সর্দার ছিলেন ভাস্কর
পণ্ডিত।
আক্রমণ তো আর কমে না।
তারা লুটতরাজ চালিয়ে যেতে
থাকে গ্রামে গ্রামে। আলিবর্দি
খাঁ এবার সৈন্যসামন্ত বাড়িয়ে
তাদের দেশছাড়া করতে আসেন।
কিন্তু বর্গিরা কি এত সহজে
পিছু হটার পাত্র নয়।
মুর্শিদাবাদ থেকে তারা পালিয়ে
যায় দক্ষিণে হুগলিতে। সেখানে
গিয়ে তারা নতুন করে আস্তানা
গাড়ে।
হুগলি জায়গাটি
মুর্শিদাবাদের দক্ষিণে। ১৭৪২
সালের জুলাই মাসে,
অর্থাৎ
মুর্শিদাবাদ আক্রমনের ২ মাস
পর হুগলি জেলায় বর্গীরা একটি
সৈন্য শিবির স্থাপন করে এবং
খাজনা আদায় করতে লাগল।বর্গীদের
অমানুষিক অত্যাচারে তাঁতিরা
বীরভূম থেকে পালিয়ে যায় ।
সপ্তদশ ও অস্টাদশ
শতকে বাংলার রেশমি কাপড়ের
আড়ংগুলি(আড়ং
শব্দটা ফারসি। আড়ং বলতে বড়
আকারের বাজারকে বোঝায়)
ছিল জমজমাট।
বর্গী আক্রমনে আড়ংগুলি লোকশূন্য
হয়ে পড়ে, আড়ংগুলি
খাঁ খাঁ করতে থাকে। বাংলার
অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়তে
থাকে। বাংলাজুড়ে খাদ্যশস্যের
অভাব দেখা দেয়,
ব্যবসা-বানিজ্য
বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। যা হোক।
বর্গীরা খাজনা বা
চৌথ আদায় করতে থাকে
এবং পুবের যশোর জেলা অবধি
বর্গীদের খাজনা আদায় ক্রমেই
স¤প্রসারিত
হতে থাকে। বর্গীদের নির্মম
অত্যাচারে বহু লোক ভিটেমাটির
মায়া ত্যাগ করে গঙ্গার পূর্বাঞ্চলে
( বর্তমান
বাংলাদেশে) চলে
আসে। পূর্বাঞ্চলের বাঙালিরাও
বর্গী লুন্ঠনের শিকার হয়।
কেন?
এবার বাংলার
ইতিহাসের এক বিচিত্র প্রসঙ্গে
আসি। মীর জাফরের আগেও বাংলায়
আরও একজন বিশ্বাসঘাতক ছিল!
বিশ্বাসঘাতক
সেই পাষন্ড লোকটার নাম মীর
হাবিব। পারস্য সেই অভিজাতটি
এক সময় নওয়াব আলীবর্দী খানের
ঘনিষ্ট ছিল ; অথচ,
এই লোকটিই
স্থানীয়
গুপ্তচর
হিসেবে বর্গীদের সাহায্য
করত! বাংলা
সম্বন্ধে খুঁটিনাটি জ্ঞান
ছিল তার। বর্গীরা সে জ্ঞান
প্রয়োগ করে সহজেই বাঙালির
ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত!
১৭৪২ সালের
মাঝামাঝি বাংলা থেকে বর্গীদের
নিমূর্ল করার কঠিন সিদ্ধান্ত
নেন নওয়াব আলীবর্দী । ,
নওয়াবের এ
সিদ্ধান্ত অবশ্য
বাঙালিদের ভালোবেসে
নয়, দিল্লির
প্রাপ্য খাজনায় বর্গীরা ভাগ
বসাচ্ছিল বলেই।
১৭৪৩ সালে
বর্গীরা মেদিনীপুর আক্রমন
করে। নওয়াব আলীবর্দীর নেতৃত্বে
মুগল সৈন্যরা মেদিনীপুরের
দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ৯
ফেব্রুয়ারি দুপক্ষের তুমুল
সংর্ঘষ হয়। নওয়াব আলীবর্দীর
উন্নততর রণকৌশলের ফলে মেদিনীপুর
থেকে বর্গীরা উৎখাত হয়ে যায়।
তবে লাভ হয়নি। ১৭৪৪ সালের
ফেব্রুয়ারি
মাসে বর্গী নেতা ভাস্কর পন্ডিত
আবার বাংলা আক্রমন করে বসে।
আলিবর্দি খাঁ
কম চেষ্টা করেননি তাদের পরাস্ত
করতে। একবার তো কূটকৌশলের
আশ্রয় পর্যন্ত নিয়েছিলেন।
আলোচনা করার জন্য ২১ জন বর্গিসহ
ভাস্কর পণ্ডিতকে আমন্ত্রণ
জানান নিজের তাঁবুতে। আমন্ত্রণ
রক্ষা করতে এলে তাদের ওপর
অতর্কিত আক্রমণ চালায় নবাবের
লোকেরা। ভাস্কর পণ্ডিত মারাও
যান, কিন্তু
লাভের লাভ কিছু হলো না। কিন্তু
এত কিছু করেও বর্গিদের টলানো
যায়নি। পরে রঘুজি ভোঁসলে
নিজেই বাংলা আক্রমণ করেছিলেন।
দুর্ধর্ষ বর্গিরা কিছু সময়ের
জন্য পিছু হটলেও বাংলা ছাড়ল
না, ঘুরে
ঘুরে চালাতে লাগল তাদের
দস্যুবৃত্তি। ১৭৫০ সালের
বর্গীরা আবার বাংলায় হানা
দেয়। ১৭৫১ সালে বর্গী আক্রমনের
তীব্রতা এতই বেড়ে যায় যে
একরকম ‘ত্যাগ’ স্বীকার করেই
কিন্তু ওদের দূর করতে হয়েছে,
এক চুক্তির অংশ হিসেবে
আলিবর্দি খাঁ বর্গিদের হাতে
উড়িষ্যা ছেড়ে দেন। বাংলা
থেকে দূর হয় একটা অভিশাপের।
কিন্তু এই নয় বছরে যে ত্রাস
তারা চালিয়েছিল, সে
জন্য তাদের নামে লেখা লোকগানটা
পাকাপাকিভাবে ঠাঁই পেয়ে যায়
এ অঞ্চলের ইতিহাসেই।
এরপর?
বর্গীদের
কি হল?
আর মাত্র ৬ বছর পর ইংরেজদের করতলগত হয়ে যায় বাংলা । ওদিকে মারাঠা-বর্গীরা মুগলদের পরির্বতে নতুন এই শক্তির মুখোমুখি হতে হয়- যে শক্তিটি মুগলদের চেয়ে সহস্রগুণ চতুর খল ও শক্তিশালী।
আর মাত্র ৬ বছর পর ইংরেজদের করতলগত হয়ে যায় বাংলা । ওদিকে মারাঠা-বর্গীরা মুগলদের পরির্বতে নতুন এই শক্তির মুখোমুখি হতে হয়- যে শক্তিটি মুগলদের চেয়ে সহস্রগুণ চতুর খল ও শক্তিশালী।
বাংলা বরাবরই তার গান,
ধান ও মান নিয়ে তার
নিভৃত শ্যামল কোনায় দুই -বেলা
দুই -মুঠো শাক-ভাত
খেয়ে সুখেশান্তিতে এই কুহকী
জীবন কাটিয়ে দিতে চেয়েছে।
পশ্চিমা লুঠেরারা বারংবার
নির্জনতা প্রিয় বাঙালির শান্তি
কেড়ে নিয়েছে, যুদ্ধের
আগুনে পুড়ে গেছে তার সোনার শষ্যক্ষেত্রটি । আমরা দেখেছি
অস্টাদশ শতকের বর্গীরাই বাংলার
ইতিহাসে নির্মমতম শেষ অধ্যায়
নয়, পশ্চিম থেকে আগত
ব্রিটিশ ও পশ্চিম পাকিস্তানি
শোষন ও গনহত্যা, রাজনীতির ষড়যন্ত্র তখনও বাকি ।
ইতিহাসের এই অমোঘ ধারা এই
ইঙ্গিতই দেয় যে বাঙালির নিজস্ব
একটি রাষ্ট্রের বড়ই প্রয়োজন
ছিল ...
No comments:
Post a Comment