ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে সঙ্গীদের উদ্দেশে সূর্য সেন লিখে গেলেন, ‘আমি তোমাদের জন্য রেখে গেলাম মাত্র একটি জিনিস, তা হলো আমার এটি সোনালি স্বপ্ন। স্বাধীনতার স্বপ্ন। প্রিয় কমরেডস, এগিয়ে চলো। সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।’
অধ্যাপক সতীশচন্দ্র তৎকালীন যুগান্তর দলের সাথে যুক্ত ছিলেন বলে মাস্টারদাকে বিপ্লবী আদর্শে ও বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষা দেন। বিপ্লবী ভাব ধারায় দীক্ষিত সূর্য সেন দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগকে একমাত্র তপস্যা হিসেবে নিয়ে ছিলেন। তাই তিনি বিবাহ-বিরোধী ছিলেন। কারণ মাস্টারদা মনে করতেন, বিবাহিত জীবন তাঁকে কর্তব্য ভ্রষ্ট করবে, আদর্শচ্যুত করবে। কিন্তু পারিবারিক ও আত্মীয় স্বজনের চাপে ১৯১৯ সালে বিয়ে করতে বাধ্য হন। যদিও বিবাহর তিন দিন পর মাস্টারদা বাড়ি থেকে পালিয়ে চট্টগ্রাম শহরে চলে আসেন।
এরপর চট্টগ্রামে আগে থেকে গঠন করা দুই বিল্পবী দল যুগান্তর ও অনুশীলনে যোগ না দিয়ে মাস্টারদা ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে বিপ্লবী অনুরূপ সেন, চারুবিকাশ দত্ত, অম্বিকা চক্রবর্তী, নগেন্দ্রনাথ সেনদের সঙ্গে নিয়ে সতন্ত্রভাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে গোপন বিপ্লবী দল গঠন করেন। এর মধ্যে বিপ্লবী চারুবিকাশ দত্ত তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে অনুশীলন দলের সাথে যুক্ত হয়ে যান। যদিও ১৯২০ সালে গান্ধীজী কর্তৃক অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে অনেক বিপ্লবী এই আন্দোলনে যোগ দিলে কিছুদিন পর মাস্টারদাও যোগ দেন। গান্ধীজীর অনুরোধে এক বছর বিপ্লবী কাজ বন্ধ রাখার পর ১৯২২ সালে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করলে বিপ্লবী দলগুলো আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে।
ব্রিটিশরা তাঁর লাশ বস্তাবন্দী করে দূরসমুদ্রে ফেলে দিয়ে এল। বাংলার মাটিতে কোথাও যেন তাঁর চিহ্ন না থাকে। কিন্তু বিপ্লবী আত্মার যে মৃত্যু নেই। সূর্য সেন এ দেশের নির্যাতিত মানুষের হূদয়ে তাই আজও অমর।
মাস্টারদার পুরো নাম সূর্য কুমার সেন, ডাকনাম কালু। তবে মাস্টারদা নামে সহযোদ্ধাদের কাছে পরিচিত ছিলেন। মাস্টারদা ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় একটি সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম রাজমনি সেন ও মাতার নাম শশী বালা সেন। মাস্টারদারা ছিলেন দুই ভাই ও চার বোন।সূর্য সেন তাঁদের পরিবারের চতুর্থ সন্তান ছিলেন।শৈশবে পিতা মাতাকে হারানোর পর সূর্য সেন কাকা গৌরমনি সেনের কাছে মানুষ হয়েছেন।
ছোট বেলা থেকেই পড়ালেখার প্রতি মনোযোগি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদি স্বভাবের ছিলেন।বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল বড়লাটকে মারার জন্য ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্লচাকী বোমা নিক্ষেপ করেন। বোমা নিক্ষেপের পর প্রফুল্লচাকী ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের মাথায় রিভলবারের গুলি ছুড়ে আত্মহত্যা করেন। এর প্রায় তিন মাস দশ দিন পর ১১ আগস্ট ১৯০৮ ব্রিটিশ সরকার ক্ষুদিরামকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনাও তাকে সেই শৈশবে প্রচন্ড ভাবে মর্মাহত করেছিল।
চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এফ. এ. পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে পাশ করে তিনি সেই কলেজেই বিএ-তে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু তৃতীয় বর্ষের কোন এক সাময়িক
পরীক্ষায় ভুলক্রমে টেবিলে পাঠ্যবই রাখার কারণে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে
বিতাড়িত হন।
১৯১৬ সালে বহররমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে অধ্যায়নরত অবস্থায় কলেজের অধ্যাপক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তীর সান্নিধ্য লাভ করে সরাসরি রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত হন মাস্টারদা।
এরপর ১৯১৮ সালে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বিএ পাশ করে চট্টগ্রামে ফিরে আচার্য্য হরিশ দত্তের জাতীয় স্কুলে শিক্ষাকতা শুরু করার মাধ্যমেই মাস্টারদার কর্মজীবন শুরু। অসহযোগ আন্দোলনের সময় বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে গেলে তিনি দেওয়ানবাজারের বিশিষ্ট উকিল অন্নদা চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত ‘উমাতারা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে’ অংকের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এই সময় বিল্পবী দলের সাথে যুক্ত হয়ে ওঠেন এবং শিক্ষকতা করার কারণে তিনি মাস্টারদা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন বিল্পবী সহযোদ্ধাদের কাছে।
এরপর ১৯১৮ সালে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বিএ পাশ করে চট্টগ্রামে ফিরে আচার্য্য হরিশ দত্তের জাতীয় স্কুলে শিক্ষাকতা শুরু করার মাধ্যমেই মাস্টারদার কর্মজীবন শুরু। অসহযোগ আন্দোলনের সময় বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে গেলে তিনি দেওয়ানবাজারের বিশিষ্ট উকিল অন্নদা চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত ‘উমাতারা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে’ অংকের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এই সময় বিল্পবী দলের সাথে যুক্ত হয়ে ওঠেন এবং শিক্ষকতা করার কারণে তিনি মাস্টারদা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন বিল্পবী সহযোদ্ধাদের কাছে।
অধ্যাপক সতীশচন্দ্র তৎকালীন যুগান্তর দলের সাথে যুক্ত ছিলেন বলে মাস্টারদাকে বিপ্লবী আদর্শে ও বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষা দেন। বিপ্লবী ভাব ধারায় দীক্ষিত সূর্য সেন দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগকে একমাত্র তপস্যা হিসেবে নিয়ে ছিলেন। তাই তিনি বিবাহ-বিরোধী ছিলেন। কারণ মাস্টারদা মনে করতেন, বিবাহিত জীবন তাঁকে কর্তব্য ভ্রষ্ট করবে, আদর্শচ্যুত করবে। কিন্তু পারিবারিক ও আত্মীয় স্বজনের চাপে ১৯১৯ সালে বিয়ে করতে বাধ্য হন। যদিও বিবাহর তিন দিন পর মাস্টারদা বাড়ি থেকে পালিয়ে চট্টগ্রাম শহরে চলে আসেন।
এরপর চট্টগ্রামে আগে থেকে গঠন করা দুই বিল্পবী দল যুগান্তর ও অনুশীলনে যোগ না দিয়ে মাস্টারদা ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে বিপ্লবী অনুরূপ সেন, চারুবিকাশ দত্ত, অম্বিকা চক্রবর্তী, নগেন্দ্রনাথ সেনদের সঙ্গে নিয়ে সতন্ত্রভাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে গোপন বিপ্লবী দল গঠন করেন। এর মধ্যে বিপ্লবী চারুবিকাশ দত্ত তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে অনুশীলন দলের সাথে যুক্ত হয়ে যান। যদিও ১৯২০ সালে গান্ধীজী কর্তৃক অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে অনেক বিপ্লবী এই আন্দোলনে যোগ দিলে কিছুদিন পর মাস্টারদাও যোগ দেন। গান্ধীজীর অনুরোধে এক বছর বিপ্লবী কাজ বন্ধ রাখার পর ১৯২২ সালে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করলে বিপ্লবী দলগুলো আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে।
১৯২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম নগরীর বর্তমান টাইগার পাস এলাকা থেকে মাস্টারদার গুপ্ত সমিতির সদস্যরা প্রকাশ্য দিবালোকে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কারখানার শ্রমিক ও কর্মচারীদের বেতনের ১৭,০০০ টাকার বস্তা ছিনতাই করে নিয়ে যান। ছিনতাইয়ের দুই সপ্তাহ পর গোপন বৈঠক বসলে পুলিশ টের পেয়ে বিপ্লবীদের আস্তানায় হানা দেয়। এসময় পুলিশের সাথে বিপ্লবীদের খন্ড যুদ্ধ হয়, যা “নগরখানা পাহাড় যুদ্ধ” নামে পরিচিত। মাস্টারদা ও অম্বিকা চক্রবর্তীকে রেলওয়ে ডাকাতি মামলা দিয়ে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। যদিও কিছুদিন পর কলকাতা হাইকোর্টের বিচারে তাঁরা দুজন ছাড়া পেয়ে যায়। তৎকালীন সময় বিপ্লবী দলগুলোতে প্রথম দিকে মেয়েদের যোগ দেয়া নিষিদ্ধ ছিল বিভিন্ন কারণে। পরবর্তীতে প্রীতিলতা ও কল্পনাদত্তদের মধ্যে বিপ্লবীর আগুন দেখে মাস্টারদা মেয়েদের দলে যুক্ত না করার নির্দেশ শিথিল করেন। এরপর প্রীতিলতা ও কল্পনাদত্ত যোগ দেন।
এরপর ১৯২৬-এ টেগার্ট হত্যা প্রচেষ্টায় আবারও গ্রেফতার হয়ে মাস্টারদা ১৯২৮ সালে ছাড়া
পান। ১৯২৯ সালে চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯২৮ সালে কলকাতায় নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে চট্টগ্রাম থেকে মাস্টারদাসহ অন্যান্যরা যোগ দেন। তখন নেতাজী সুভাস চন্দ্র বোসের সাথে মাস্টারদার বৈঠক হয়। এর পরের বছর ১৯২৯ সালে মহিমচন্দ্র ও মাস্টারদা চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৩০ সালে মাস্টারদা ও অম্বিকা চট্টগ্রাম আসকার খাঁর দিঘীর পশ্চিম পাড়ে কংগ্রেস অফিসে সশস্ত্র বিপ্লবের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করাকালীন আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেদের দলের নাম পরিবর্তন করে “ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চিটাগাং ব্রাঞ্চ” করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ি কৌশলে একটি দলকে চার ভাগে ভাগ করা হয়। মাস্টারদার দলের সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৫ জন, অম্বিকার ১৫ জন, অনন্ত সিং ও গণেশ ঘোষের ২২ জন এবং নির্মল সেনের ৬ জন। চারটি দল অস্ত্র সংগ্রহ ও বোমা তৈরির কাজ এগিয়ে নিচ্ছিলো।
১৯৩০ সালের সেই ১৮ই এপ্রিল চট্টগ্রাম ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু গুড ফ্রাইডে থাকায় সেদিন ওই ক্লাবে কেউ ছিল না বলে মাস্টারদা ঠিকে করেন পরের মাসের ২৩ সেপ্টেম্বর প্রীতিলতা ওয়েদ্দারের নেতৃত্বে হামলা করা হবে। ২৩ সেপ্টেম্বর প্রীতিলতার নেতৃত্বে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করা হয়। এই আক্রমণে ৫৩জন ইংরেজ হতাহত হয়। গুলিতে আহত প্রীতিলতা দৈহিকভাবে অত্যাচারিত হওয়ার চাইতে স্বেচ্চায়মৃত্যুকে বেচে নিয়ে পোটাশিয়াম সায়ানাইড নামক একটি কঠিন বিশ খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল শুক্রবার রাতে বিদ্রোহের দিন ঠিক করে চারটি দল চার বাড়ি থেকে বের হয়ে একদল ধুম রেল লাইনের ফিসপ্লেট খুলে দেয়। এতে একটি মালবহনকারী ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে যায়। যার কারণে চট্টগ্রামের সাথে সারা দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই সুযোগে একদল টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিস দখল করে ভাংচুর করে, কেউ রেলওয়ে অস্ত্রগার দখল করে পেট্রোল ছড়িয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। ২২ এপ্রিল বিপ্লবীরা জালাবাদ পাহাড়ে অবস্থান করলে ইংরেজ সৈন্যরা তাঁদের আক্রমণ করেন। টানা দুই ঘন্টা যুদ্ধে ব্রিটিশ সৈন্যদের ৭০ জন নিহত হয় এবং বিপ্লবীদের মধ্যে ১২ জন শহিদ হন। এঁরা হচ্ছেন, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনগুপ্ত, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, হরিগোপাল বল, মতিলাল কানুনগো, প্রভাসচন্দ্র বল, শশাঙ্কশেখর দত্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাসগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিনচন্দ্র ঘোষ, এবং অর্ধেন্দু দস্তিদার। জালাবাদ যুদ্ধেরপর মাস্টারদাকে গ্রেফতারের অনেক চেষ্টার পরও ব্যর্থ হয় ব্রিটিশ বাহিনী। কিন্তু বিপ্লবীদের মধ্যে কেউ কেউ ধরা পড়ে আবার কেউ পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। সর্বশেষ পরিকল্পনা অনুযায়ী দামপাড়া পুলিশ ব্যারাক দখল করে আক্রমণে অংশ নেওয়া বিল্পবীরা জাতীয় পতাকা উত্তলন করে। বিপ্লবীরা মিলিটারি কায়দায় কুচকাওয়াজ করে মাস্টারদা সূর্য সেনকে তাঁর আদর্শের সাথে সাহসি নেতৃত্বদানের জন্য সংবর্ধনা প্রদান করেন। ওই সময়ই মাস্টারদা অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন এবং পুরো চট্টগ্রামকে ব্রিটিশ শাসকদের হাত থেকে চারদিন মুক্ত রাখেন।
কিন্তু এরমধ্যে বিপ্লবীদের খাদ্যসংকট দেখা দিল এবং সূর্য সেন সহ অন্যদের কচি আম, তেঁতুল পাতা, কাঁচা তরমুজ এবং তরমুজের খোসা খেয়ে কাটাতে হয়। সূর্য সেন সহ ছয়জন শীর্ষস্থানীয় বিপ্লবীকে ধরার জন্য ইংরেজ সরকার ৫০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষনা করে। জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধে অংশ নিয়ে পলায়ন করতে সক্ষম হলেও পরবর্তীকালে পুলিসের আক্রমণে দুজন শহীদ হন, এঁরা হচ্ছেন অপূর্ব সেন এবং জীবন ঘোষাল।
জালালাবাদ যুদ্ধের পর বিপ্লবী নেতাদের ধরার জন্য রেলস্টেশন, স্টীমারঘাট হতে শুরু করে সব স্থানে অভিযান চলছিলো। বিপ্লবীরা তখন বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে আত্মগোপন করে ছিলো। সূর্য সেন ১৬ জন বিপ্লবীকে নিয়ে ২৪ এপ্রিল রাতে নিজের বাড়িতে আসেন। এর মধ্যে অনন্ত সিং পুলিশের কাছে স্বেচ্ছায় ধরা দেন এবং কয়েকজনকে পুলিশ আটক করে এবং এদের বিরুদ্ধে অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলা শুরু হয়। এ মামলা শুরু হওয়ার পর অসুস্থ অম্বিকা চক্রবর্তী পটিয়া থানার চক্রশালা গ্রামে গ্রেপ্তার হন। অম্বিকা চক্রবর্তী এবং সেসময় গ্রেপ্তার হওয়া অন্য বিপ্লবীদের নিয়ে দ্বিতীয় অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলা শুরু হয়। প্রায় ১৯ মাস বিচারের পর ১৯৩২ সালের ১লা মার্চ অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলার রায়ে অনন্ত সিং, লোকনাথ বল এবং গনেশ ঘোষসহ ১২ জনকে দ্বীপান্তর বাসের আদেশ দেয়া হয়।পরবর্তীতে অপর মামলায় অম্বিকা চক্রবর্তীর প্রাণদন্ডের আদেশ হয় পরে হাইকোর্টে আপিলের রায়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। ১৯৩২ সালের ১৩ জুন রাত ৯টায় পটিয়ার ধলঘাট গ্রামে সাবিত্রী চক্রবর্তীর বাড়িতে তাঁকে ধরার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ক্যামেরনকে গুলি করে সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত পালিয়ে যেতে সক্ষম হন কিন্তু নির্মল সেন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
১৯৩৩ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারী রাতে সেখানে এক বৈঠকে ছিলেন কল্পনা দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী, মণি দত্ত, ব্রজেন সেন আর সুশীল দাসগুপ্ত। ব্রজেন সেনের সহোদর নেত্র সেন সূর্য সেনের উপস্থিতির খবর পুলিশকে জানিয়ে দেয়।রাত প্রায় ১০টার দিকে পুলিশ আর সেনাবাহিনী ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িটি ঘিরে ফেলে। রাতের অন্ধকারে গুলি বিনিময় করে কল্পনা দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী, মণি দত্ত আর সুশীল দাসগুপ্ত পালিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু রাত ২টার দিকে অস্ত্রসহ সূর্য সেন এবং ব্রজেন সেন ধরা পড়েন। তারপর ঐ বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ সূর্য সেনের নিজের হাতে লেখা অর্ধসমাপ্ত আত্মজীবনীর খাতা উদ্ধার করে। সেই খাতার উপর লেখা ছিল “বিজয়া”। বিচারের সময় “বিজয়াতে” লেখা তাঁর কথাগুলো বিপ্লব এবং প্রশাশনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রমান হিসাবে অনেকবার ব্যবহার করা হয়। ১৭ই ফেব্রুয়ারী রাতে সূর্য সেন এবং ব্রজেন সেনকে প্রথমে জেলা গোয়েন্দা সদর দপ্তরে, পরে কোর্ট হয়ে চট্টগ্রাম জেলে নেয়া হয়। সূর্য সেন গ্রেপ্তার হবার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছিল “চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন সম্পর্কে ফেরারী সূর্য সেনকে গত রাতে পটিয়া হইতে ৫ মাইল দূরে গৈরলা নামক স্থানে গ্রেপ্তার করা হইয়াছে। সূর্য সেনকে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের মামলায় প্রধান আসামি বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে। গত ১৯৩০ সাল হইতে সূর্য সেন পলাতক ছিলেন এবং তাঁহাকে ধরাইয়া দিবার জন্য সরকার দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষনা করিয়াছিলেন”।
সূর্যসেন, তারকেস্বরে ও কল্পনা দত্তকে বিচার করার জন্য ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ১২১/১২১এ ধারা অনুযায়ী স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ১৯৩৩ সালের ১৪ই আগষ্ট এই রায় ঘোষণা করা হয়। ট্রাইব্যুনাল সূর্য সেনকে ১২১ ধারায় মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। ওই একই ধারায় তারকেস্বরেও মৃত্যুদন্ড পায়। অন্যদিকে কুমারী কল্পনা দত্তকে ১২১ ধারায় দোষী করে জাবজ্জীবন দন্ডাদেশ করে। মামলার রায় পদানের পর তিন জনের পক্ষে কলকাতা হাই কোর্ট আপিল করলেও ১৪ নভেম্বর হাইকোর্ট পদত্ত রায়ে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল দেয়া দন্ড বহাল রাখে।
এরপর সূর্যসেনকে চট্টগ্রাম কারাগারের কনডেমড সেলের নির্জন কুঠুরীতে রাখা হতো। একজন কয়েদি মেথর সূর্য সেনের লেখা চিঠি ময়লার ঝুড়িতে নিয়ে জেলের বিভিন্ন ওয়াডের্র বন্দী বিপ্লবীদের দিয়ে আসতো। মৃত্যুর আগে জেলে আটক বিপ্লবী কালীকিঙ্কর কাছে পেন্সিলে লেখা বার্তা পাঠান। সেই বার্তায় তিনি লেখেন, “আমার শেষ বাণী- অদর্শ ও একতা”। তাঁর ভাষায়, “ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যে সব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো।”
শেষ দিনগুলোতে জেলে থাকার সময় তাঁর একদিন গান শোনার খুব ইচ্ছা হল। সেই
সময় জেলের অন্য এক সেলে ছিলেন বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী। রাত
১১টা/১২টার দিকে কল্পনা দত্ত তাঁকে চিৎকার করে বলেন “এই বিনোদ, এই বিনোদ,
দরজার কাছে আয়। মাষ্টারদা গান শুনতে চেয়েছেন”। বিনোদ বিহারী গান জানতেন
না। তবুও সূর্য সেনের জন্য রবিঠাকুরের “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে
একলা চলো রে” গানটা গেয়ে শোনালেন।তার বিচারের সময় তার বিরুদ্ধে কোন
প্রত্যক্ষ প্রমাণ উপস্থাপন করতে না পারলেও বিচারক তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত
করেন। ১৯৩৪ সালের ১২-ই জানুয়ারী চট্টগ্রাম জেলে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা
হয়।
সূর্য সেন এবং তারকেশ্বর দস্তিদারকে ব্রিটিশ সেনারা নির্মম ভাবে হাতুড়ী
পেটা করল প্রথমে । হাতুড়ীঘাতে মুখমণ্ডল থেঁতলে গেল তাদের , ভেঙ্গে গেল
সবকটা দাঁত। হাতের নখ উপড়ে তুলে ফেলা হল একের পর এক। হাঁটু থেকে শুরু করে
সমগ্র শরীরের প্রতিটি জয়েন্টে চলল নির্বিচারে আঘাতের পর আঘাত । শরীরের সকল
হাড় ভেঙ্গে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল। এক পর্যায়ে তারা নিস্তেজ হয়ে জ্ঞান
হারালেন। তারপর মৃতপ্রায় শরীর দুটিকে টানতে টানতে , তাদের গলায় বেঁধে দেয়া
হয় হল ফাঁসীর দড়ি । মৃত্যু নিশ্চিত করতে ফাঁসীর মঞ্চে ঝুলে পড়লেন সূর্য সেন
এবং তারকেশ্বর দস্তিদার।
লাশ দুটো জেলখানা থেকে ট্রাকে করে ৪ নম্বর স্টিমার ঘাটে নিয়ে যাওয়া
হল। তারপর তাদেরকে ব্রিটিশ জাহাজ “The Renown” এ তুলে, তাদের বুকে বেঁধে
দেয়া হল লোহার বড় বড় টুকরো। জাহাজ চলে আসল বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগর
সংলগ্ন কোন এক গভীর অভ্যন্তরে। অতল গভীর জলে নেমে গেলেন, সূর্যসেন ও
তারেকশ্বর দস্তিদার।
বাঙালীকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারেনি। কারণ বাঙালী সূর্যসেন, প্রীতিলতা ও তিতুমীরের উত্তরসূরী। আজো আমাদের লড়াই করতে হচ্ছে বাক স্বাধীনতার জন্য, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্য, গণতান্ত্রিক ও শোষণ বৈষম্যহীন সমাজের জন্য। মানবিক পৃথিবী বিনির্মানের লড়াইয়ে মাস্টারদা আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন।