ধারাবাহিক খুনি বা সিরিয়াল কিলার, যারা মানুষের জীবনহানি,সংসারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং আমাদের দুঃস্বপ্নের কারন হয়ে দাঁড়ায়। এইসব পাশবিক দানব গুলির কাহিনী ইতিহাস জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে।
এদের মধ্যে কেউ কেউ অন্যান্যদের থেকেও খারাপ আবার এদের মধ্যে কারোর খুনের পেছনে এমন উদ্দেশ্য বা কারণ রয়েছে যা সত্যিই কৌতুহল জোগায়। এরকমই একটি সিরিয়াল কিলারের ঘটনা আজকে বলবো যে বহু হত্যাকাণ্ড ঘটায়, যদিও তার শিকার এর মধ্যে প্রায় সবাই খুনি নয়তো দুষ্কৃতী।
মানুষটির নাম হল পেদ্রো রডরিগেজ ফিলহো, যার জন্ম 1954 সালে ব্রাজিলের সান্তাড়িতা নামক স্থানে এবং জন্মানোর পর তার মাথার খুলি কিছুটা চ্যাপ্টা দেখা যায় কারণ অন্তঃসত্ত্বা থাকাকালীন তার বাবা তার মাকে লাথি মেরেছিল। ফলে খুব কম বয়সেই সে হিংস্রতার স্বাদ পায়।
এছাড়াও কৈশোর থাকাকালীন প্রায়ই তার পিতা তাকে প্রচুর মারামারি করত হয়তো তার এই হিংস্র জীবনের পেছনে এটির সামান্য অনুদান থাকতে পারে যা তাকে অত্যাচার এবং মৃত্যুর সাথে কিছুটা পরিচয় করে দেয়। যখন তার 13 বছর বয়স ছিল তখন একটি মারপিট চলাকালীন সে তার থেকে বয়সে বড় চাচাতো দাদাকে আখের রস কাটার মেশিনে ঠেলে হত্যা করার চেষ্টা করে; যদিও সে বেঁচে যায় কিন্তু ফিলহো এই সময় প্রথম সাহস পায় এবং শক্তির স্বাদ পায় যেটা সে ভবিষ্যতে প্রয়োগ করতে পারবে তাদের উপর যারা অন্যায় করে। সে অনুভব করে যে সে খুন করার জন্য প্রস্তুত।
এর পরের বছর যখন ফিলহোর বয়স 14 বছর ছিল তার পিতা যিনি স্কুলের গার্ড ছিলেন, তাকে খাবার চুরির অভিযোগে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। যদিও তিনি একজন ভালো পিতা ছিলেন না কিন্তু তিনি চোর ছিলেন না। ফিলহর মনে খুব রাগ হল সে অনুভব করল শহরের মেয়র, যে চাকরি থেকে তার পিতাকে বিতাড়িত করেছিল তার মরে যাওয়া উচিত এবং এরপর ফিলহো বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে পরলো যেটি একটি শটগান ছিল এবং তার সমস্ত হিংস্রতা বের করে টাউনহলে তাকে গুলি করে মারল এবং তারপর সময় নষ্ট না করে সে আসল অপরাধীকে খুন করে মারলো। এই হিংস্র ঘটনাটি আইনের কাছে ফিলহকে অন্যতম খুনি অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করলো এবং তাকে বাধ্য হয়ে দাস ক্রুজেস নামে সাও পাওলোর এক জঘন্য বস্তি এলাকায় আশ্রয় নিতে বাধ্য করলো। এটি ভয়ঙ্কর খুনি, অপরাধী এবং ড্রাগ ডিলার এর মত সমাজের ঘৃণ্য বস্তু গুলিতে ভর্তি এক স্থান যেখানে ফিলহর সঠিকভাবে স্থান হয়ে গেল।
জীবন যাপনের জন্য ফিলহো এরপর থেকে খুন এবং চুরি করতে শুরু করলো, না কোন নিষ্পাপ সাধারণ মানুষদের না, সে ড্রাগ ট্রাফিকার এবং দুষ্কৃতী দলগুলোকে শেষ করতে লাগলো যাদের এটা প্রাপ্য ছিল। কোন ভাবে সে বিয়ে করারও সুযোগ পেয়ে গেল। মারিয়া আপারেসিডা অলিম্পিয়া নামে এক মহিলাকে বিয়ে করে প্রথমবার সে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের স্বাদ পেয়েছিল এবং আবার নতুন করে জীবন শুরু করেছিল এবং অবশেষে মারিয়া সন্তানসম্ভবা হয়েছিল। এই সময় ড্রাগ এবং দুষ্কৃতী দলের সাথে তার সংঘর্ষ বলতে গেলে বন্ধ হয়ে গেছিল, যদিও তারা কিন্তু ফিলহোকে ভুলে যায়নি। তারা মারিয়া এবং তার পেটে থাকা বাচ্চাকে মেরে ফেলে ও অনূর্ধ্ব 18 এর ফিলহোকে হিংস্র প্রতিশোধের পথে আবার নামতে বাধ্য করে। খুব শীঘ্রই এটা প্রমাণিত হয়ে যায় পৃথিবীতে আর যে কেউ হোক ফিলহোর সাথে রেষারেষি করে পার পাওয়া যায় না।
এরপর ফিলহো প্রায় নিয়ম করে ড্রাগ ডিলার এবং দুষ্কৃতী ও গ্যাংস্টারদের এক এক করে তথ্য সংগ্রহ করে যন্ত্রণা এবং মৃত্যু দিতে শুরু করে যা কোন একশন সিনেমা কেও হার মানাতে পারে এবং যখন তার স্ত্রীর মৃত্যু সম্পর্কে সব তথ্য সংগ্রহ করে ফেলে তখন পরিকল্পনামাফিক সে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে ভয়ঙ্কর আক্রমণ করে বসে যেখানে তার স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য দায়ী দুষ্কৃতী দলের নেতা এসেছিল। যখন ফিলহো এবং তার বন্ধুরা লড়াই শেষ করল ততক্ষনে 7 জন দুষ্কৃতী দলের সদস্যের মৃত্যু এবং 16 জন ভয়ংকরভাবে আহত হয়; দিন-দুপুরে এই আক্রমণে ফিলহো তার প্রতিশোধ নিতে সক্ষম হয়।
পুলিশরা এইসময় তাকে ধরার জন্য সেরকম কোন প্রচেষ্টা করল না, কারণ সে সমাজের আবর্জনাগুলো পরিষ্কারেরই কাজ করছিল। তাই পুলিশরা তার ওপর কেবল লক্ষ্য রেখেছিল এবং তাকে দুষ্কৃতী দলগুলোকে একে একে শেষ করতে দিয়ে গেছিল। যদিও সে সীমা অতিক্রম করতে চলেছিল এবং আরো দূরে অগ্রসর হয়ে যেতে শুরু করেছিল।
ফিলহো একের পর এক ড্রাগ মাফিয়া এবং দুষ্কৃতী দলের সাথে একা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। এদিকে তার ছোটবেলার সেই বাড়িতে কম হিংসা চলছিল না। এক রাত্তিরে তার পিতা নেশা করে এসে তার মাকে ছুরি দিয়ে কেটে খুন করে। যখনই ফিলহোর কানে খবরটা গেল, সে তাই করলো যাতে সে শ্রেষ্ঠ ছিল, সে প্রতিশোধ নিতে বেরিয়ে পরলো এবং 1973 সালের মে মাসে সে একটি ছুরি নিয়ে সেই জেলে পৌঁছে গেল যেখানে তার পিতা আটক ছিল। জেলে ঢুকে সে তার পিতার সাথে দেখা করতে চাইলো এবং সেখানে রক্ষী এবং অন্যান্য অপরাধীদের সামনে তাদেরকে হতবাক করে দিয়ে প্রায় 22 বার কুপিয়ে তার পিতাকে হত্যা করলো। ঘটনাটি কেবল এখানেই সীমিত ছিল না এরপরে আরো ভয়ানক মাত্রা পেল যখন ফিলহো তার পিতার হৃৎপিণ্ডটি বের করে আনল এবং তাতে কামড় বসিয়ে একটি টুকরো মুখে নিয়ে নিল।যেহেতু এটা জেলের ভিতর হয়েছিল এবং তার পালানোর কোন জায়গা ছিল না, তাই তাকে গ্রেফতার করা হলো। খবরের সুত্র অনুযায়ী, যখন তাকে অন্যান্য দুজন অপরাধীর সাথে পুলিশের গাড়িতে ভরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, সে জানতে পারে তাদের মধ্যে একজন হল ধর্ষণকারী। ঠিক সেই মুহুর্তে সে সেই অপরাধী কে হত্যা করল এবং অন্য অপরাধী ভয় পেয়ে সাহায্যের জন্য চিৎকার করে উঠেছিল।
ফিলহো দোষী প্রমাণিত হলো এবং তাকে ব্রাজিলের সবচেয়ে কুখ্যাত ও ভয়ঙ্কর কারাগারে পাঠানো হলো এবং এখানেও সে খুব দ্রুত নিজেকে ভয়ঙ্কর খুনি হিসেবে প্রতিষ্টিত করল। কারাগারের দেয়ালের ভেতর অন্যান্য দুষ্কৃতীদের কাছে সে একাই উকিল, বিচারপতি এবং কোতোয়াল ছিল। সে যাকেই অপরাধী হিসেবে গণ্য করতো তাকে নির্মম ভাবে এবং নিয়ম অনুসারে হাতের কাছে যা পেতো তা দিয়ে অত্যাচার করে এবং খুন করে শাস্তি দিত বিশেষ করে ধর্ষণকারী, ড্রাগ ডিলারদের এবং যৌন হেনস্থা কারীদের। জেলের মধ্যে একটি প্রবাদ রটে গিয়েছিল যে ফিলহো হল এমন এক খুনি যে অন্যান্য দুষ্কৃতীদের খুন করতে ভালোবাসে এবং পৃথিবীর এই জেল যাতে বিখ্যাত বহু ভয়ঙ্কর, নির্মম অপরাধীরা থাকতো তারাও তাকে ভয় পেত। জেলের একটি রিপোর্টে জানা গেছে একবার জেলের একদল দুষ্কৃতী তাকে খুন করতে গিয়েছিল; তারা পাঁচ জন মাঠে তাকে আক্রমণ করেছিল এবং স্বভাব অনুসারে তাদের মধ্যে তিনজনকে ফিলহো খুন করে এবং অন্য দুজন দৌড়ে পালিয়ে যায়। এরপর আর কেউ তাকে বিরক্ত করার সাহস পায়নি বরং সকলে যেন ভীতসন্ত্রস্ত ভাবে তাদের পিছনের দিকে খেয়াল রাখা শুরু করেছিল, কারণ কেউই জানত না ফিলহোর পরবর্তী শিকার কে হবে।
2003 সালে যখন তাকে ছাড়া হয়, জানা যায়, ফিলহো কমপক্ষে 47 জন অন্যান্য দুষ্কৃতীদের খুন করে।যদিও এটা প্রমাণ করা খুবই দুষ্কর ঘটনা ছিল কারণ ব্রাজিলের এই ভয়ঙ্কর জেলে প্রায় প্রতিদিন কারোর না কারোর মৃত্যু ঘটে। তাকে আরো চার বছর নজরদারিতে রাখা হয় এবং অবশেষে 2007 সালে সে মুক্তি পায়। ফিলহো এরপর ব্রাজিলের সিয়েরা স্টেটের অন্তর্গত ফর্টালেজা গিয়ে বসবাস করে কিন্তু সেখানেও তাকে তার পুরনো অপরাধ মুক্তি দিল না। তাকে 2011 সালে আবার গ্রেফতার করা হয় দাঙ্গা লাগানোর অভিযোগে যা ভুয়া ছিল। শেষের দিকে এক সময় সে স্বীকার করেছিল যে সে 100 র ও বেশি মানুষকে হত্যা করে কিন্তু তার সাথে এটিও সংযোজন করে যে তারা সকলে খারাপ মানুষ ছিল এবং এটি তাদের প্রাপ্য ছিল। সে বর্ণনা দেয় যে সে এই সকল অপরাধীকে দমন করে কিভাবে সমাজের উপকার করেছিল এবং সমাজের জঘন্যতম আবর্জনা গুলিকে সাফ করতে তার কিরকম রোমাঞ্চ লাগত। এতকিছুর পরেও 2018 সালে ফিলহো, যাকে 'ব্রাজিলিয়ান ডেক্সটার' বলা হয় (আমেরিকান টিভি শো 'ডেক্সটার' থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে যেখানে একজন সিরিয়াল কিলার অন্যান্য সিরিয়াল কিলারদের হত্যা করে) আট বছর বাদে জেল থেকে মুক্তি পায়। এরপর তিনি তার রাস্তা বদল করেন, সমস্যায় জর্জরিত সমাজের কম বয়সিদের কাছে পৌঁছতে থাকেন এবং তাদের অপরাধ জগত ও হিংসা থেকে দূরে রাখার প্রচেষ্টা শুরু করেন। অবশ্যই তাদের খুন করে নয়, তার একটি ইউটিউব চ্যানেল ও আছে।
এটা বলা খুবই কঠিন যে আমরা এই ধরনের অপরাধ কে ছাড় দেব না বন্ধ করি কারণ এগুলি খালি দুষ্ট কে দমন করার জন্যই ঘটেছিল। যদিও এটা অস্বীকার করা যায় না যে ফিলহো এক সম্পূর্ণ অন্যধরনের খুনি ছিল যে সমাজের নিকৃষ্টতমদের চিহ্নিত করতো এবং আপনি তাকে নায়ক না খলনায়ক আখ্যা দেবেন তা আপনার উপর ছেড়ে দিলাম।
No comments:
Post a Comment