Sunday, 19 July 2020

বাস্তব জীবনের নায়ক যারা পৃথিবীকে বাঁচিয়েছিলেন - পর্ব 3 --

খুব কম বৈজ্ঞানিকই নরমান বর্লোগের মত এত পুরস্কার পেয়েছেন এবং বলতে গেলে এতগুলি পুরস্কার এই বাস্তব জীবনের নায়কেরই প্রাপ্য। পৃথিবীতে বিলিয়ন এর ওপর জীবন বাঁচানোর কৃতিত্ব খুব কম বৈজ্ঞানিকই পেয়েছেন।

বর্লোগ আগের দুজনের মতো চাপের পরিস্থিতিতে ঠান্ডা মাথায় মুহুর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে নয়, বরঞ্চ কঠোর পরিশ্রমে পৃথিবীকে বাঁচিয়েছিলেন। বিংশ শতকের শুরুর দিকে আমাদের গ্রহ কৃষিজাত উৎপাদনের পতনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিপদের সম্মুখীন হয়। যদি এই পরিস্থিতির পরিবর্তন না ঘটতো তবে, চারিদিকে বিশাল দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়তো এবং উন্নয়নশীল দেশগুলিতে খুবই ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলত। 'ইউনিভার্সিটি অফ মিনেসোটা'র থেকে স্নাতক হওয়ার পর ফরেস্ট্রি, প্লান্ট প্যাথলজি এবং জেনেটিক্সে ডিগ্রী নিয়ে নরমান বর্লোগ তার কাজ শুরু করেন।

1942 সালে তাকে রকফেলার ফাউন্ডেশনের মেক্সিকোয় অবস্থিত 'ম্যাক্সিকান এগ্রিকালচারাল প্রোগ্রাম' কো-অপারেটিভের বৈজ্ঞানিক হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। তিনি সেখানে 1944 থেকে 1960 সাল পর্যন্ত কাজ করেন। এই সময় যেসকল কৃষকেরা রোগগ্রস্ত এবং গম উৎপাদক শস্য নিয়ে সমস্যায় থাকতো, তিনি তাদের সাহায্য করার উপায় খুঁজছিলেন। তিনি গমের প্রজাতিগুলি নিয়ে গবেষণা করতে থাকেন তিনি এমন একটি প্রজাতি খুঁজছিলেন যা বিভিন্ন পরিবেশে পৃথিবীর যেকোন স্থানে বেড়ে উঠতে পারে। যখন তিনি এরকম কিছু খুঁজে পেলেন না, তিনি একটি তৈরি করে ফেললেন। গ্রাজুয়েট হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যে বর্লোগ একটি রোগ প্রতিরোধী গমের প্রজাতি তৈরি করলেন যেটা অন্যান্য গুলি থেকে অনেক বেশি পরিমাণে এবং ভালোভাবে বেড়ে উঠতে সক্ষম, যারা প্রতিকূল আবহাওয়াতেও টিকে থাকতে পারতো - তার এই কাজ প্রথমদিকের উদ্ভিদের জেনেটিক মিউটেশন সংক্রান্ত আবিষ্কারগুলোর মধ্যে অন্যতম। 

মেক্সিকোতে বর্লোগ সাফল্য পাওয়ার পর ভারতীয় এবং পাকিস্তানী সরকার তাকে সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করে এবং রকফেলার ফাউন্ডেশন এবং ইউনাইটেড নেশন এর 'ফুড এন্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন' এর সহায়তায় তিনি এশিয়া মহাদেশের তার কৃষি বিপ্লবের সূচনা করেন। যেখানে ভারত এবং পাকিস্তান উভয় দেশে সেইসময় প্রচুর পরিমাণে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে খাদ্যশস্যের ঘাটতি দেখা দিচ্ছিল, সেই সময়ে অর্থাৎ 1960 সালে বর্লোগ সেখানে ফসল উৎপাদনের প্রায় 60 শতাংশ বৃদ্ধির জন্য দায়ী ছিলেন। তিনি উভয় দেশকেই কৃষিতে আত্মনির্ভর হতে সাহায্য করেছিলেন।

তার এই নতুন গমের প্রজাতি দিয়ে বর্লোগ উন্নয়নশীল দেশগুলির লাভজনক রপ্তানি, একটি স্থায়ী খাদ্যের উৎপাদন ক্ষেত্র এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধি করতে সাহায্য করলেন। গবেষণায় বলা হয়েছিল যে তিনি এই হস্তক্ষেপ না করলে 1980 সালের মধ্যে কেবল ভারতীয় উপমহাদেশে  বিলিয়নের ওপর মানুষের অনাহারে মৃত্যু ঘটতো যেখানে বর্তমানে এখানে জনবিস্ফোরণ ঘটছে। 

1970 সালে তিনি শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পান। তাকে 'ফাদার অফ গ্রীন রিভলিউশন' বলা হয়। তিনি 'ট্রিটিক্যাল' নামক একপ্রকার গম ও রাই এর শংকর প্রজাতি তৈরি করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে তার এই পদ্ধতি অবলম্বন করে অন্যান্যরা বিভিন্ন নতুন প্রজাতির উচ্চ উৎপাদনশীল ধানের সৃষ্টি করেছিল। তার এই ধরনের কার্য প্রণালী দ্বারা তিনি আরো বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশকে সাহায্য করেছিলেন। পরবর্তীকালে 1960-69 সালে বর্লোগ 'ইন্টার আমেরিকান ফুড ক্রপ' প্রোগ্রামের ডাইরেক্টর হিসাবে কাজ করেছিলেন এবং 1964 থেকে 1979 সালে মেক্সিকো সিটির 'ইন্টারন্যাশনাল মেজ এন্ড হুইট ইমপ্রুভমেন্ট সেন্টারের' ডাইরেক্টর হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন।

বর্তমানে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বাসিন্দা হিসাবে আপনার কেমন লাগছে? আজ  আমরা যে খাদ্য শস্য খেয়ে বেঁচে আছি নিত্যনৈমিত্তিক ভালো-মন্দ যা কিছুই হোক করতে পারছি তার পেছনে এই মানুষটির আবদান কোথাও না আছে ?

No comments:

Post a Comment