নিনজারা ছিল কতকটা আজকের সিআইএ কিংবা অন্য স্পেশাল ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চগুলোর মত। একবিংশ শতাব্দীর স্পাই, শেডি ডিটেকটিভ, স্পেশাল এজেন্টদের পূর্বপুরুষ।
মেজি রেস্টোরেশনের আগে টোকিও র অলি গলিতে রাজত্ব করা নিনজা ক্ল্যান ওনিওয়াবান গ্রুপ, যারা সরাসরি অষ্টম শোগান তকুগাওয়া ইউসিমুনের বানানো ইতিহাসের প্রথম স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সিক্রেট সার্ভিস ও ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি, এদের মূল দায়িত্ব ছিল ফিউডাল লর্ড ও সরকারী আধিকারিকদের উপর কড়া নজর রাখা, মেজি সময়কালে ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে নিনজাদের দৌরাত্ম্য, একসময় নিনজা হয়ে উঠে আঞ্চলিক লিজেন্ড আর প্রবাদের সংমিশ্রন সৃষ্ট রহস্যময় লোকগাঁথা।
নিনজা যোদ্ধাদের উদ্ভবের পিছনে কয়েকজন চিনা সামরিক কর্মকর্তা ও সন্নাসিদের প্রভাব ছিল।
আমরা নিনজা বললেও জাপানে একে শিনোবি বলে, নিনজা শব্দের উৎস দুটি চায়না শব্দ – 'নিন’ ও ‘শা’ , 'নিন’ অর্থ গোপন বা শান্ত বা যারা সহ্য করতে পারে, 'শা’ বলতে বোঝায় ‘ব্যাক্তি’।
অর্থাৎ যে ব্যাক্তি গোপন সিল্পে দক্ষ বা সহ্য করতে পারে।শিনোবি শব্দের অর্থ অনেকটা ‘নিস্তব্ধে ছিনিয়ে নেওয়া’ যা নিনজাদের কাজকর্মের অনেকটাই ধারণা দিয়ে দেয়।
জাপানে নিনজাদের উৎপত্তি হয় ফিউডাল এইজে, তবে তকুগাওয়া এরায় (১৬০০-১৮৬৮) এদের দূর্দান্ত প্রতাপ দেখায় যায়।
আসলে সমস্ত জাপানে সামুরাইদের প্রতিপক্ষ হিসাবে এদের উদ্ভব হয়েছিল। ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে তাইকা পুনর্গঠনের পর এদের উতপত্তি, কারন তাইকা পুনর্গঠনে ভুমির নতুন করে বণ্টন ও নতুন কর চালু হয়। উদ্দেশ্য ছিল এক বৃহৎ ও কেন্দ্রিয় একনায়কতন্ত্র সাশন সৃষ্টি করা। এর ফলে বহু ক্ষুদ্র চাষি জমি বিক্রি করে বর্গা চাষিতে রুপান্তর হয়, এবং অসংখ্য ভূস্বামী বা জমিদার উদ্ভব হয়। এভাবে মধ্য যুগের ইউরোপের মত সামন্ত প্রথার উদ্ভব হয়।
ঐতিহাসিক ষ্টিভেন হায়েস এর মতানুসারে, জাপানের সামুরাই যোদ্ধা ভিত্তিক সামাজিক রাজনৈতিক ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াসরূপ নিনজা যোদ্ধাদের উদ্ভব এবং যারা ছিল যোদ্ধা, অভিবাসী ও কৃষক। অত্যাধিক করারোপ করা, মজুরদের ক্রিতদাসের মত অত্যাচার, শাস্তি দেওয়া যখন মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল, সামুরাইরা যখন নিজেদের আদর্শ ভুলতে বসেছিল, সামন্ত প্রভূর লোভী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিনজা-কৌশলে আক্রমন করা হত। কেননা, নিনজাদের শিকড় প্রোথিত ছিল গ্রামীন দরিদ্র কৃষি সম্প্রদায়ে। ফলে নিনজারা লক্ষ অর্জনে মরিয়া ছিল। তবে সম্ভব হলে এরা বিরোধ এড়িয়ে চলত। যদি লক্ষ অর্জনে রক্তপাত প্রয়োজন না হয় তো রক্ষপাত করত না।
৯০৭ খ্রিস্টাব্দে পতন হয় তাঙ বংশের । এরপর চিন ৫০ বছরের জন্য চিন জুড়ে ব্যাপক অরাজকতা চলতে থাকে। সে সময় বেশ কয়েকজন তাঙ সেনাপতি সমুদ্রপথে জাপানে চলে আসে এবং এরা জাপানের ইগা ও ওকা পাহাড়ে বসতি স্থাপন করে। সঙ্গে এনেছিল নতুন রণকৌশল ও যুদ্ধদর্শন। ষষ্ট শতকে সুন সু নামে একজন চৈনিক সমরবিদ ‘আর্ট অফ ওয়ার’ নামক একটি গ্রন্থ লেখেন। এই বইটি নিনজা সমরকৌশলকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
নবম ও দশম শতকের দিকে চিনা সন্ন্যাসীরাও জাপানে আসতে থাকে । তাদের সঙ্গে ছিল ভেষজ ও যুদ্ধ দর্শন। জাপানের সাধুরা সেসব শেখে। এরাই প্রথম নিনজা গোত্র। এদের যুদ্ধ কৌশলকে বলা হত নিনজুৎসু। এর অন্তর্গত হল অপ্রথাগত যুদ্ধের কৌশল এবং গেরিলা যুদ্ধ। এই নিনজুৎসু থেকেই নিনজাদের যুদ্ধবিদ্যার উদ্ভব হয়েছিল।
নিনজাদের বেশভূষা আর চালচলন রহস্যময়, সিনেমায় নিনজাদের কালো পোশাক দেখালেও রাত্রির অভিযানের জন্য নিনজারা নেভি রঙের পোশাক পরত। আসলে নিনজাদের পোশাক নির্ভর করত অপারেশনের ধরনের ওপর। ছিল তারা বিশেষ মার্শাল আর্ট জানত, যা শারীরিকভাবে প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করতে খুব কার্যকর।
নিনজাদের দক্ষতা নিখুঁত ও নানা ধরনের হত। মার্শাল আর্ট বাদেও নিনজাদের বেঁচে থাকার কৌশল রপ্ত করতে হত। এছাড়া নিনজাদের দর্শন, আবহাওয়াবিদ্যা, মনোবিজ্ঞান, ভূগোল, অভিনয়, গুপ্তচরবিদ্যা এবং সমরবিদ্যাও রপ্ত করতে হত। নিনজারা ধারাল ও তীক্ষ্ন কিছু ধাতব অস্ত্র বয়ে বেড়াত, যেগুলো ব্যবহারে বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন।পরিস্থিতি বুঝে তারা হালকা ও উপযুক্ত অস্ত্র ব্যবহার করত। যেমন উপরে ওঠার যন্ত্র। এছাড়া ব্লেড, চেইন, দড়ি, বিষ ও পাউডার ইত্যাদি সঙ্গে রাখত।নীরবে-নিভৃতে অনেকটা ছায়ার মতো বিচরণ করত তারা। সুযোগ বুঝে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ত শত্রুর ওপর। ‘শুরিকেন’ বলে তারকা আকৃতির একটা ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করত নিনজারা। এটি ছুড়ে মারা হতো। আরও ছিল ‘ফুকিয়া’ বলে পরিচিত ব্লোপাইপ। ফুঁ দিয়ে ব্যবহার করা হতো এই অস্ত্র। কোনো সমস্যা ছাড়াই নীরবে মেরে ফেলতো মানুষকে। এ ছাড়া আরও কিছু নিজস্ব অস্ত্র ছিল তাদের। এসব অস্ত্র ব্যবহারে বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হতো।
তলোয়ারবাজ হিসেবেও নিনজাদের খ্যাতি রয়েছে। এই পারদর্শীতা আর পরিচয়- সবটুকুই থাকতো গোপন। মুখে মুখে নিজেদের শিক্ষা পরের প্রজন্মের কাছে দিয়ে যেত নিনজারা।
নিনজাদের বেশিরভাগ অস্ত্রের অনুপ্রেরণা ছিল নিত্য ব্যবহার করা সামগ্রী, চাষের যন্ত্রপাতি(যেমন কুড়াল, দাঁ, লাঙল, লাঠি) থেকে যার কারন তল্লাসি নেওার সময় যাতে তারা ধরা না পরে ও সাধারন মানুষের মধ্যেই মিশে থাকতে পারে।
জাপানে ইডো যুগে (১৬০৩-১৮৬৮) জাপানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসে এবং সামন্তবাদ অবক্ষয়ের পর জাপানে আধুনিকতা সূচিত হতে থাকে। ফলে নিনজা অধ্যায়েরও সমাপ্তি ঘটে।তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত জানার মতো তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে খুব সামান্য। এ কারণে নিনজাদের নিয়ে কল্পকাহিনি ডালপালা বেশি ছড়িয়েছে। যদিও আজও কমিক বইয়ে কি চলচ্চিত্রে নিনজারা বহাল তবিয়তেই টিকে রয়েছে।
নিনজাদের জীবনধারা ছিল মূলত সামুরাইদের ঠিক বিপরীত, সামুরাইরা যেমন সুস্পষ্ট কোড বুশিডো মেনে সম্মানের সাথে জীবনযাপন করত আর যুদ্ধক্ষেত্রে সামনের সারিতে ঝাঁপিয়ে পড়ত, নিনজাদের নির্দিষ্ট কোন সিস্টেম ছিল না, উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যেকোন ধরণের অসদুপায়-নিকৃষ্ট কাজ করতে তাদের বিবেকে বাধত না, বেসিকেলি তাদের বিবেক বলতেই কিছু ছিল না। এ কারণে মূলতঃ এসাসিনেশন, স্যাবোটাজ, স্পাইয়িং এদের মূল কাজ ছিল।
তৎকালীন শাসকদের জন্য কম কষ্টে, বিনা অযুহাতে প্রতিপক্ষ কিংবা শত্রুকে নীরবে ধ্বংস করার এমন মাধ্যম খুব আকর্ষণীয় ছিল, তাই নিনজারা হয়ে উঠেছিল অত্যন্ত জনপ্রিয় আর প্রভাবশালী।
শুরুতে বিচ্ছিন্নভাবে শুরু করলেও ১৪ শতকের দিকে নিনজারা ধীরে ধীরে সঙ্গবদ্ধ হতে শুরু করে, ফলে ধীরে ধীরে সূচনা হয় বিখ্যাত নিনজা ক্ল্যান ইগা আর কোগা ক্ল্যানের, অন্য নিনজাদের সাথে এদের অনেক পার্থক্য ছিল, এরা ছিল ডেডলি, শক্তিশালী প্রফেশনাল নিনজা, ১৪৮০ থেকে ১৫৮০ সালের দিকে ফিউডাল লর্ডদের মাঝে বিভিন্ন কাজে এদের চাহিদা ছিল অত্যন্ত বেশি, মূলতঃ গুপ্তহত্যা আর এসপিওনাজের জন্য। কিন্তু এমন গুপ্তহত্যার চেষ্টা তাদের কাল হয়ে দাঁড়ায়, বিখ্যাত সামুরাই লর্ড নবুনাগাকে হত্যার চেষ্টা করায় ক্ষিপ্ত হয়ে নবুনাগা তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেন।
নিনজাদের রহস্যময় সুপারহিউম্যান টেকনিক আর স্কিল সম্পর্কে প্রচলিত আছে অনেক গুজব আর উপকথা, বলা হয় তারা অদৃশ্য হতে পারত, নিজের রেপ্লিকা তৈরী করতে পারত, বিভিন্ন প্রাণি কিংবা অন্য মানুষের বেশ নিতে পারত, নিয়ন্ত্রণ করতে পারত আগুন, পানি, বাতাস। তবে এসবকিছুর কোন সুনির্ধারিত দলিল নেই। সে যাইহোক, নিনজারা ‘নিনজুৎসু’ (দ্যা আর্ট অব স্টিলথ) নামক বিশেষ মার্শালআর্ট চর্চা করত, কঠোর সাধনার মাধ্যমে তারা এমন সব করতে পারত যা পারতপক্ষেই সাধারণের চিন্তার অনেক উর্ধ্বে। এই নিনজুতসু মূলত জাপানের রহস্যে ঢাকা ধর্ম ‘শিন্তো’, বুদ্ধ সেইজআর্ট আর চাইনিজ মার্শালআর্ট থেকে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে।
খুব গোপন আর রহস্যময় একটি ব্যাপার হওয়ায় মানুষ নিনজাদের সম্পর্কে নানারকম কথা ভেবে নিয়েছে, তাদেরকে সাজিয়েছে মনের মাধুরী দিয়ে। বর্তমানে সেই পুরনো নিনজারা আর নেই। হাতে গোনা কয়েকজন নিনজা জাপানে টিকে ছিল কয়েক বছর আগেও। তবে বর্তমানে জিনছি কাওয়ামিকেই একমাত্র জীবিত নিনজা বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে।
নিনজা রহস্যের মূল ব্যাপার হল, তাদের মানুষকে অবাক করে দেওয়ার পদ্ধতি। একজন মানুষকে তার শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতাগুলো ব্যবহার করে বোকা বানানো নিনজাদের আসল কাজ। এমন সব স্থানে গিয়ে লুকানো যেগুলো কখনোই মানুষের মাথায় আসবে না - নিনজাদের একটি কৌশল। শত্রুর মন অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া, শত্রুর এত কাছে চলে যাওয়া যেখানে শত্রু আপনাকে কখনো দেখবেই না- এই কৌশলগুলো তাদেরকে অন্য যোদ্ধাদের থেকে আলাদা করে চিহ্নিত করে।
বর্তমানে একটি জাদুঘর তৈরি করেছেন জিনছি কাওয়াকামি। কেই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি নিনজাদের ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছেন । সেখানেই একটি গবেষণা চালাচ্ছেন কাওয়াকামি। তার মতে, নানারকম চলচ্চিত্র আর লেখায় সবসময় নিনজারা একটু নেতিবাচকভাবেই প্রকাশ করা হ। কথায় কথায় রক্তারক্তি, খুনোখুনি, প্রতারণা এসবের মিশেলে সবাই কাল্পনিকভাবে সাজিয়েছেন নিনজাকে। তবে বাস্তবে নিনজাদের কাছে কাউকে খুন করা বা আঘাত করা ছিল সবচাইতে নিচু কাজ। কয়েকটি স্তরে যদি নিনজাদের দায়িত্ব ভাগ করা হয়, তাহলে মারামারি ছিল তার সবচাইতে নিচের ধাপে।
সাধারণত মারামারি, প্রতারণা ইত্যাদির চাইতে গোয়েন্দা হিসেবে শত্রুপক্ষের কোনো তথ্য এনে দেওয়াকেই সবচাইতে সম্মানীয় কাজ মনে করতো নিনজারা। অনেকদিন না খেয়ে, অনেক দূরের রাস্তায় কোনো বিরতি না দিয়ে চলা, দুরগম জায়গায় পৌঁছানর মতন কষ্টের কাজগুলোর জন্য মানানসই ছিল নিনজারা। বর্তমানে অবশ্য বেশিরভাগ মানুষের চোখে নিনজাদের এই ইতিবাচক দিকগুলো ফুটিয়ে তোলা হয় না।
মোট কথায় বলা যায়, নিনজারা মোটেই আর্থিক দিক দিয়ে নিনজা হওয়ার উপরে নির্ভর করতো না। কারণ এ কাজে তেমন কোনো আর্থিক সুবিধা পাওয়া যেত না। ফলে দিনের বেলায় তাদের জীবিকার তাগিদে নানাবিধ কাজ করতে হতো। যোদ্ধা, কৃষক, ব্যবসায়ী সব পেশার মানুষের মধ্যেই নিনজা লুকিয়ে ছিল এমনটা মনে করা হয়।