Saturday, 8 September 2018

বেনিংটন ট্রায়াঙ্গল - এক ভৌতিক অরণ্য

বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের নিয়ে পৃথিবীতে কম বিতর্ক তো হয় নি। সত্যিকার অর্থে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মাঝে আসলে কি আছে বলা মুশকিল। কিন্তু এমন স্থান পৃথিবীতে কেবলমাত্র একটি নয়।বেনিংটন ট্রায়াঙ্গল, ভারমন্ট, ইংল্যান্ড।বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের কথা আমরা শুনে আসলেও এই বেনিংটন ট্রায়াঙ্গলের ঘটনা আরো বেশি ভয়াবহ যেখানে ভিন্ন গ্রহের যান, অদ্ভুত আলো, শব্দ, গন্ধ ও অদ্ভুত প্রাণী দেখা যাওয়ার ঘটনা তো আছেই। সেই সাথে আছে মানুষের অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ঘটনাও।


এমন একটি বন যেখানে কেউ প্রবেশ করলেই রহস্যময়ভাবে অদৃশ্য হয়ে যায়। অনেকে উন্মাদে পরিণত হয়, অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে বা শব্দ শুনতে শুরু করে। তাদের কোন চিহ্নই পাওয়া যায় নি,ঠিক যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছেন তারা। এই ঘটনা নিয়ে তৈরি হয়েছে সিনেমা, লেখা হয়েছে বই।
১৯৯৯ সালে মুক্তি পাওয়া এদুয়ার্দো স্যানচেজ ও ড্যানিয়েল মিরিক পরিচালিত আমেরিকান ভৌতিক মুভি The Blair Witch Projectর মূল কাহিনী এই ভয়াবহ স্থান ও সেটাকে ঘিরে ঘটে যাওয়া রহস্যময় ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে । কাহিনীটি একটি বনকে ঘিরে, যেখানে কেউ প্রবেশ করলেই রহস্যময়ভাবে অদৃশ্য হয়ে যায়। অনেকে আবার উন্মাদে পরিণত হয়, অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে বা শব্দ শুনতে শুরু করে।

ভারমন্টের গ্রিন মাউন্টেনে টানা ৬ বছর (১৯৪৫-১৯৫১) যাবত এই রহস্যময় স্থানে কমপক্ষে ১০ জন ব্যক্তি রহস্যময়ভাবে উধাও হয়ে গিয়েছেন।  তাদের কোন চিহ্নই পাওয়া যায় নি, যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছেন তারা। এগুলোর জন্য কখনো রহস্যময় কোন প্রাণী, কখনো আলোর ঝলকানি ও কখনো আবার ভূতুড়ে ঘটনাকে দায়ী করা হয়। ভারমন্টে বহু বছর ধরে অনেক রহস্যময় ঘটনা ঘটে এসেছে, কিন্তু এই ১০ ব্যক্তির রহস্যময়ভাবে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি সবাইকে হতভম্ব করে দেয়। আর এসব নিয়ে প্রথম বই লিখেন জো সিত্রো প্যারানরমাল গল্প লেখক, নাম Green Mountain Ghosts, Ghouls, and Unsolved Mysteries ।

 জোসেফ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই স্থানের নাম দেন ‘বেনিংটন ট্রায়াঙ্গল’।

১৮৯২ সালে এলাকাটির রহস্যময়তার প্রথম সূত্রপাত ঘটে বলে অনেকেই মনে করে থাকেন। এ সময় হেনরি ম্যাকডওয়েল নামের এক স্থানীয় মাতাল জিম ক্রাউলি নামের এক কারখানার শ্রমিককে হত্যা করে। বিচারে ম্যাকডওয়েলকে উন্মাদ ঘোষণা করা হয় এবং ওয়াটারবেরি অ্যাসাইলামে পাঠানো হয়, কিন্তু তার আগেই সে জেলখানা থেকে পালিয়ে যায়। তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এর প্রায় ৩০ বছর পর একের পর এক রহস্যময় ঘটনা ঘটতে শুরু করে। ১৯২০ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে বেনিংটন ট্রায়াঙ্গলে ঘটেছিল এমন কয়েকটি নিখোঁজের ঘটনা, যার রহস্যভেদ করা এখনো কোনো সার্চ টিম বা তদন্তকারী কর্মকর্তার পক্ষে সম্ভব হয়নি।


-- প্রথম যে ঘটনায় বেনিংটন ট্রায়াঙ্গল তোলপাড় হয়, তা আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা, ১৯৪৫ সালের ২ নভেম্বরের ঘটনা। ৭৫ বছর বয়সী মিডি রিভার্স নামের একজন গাইড ৪ জন শিকারীকে নিয়ে পাহাড়ে শিকারের উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন। দলটিকে নিয়ে ফিরে আসার সময় লং ট্রেইল রোড ও ৯ নম্বর রুটের কাছাকাছি এসে রিভার্স তার সহযাত্রীদের থেকে সামান্য এগিয়ে যান। এরপর থেকে তার সহযাত্রীরা তার আর কোনো হদিসই পাননি। হঠাৎই ওই জায়গা থেকে তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। পরে স্থানীয় পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকের দল চিরুনি অভিযান চালিয়েও রিভার্সের দেখা তো দূরে থাক, তার দেহ পর্যন্ত খুঁজে পায়নি।তার সহযাত্রীদের কাছে একটাই নিদর্শন ছিল, একটি বুলেট যেটা রিভার্সের কোমর থেকে পড়ে গিয়েছিল যখন তিনি জল খাচ্ছিলেন।

--পরের ঘটনাটি ঘটে প্রায় এক বছর পর। ১৯৪৬ সালের ১ ডিসেম্বর। বেনিংটন কলেজে অধ্যয়নরত পলা ওয়েল্ডেন নামের ১৮ বছরের যুবতী ভ্রমণের নেশায় লং ট্রেইলের উদ্দেশ্যে বেনিংটন ট্রায়াঙ্গলের বনের মধ্যে ঢুকে পড়েন। তার পরিচিত অনেকেই তাকে বনের মধ্য দিয়ে যেতে দেখেছে। কিন্তু সে আর জঙ্গল থেকে কখনো ফিরে আসেনি। ৫০০০ ডলারের পুরষ্কার ঘোষণা ও এফবিআই’র তদন্ত সত্ত্বেও পলাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি।তাকে নিয়ে এমন গুজব ছড়ায় যে, পলা হয়তোবা তার প্রেমিকের সাথে কানাডায় চলে গেছে। আরেকটি ধারণাও তখন বেশ প্রচলিত ছিল, আর তা হচ্ছে প্রকৃতির মাঝে একাকী নিরিবিলি জীবনযাপনের জন্য নির্জন জঙ্গলকে বেছে নিয়েছে পলা। কিন্তু এর সপক্ষে কোনো বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

--- তিন বছর পর।তৃতীয় ঘটনাটি ঘটে, ১৯৪৯ সালের ১ ডিসেম্বর তারিখে। জেমস ই টেটফোর্ড নামের একজন প্রবীণ সামরিক ব্যক্তি তার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা করার জন্য সেইন্ট এলবান থেকে বাসে করে বেনিংটনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। বাসে যাত্রী  ১৪ জন ছিলেন। কিন্তু বাস গন্তব্যস্থলে পৌঁছাবার পর দেখা গেল, জেমস বাসে নেই! বাসযাত্রীদের তথ্যমতে, বাসটি কোথাও যাত্রাবিরতি করেনি। কিন্তু সেইন্ট এলবান থেকে বাস যখন যাত্রা শুরু করে, তখন বাস ড্রাইভারসহ যাত্রীরা জেমসকে তার নির্ধারিত সিটে বসতে দেখেছে। বাস চলা শুরু করলে তিনি তার সিট থেকে একবারও ওঠেননি। আবার কয়েকজন যাত্রী শেষ স্টপেজের আগের স্টেশন পর্যন্ত জেমসকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেছেন বলে জানান। বাসের চালক ও অন্য যাত্রীরা কেউই বলতে পারলেন না জেমস কোথায় হারিয়ে গিয়েছেন। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, জেমসের লাগেজ ব্যাগসহ তার টাকা ভর্তি ওয়ালেটটি তার আসনে পড়ে থাকতে দেখা যায়।

--পরের ঘটনাটি ঘটে পল জেপসন নামের এক আট বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে। ১৯৫০ সালের ১২ অক্টোবর এক সকালের ঘটনা। ৮ বছর বয়সের পল জেপসন প্রায়ই পর্বতের কাছে ঘুরতে যেত।জেপসন ছিল তার মায়ের সাথে, তিনি এ সময় শুকরছানাদের খাবার খাওয়াচ্ছিলেন, আর জেপসন বাড়ির চারপাশে ছোটাছুটি করছিল। ঘণ্টাখানেক পর মা ঘরে এসে দেখেন, জেপসন ঘরের আশেপাশে কোথাও নেই। জেপসনের গায়ে ছিল লাল রঙের জ্যাকেট, দূর থেকেও যা সকলের চোখে পড়ার কথা।সে হারিয়ে যাবার পর পুলিশের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কুকুর তার গন্ধ শুঁকে কিছুদূর যাওয়ার পর তাকে আর খুঁজে পায় না। কিছুদূর গিয়ে যেন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।

--পঞ্চম ঘটনা জেপসনের ঘটনার মাত্র দুই সপ্তাহ পরে অক্টোবরের ২৮ তারিখ।৫৩ বছরের ফ্রিডা ল্যাঙ্গার ও তার ভাই হার্বার্ট এলসনার সমারসেট রিজার্ভেরারের কাছে ক্যাম্পিংয়ের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। হঠাৎই একটি ছোট নদী পার হতে গিয়ে ফ্রিডা পানির মধ্যে পড়ে যান। তার পরনের কাপড়-চোপড় ভিজে যায় , এরপর তিনি হার্বার্টকে একটু অপেক্ষা করতে বলেন। পোশাক পরিবর্তনের জন্য ফ্রিডা ফিরে যান ক্যাম্পে। অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরও তিনি আসছেন না দেখে, হার্বার্ট ক্যাম্পে ফিরে আসেন কিন্তু  ফ্রিডাকে খুঁজে পাননি। এলাকাটি ফ্রিডার কাছে বেশ পরিচিত, ফলে দিনের আলোয় হারিয়ে যাওয়া তার পক্ষে বেশ অসম্ভবই বটে। আবার শুরু হলো ব্যাপক তল্লাশি। দুই সপ্তাহ ধরে নভেম্বরের ৫-১২ তারিখ পর্যন্ত ৩০০ জন অনুসন্ধানকারীর সমন্বয়ে গঠিত ৫টি অনুসন্ধান টিম হেলিকপ্টার, এয়ারক্রাফট থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে তন্নতন্ন করে অনুসন্ধান চালিয়েও ফ্রিডার অস্তিত্ব কোথাও খুঁজে পায়নি।
তবে অদ্ভুত এক ব্যাপার হলো, এই ঘটনার এক বছর পর, ১৯৫১ সালের ১২ মে সমারসেট রিজার্ভের কাছাকাছি এক জায়গায় ফ্রিডার দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু তার দেহ ময়নাতদন্ত করেও মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যায়নি। তবে ফ্রিডাই একমাত্র মহিলা যার মৃতদেহটি খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল।

 কি আছে এই বেনিংটন ট্রায়াঙ্গলে?

ইউরোপীয়দের আমেরিকা আবিষ্কারের অনেক আগে থেকে এই জায়গাটি আদিবাসী আমেরিকানরা সমাধিস্থল হিসেবে ব্যবহার করতো। তাদের ধারণা ছিল এ জায়গাটি অভিশপ্ত হওয়ার কারণে এখানে খারাপ বাতাস প্রবাহিত হয়। এছাড়া এ-ও বলা হতো যে এই জায়গাতে খুব অদ্ভুত একটি পাথর আছে। সেই পাথরের উপর যার পা পড়তো, সেটা তাকেই খেয়ে ফেলতো। প্রাচীন কাল থেকেই থেকে অসংখ্য মানুষ হয় পাগল হয়ে গিয়েছে নয়তো মারা গিয়েছে কিংবা চরম দুর্ভোগে পতিত হয়েছে এই স্থানে প্রবেশ করে।এলাকাটিতে বসবাস স্থাপনকারী প্রথম ইউরোপীয় অধিবাসীদের এক অংশের অভিমত, পাহাড়ের পেছনের আকাশে প্রায় সময়ই এক অদ্ভুত আলোর ঝলকানি দেখা যায়। বাতাসে ভেসে বেড়ায় এক মাদকতাময় গন্ধ আর মাঝে মাঝে শোনা যায় নানা অদ্ভুত ধ্বনি। স্থানীয় কারো কারো মতে, এক বিশাল দৈত্যাকার প্রাণীর বাস রয়েছে জঙ্গলটিতে। এই প্রাণীটির অকস্মাৎ আক্রমণের শিকার হয় অভিযাত্রীরা।

অনেক প্যারানরমাল বিশেষজ্ঞের মতে, স্থানটিতে বাস্তব চেনা ত্রিমাত্রিক জগতের প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটে, যার ফলে কেউ এই জগতে প্রবেশ করতে গেলে সে দিকভ্রান্ত হয়ে হারিয়ে যায়। আবার অনেকের মতে, ভিন্ন গ্রহের প্রাণীদের অবস্থান রয়েছে এই বেনিংটন টায়াঙ্গল জঙ্গলে, তাদের কারণেই ঘটছে এসব অস্বাভাবিকতা। আরেকটি মত হচ্ছে, কোনো সিরিয়াল খুনি বনের মধ্যে বসতি গড়ে আছে, সে-ই এই সব খুনের পেছনে দায়ী। বিষয়টি যদি সত্যি হয়, তাহলে একটি প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়ায়, এতগুলো হত্যাকাণ্ডের কোনো হদিস কেন পাওয়া গেল না। একটি ছাড়া কেন পাওয়া গেলো না আর কোনো মৃতদেহ।

এরপরও এমন কিছু তথ্য এসব অদৃশ্য ঘটনার পেছনে পাওয়া যায়, যেগুলো বেশ রোমাঞ্চকর।

- সবগুলো ঘটনা একটি বিশেষ সময়ে ঘটেছে। শীতের সময় ছাড়া বছরের অন্য সময়ে এমন কিছু ঘটে নি।

- ওয়েল্ডন ও ট্রেডফোর্ড তিন বছরের ব্যবধানে একই তারিখে অদৃশ্য হয়ে যান, যা বেশ কাকতালীয়।

-ফ্রিডা ছাড়া আর কারো কোনো হদিস শেষপর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কিন্তু কীভাবে ফ্রিডা তার তাঁবু থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল, সেটিই একটি রহস্য।

- হারিয়ে যাওয়ার পর অনুসন্ধান দল তন্নতন্ন করে খুঁজেও ফ্রিডার কোনো হদিস পায়নি। অথচ এক বছর পর যে জায়গা থেকে তিনি হারিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানেই তার লাশ পাওয়া যায়, যা এক বড় রহস্য।

১৯৩৭ সালের পূর্বে এলাকাটি বেশ জনবহুল ছিল। কিন্তু ১৯৩৭ সালের দিকে গ্লসটেনবারি শহরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মহামারি দেখা দেয়, ফলে অনেক লোকের মৃত্যু ঘটে। সে সময় নগরটি পরিত্যক্ত হয়। ২০১০ সালের একটি আদশুমারীর তথ্য অনুযায়ী, এই এলাকাটিতে সব মিলিয়ে মাত্র আটজন বাসিন্দা বাস করে। বর্তমানে এটি ভূতুড়ে শহর হিসেবে পরিচিত।


No comments:

Post a Comment