Monday, 30 April 2018

ভয়ংকর স্পার্টান যোদ্ধাদের জীবনের অদ্ভূত বিষয়গুলো--

** এই পোস্টের তথ্যগুলি বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রবাদ, গল্প, তথ্যের ভিত্তিতে লেখা আম্র নিজস্ব অভিমত না **

প্রাচীন কিংবদন্তি এক যোদ্ধা জাতি স্পার্টান, হলিউডের কল্যানে যোদ্ধা হিসেবে তাদের কৌশল, দৃঢ়তা ও অসাধারণ বীরত্বের গল্প আমরা অল্পবিস্তর অনেকেই জানি। ইতিহাসের অন্যতম যুদ্ধবাজ এই জাতি প্রতিপক্ষের জন্য ছিল আতঙ্কের অপর একটি নাম। 



গ্রীক বীর আলেকজান্ডার জয় করেছিলেন পুরো পৃথিবীকে। কিন্তু পুরো পৃথিবীকে জয় করলেও পৃথিবীর একটি দেশকে ঘাঁটাবার মতন সাহস পাননি। দেশটির পাশ দিয়ে দেখে ফিরে গিয়েছেন। যুদ্ধ করা তো দূরে থাক, যুদ্ধ করার চিন্তাও মাথায় আনেননি তিনি। এই দেশটি ছিল গ্রীসের অন্যতম শক্তিশালী নগরী স্পার্টা। স্পার্টান বালকদেরকে এমনভাবে গড়ে তোলা হতো, যেন তারা ঘুমের মধ্যেও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে পারে। যোদ্ধা হয়ে উঠতে কিন্তু এমন অনেক কার্যক্রম ও নিয়ম মেনে চলতো স্পার্টানরা যে সেগুলোকে দেখে অনেক সময় পাগলামীও মনে হতে পারে। চলুন দেখে আসি সাহসী যোদ্ধা জাতি স্পর্টানদের যোদ্ধা তৈরির  কিছু উদ্ভট পদ্ধতিকে--- 

----স্পার্টা লাসিদেমন নামেও পরিচিত ছিল সেকালে । বর্তমানে এর অবস্থান দক্ষিণ গ্রিসের লাকোনিয়া প্রদেশে। স্পার্টা ছিল প্রাচীন গ্রিসের একটি নগররাষ্ট্র; চারিদিকে পাহাড় ছিল যা বর্হিশক্রর হাত থেকে নগরীটিকে রক্ষা করত। এছাড়া বলা হয়, স্পার্টানরা নিজেদের শক্তিতে এত বেশি বিশ্বাসী ছিল যে, নিরাপত্তার খাতিরে তারা কখনো শহরের পাশে কোন দেয়ালও নাকি তোলেননি। খ্রিস্টপূর্ব ১১৫০ অব্দে উত্তর দিক থেকে ডোরিয়ান জাতি দক্ষিণে নেমে এসেছিল। এরাই ছিল স্পার্টার পূর্বপুরুষ। স্পার্টার নাগরিকরা অবশ্য মনে করত যে তারা হারকিউসের বংশধর।  

---একটি সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধাবাহিনী গঠনের অন্যতম পদ্ধতি হলো এমন একটি সমাজব্যবস্থা গঠন করা যেখানে সৈন্যবাহিনী বা যোদ্ধা তৈরির প্রক্রিয়া খুব ভালো ভাবে চলতে থাকে। যখন কোন ছেলে স্পার্টান সন্তানের জন্ম হয় তখন দেখা হতো যে,এই সন্তান বড় হয়ে স্পার্টান সেনাবাহিনীতে একজন সৈনিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী কিনা। স্পার্টাবাসীও তাদের শিশুদের নিয়ে সহজে সন্তুষ্ট হত না। তবে পরিবার নয়- রাষ্ট্রই আমৃত্যু শিশুর ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করত। শিশুরা তাদের বাবা-মার সন্তানের চাইতে বেশি ছিল রাষ্ট্রের সন্তান।  সদ্য ভুমিষ্ঠ শিশুকে নিয়ে যাওয়া হত পর্যবেক্ষক কাউন্সিলে যেখানে শিশুটিকে পরীক্ষা করে দেখা হত যে যোদ্ধা হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে আদর্শ কিনা! পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে ‘আদর্শ’ সনদ না পাওয়া শিশুটিকে কতটা করুণ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয় তা কল্পনার অতীত, তার বাবাকে আদেশ দেওয়া হতো যেন শিশুটিকে ‘অ্যাপোসথেটা’ নামক জায়গায় রেখে আসা হয়।
বলা হয়ে থাকে শিশুটিকে মাউন্ট টেইগাটাসের ফাটলে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হত। অবশ্য বেশিরভাগ ঐতিহাসিক এটিকে শুধু মিথ বলেই উড়িয়ে দেন। কিন্তু যেটি নিয়ে খুব একটা দ্বিমত নেই, শিশুটিকে ফেলে রেখে হতো কোন এক নির্জন পাহারের পাদদেশে, সেখানে শিশুটির ভাগ্যে খাদ্যের অভাবে বা কোন হিংস্র জন্তুর আক্রমণে মৃত্যু অথবা কোন হৃদইয়বানের উদ্ধার ও লালিত হওয়া এসবের যেকোন কিছু হতে পারে। নির্বাচিত শিশুটিকে যেতে হয় এরচেয়ে কম অমানবিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে; তবে তাও অনেক কঠিন। তার মৃগীরোগ আছে কিনা দেখার জন্য শিশুটিকে ওয়াইন দিয়ে স্নান করানো হতো। যদি ওয়াইনের ছোঁয়ায় শিশুটি কেঁপে উঠত তবে তারও একই পরিণতি হতো! যদি বাচ্চাটি এরপরেও বেঁচে থাকত, তবেই সে স্পার্টায় বেঁচে থাকার সম্পূর্ণ অধিকার পেত। কান্না করলে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না এবং ধীরে ধীরে তাকে শেখানো হত এই কান্নার কোন গুরুত্বই নেই। মানসিক দক্ষতা বাড়ানোর জন্যে একাকিত্ব, নির্জনতা ও অন্ধকারে ভয় না পাওয়ার জন্যে প্রণোদিত করা হত নানাভাবে। 

--স্পার্টান সমাজে ৫-১১ বয়সকে কৈশোর ও ১২ বছর থেকেই যৌবনকাল হিসেবে ধরা হতো। মাত্র ৭ বছর বয়সেই মা-বাবা থেকে আলাদা করে নিয়ে তাদের জায়গা দেওয়া হতো ব্যারাকে, যেখানে রাষ্ট্রের খরচে শুরু হতো আদর্শ যোদ্ধা ও নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা, তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হতো ‘অ্যাগোজ’ নামক শিক্ষা গ্রহণের জন্য; আর তার দায়িত্বে থাকত ‘ওয়ার্ডেন’ পদবিধারী একজন শিক্ষক।
অ্যাগোজ গ্রহণ করা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। ব্যারাকে থাকাকালীন অবস্থায় ছেলেদেরকে একে অপরের সাথে মারামারি করতে উৎসাহিত করা হতো। স্পার্টানদের বিদ্যালয় এমন কোনো সাধারণ বিদ্যালয় ছিল না যেখানে শিক্ষকরা কেবল শৃঙ্খলা টিকিয়ে রাখত। যদি কোনো ঝামেলা বাঁধত, তাহলে ছেলেদেরকেই তার হাত-কব্জির মাধ্যমে এর সমাধান করতে হতো। শিক্ষকের কাছে অভিযোগ করতে যাওয়া মানেই শিক্ষকের কাছেই বরং দুই হাত খাওয়া!

----ওয়ার্ডেনরা নিজেদের কাছে সবসময় চাবুক রাখত। যদি কোনো ছেলে কখনো খারাপ ব্যবহার করতো, তবে ওয়ার্ডেন তাকে নির্দয়ভাবে পেটাতে দ্বিধাবোধ করতো না। যদি কোনো বাবা জানতে পারত তার ছেলে শিক্ষকের কাছে মার খেয়েছে, তাহলে তার বাবা ছেলেটার উপর দ্বিতীয়বার চড়াও হতো। যদি না হয়, তাহলে বুঝে নিতে হতো ছেলেটিকে ত্যাজ্য করা হয়েছে!

---প্রথমেই শেখানো হতো  অস্ত্র হাতে নিয়ে এক ধরনের নাচ, এই প্রশিক্ষণ তাদের দ্রুতগামি করে তুলত। ব্যারাকে শিশুটিকে লিখতে-পড়তেও শেখানো হয়, পাশাপাশি আরো শেখানো হয় রণকৌশল, শরীরচর্চা, রণসঙ্গীত, শিকার এবং এমনকি চুরিও। 

--১২ বছর বয়সে শুধুমাত্র লাল কাপড়ের এক টুকরো ছাড়া যেকোনোরকম কাপড় নিষিদ্ধ করা হয় শীত কিংবা বর্ষা যে কোন ঋতুতেই। বাইরে ঘুমাতে বাধ্য করা হয় যেখানে হাতের কাছে পাওয়া জিনিস দিয়েই নিজের বিছানা তৈরি করে নিতে হতো। পেট ভরে নয়, এত কিছুর পরও খাবারের পরিমান ছিল খুবই সীমিত যাতে মুটিয়ে না যায়। স্পার্টান সমাজে মোটা ব্যক্তিদের খুবই নিচু হিসেবে দেখা হতো এবং অনেক সময় তাদের রাজ্য থেকেও বের করে দেওয়া হতো। প্রশিক্ষণরত যোদ্ধাদের চাবুক মেরে শাস্তি দেওয়া হয় খাবার চুরির জন্যে নয়, বরং চুরি করতে গিয়ে ধরা পরার জন্যে!

---স্পার্টান সমাজে পুরুষেরা যোদ্ধা ও নারীরা সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্যেই শুধুমাত্র বিবেচিত, তা সত্বেও মেয়ে শিশুদেরও অনেক কঠোর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিতে হত। নাচ, গান, শরীরচর্চা এবং চাকতি নিক্ষেপ শিখতে হত কিশোরকাল থেকে এবং মনে করা হত মা হিসেবে এটি তাদের শারীরিকভাবে শক্তিশালী করবে।

----যদিও প্রচুর খাটতে হত, তবু স্পার্টান আর্মিতে বাচ্চা থেকে বড়- সবাইকেই দেওয়া হত নিন্মমানের অতি অখাদ্য খাবার। তাও আবার খুব অল্প পরিমাণে। স্পার্টানদের এই ভোজসভার সবচেয়ে আকর্ষণীয় খাবার ছিল ‘ব্ল্যাক ব্রথ’।  রক্ত, সিরকা আর লবণের মিশ্রণ দিয়ে রান্না করা মাংস! স্পার্টানরা সবাই মিলে একসাথে খেত, একই ছাদের নিচে বসে এবং একই খাবারের টুকরো ভাগাভাগি করে। ব্ল্যাক ব্রথই ছিলো মাংস দিয়ে তৈরি একমাত্র খাবার এবং সবাই কিছু না কিছু টুকরো পেত। অতিরিক্ত মাংস খাওয়ার জন্য স্পার্টানদেরকে দ্বারস্থ হতে হতো বনের জন্তু-জানোয়ারের উপর। একমাত্র শিকারি দু’বার খেতে পারবে- প্রথমবার সবার সাথে ভাগাভাগি করে ব্ল্যাক ব্রথের মতো; বাকি অংশ নিজের বাসায়। শুধুমাত্র নিজের শিকার করা মাংসই বাসায় বসে খেতে পারত স্পার্টানরা এছাড়া আর কোন সময় বাড়িতে বসে খাবার গ্রহণের অনুমতি ছিল না কোন স্পার্টান যোদ্ধার। 

---রাতের খাবার শেষ হওয়ার পর একজন সহকারী ওয়ার্ডেন বা আন্ডার-মাস্টারের কাছে আসতে বাধ্য হত শিক্ষানবীশেরা। তাদেরকে কিছু প্রশ্ন করতো আন্ডার-মাস্টার। প্রশ্নগুলোর ধরন ছিল অনেকটা বর্তমান রচনামূলক প্রশ্নের মতো। যেমন: ‘বর্তমানে স্পার্টার সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি কে?’ প্রতিটি ছাত্রকেই তার উত্তর সঠিক কেন, তা ব্যাখ্যা করতে হতো। উত্তরগুলো হতে হবে চটপটে এবং যুক্তিযুক্ত; অন্যথায় তার জন্য থাকত এক অদ্ভুত শাস্তির ব্যবস্থা। প্লুটার্খের মতানুযায়ী, যে ছাত্র দুর্বল উত্তর দিত, তার বুড়ো আঙ্গুল কামড়িয়ে রক্ত বের করে ফেলা হতো!
সহকারী ওয়ার্ডেনের জন্যও জীবন খুব সহজ ছিল না। মৌখিক পরীক্ষার পর তিনি ছাত্রদের উত্তরের একটা সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা তুলে ধরতেন প্রধান ওয়ার্ডেনদের কাছে।  যদি পরীক্ষায় দেখা যেত যে আন্ডার-মাস্টার শিক্ষার্থীকে কম বা বেশি মেরেছে কিংবা কোন গাফিলতি করেছে তাহলে শাস্তি হিসেবে আঘাত পেতে হত তাকেও।

-----আপনি যদি একজন স্পার্টান হন, তাহলে আপনি কোনো ব্যাংকার, উকিল, গণিতবিদ বা অন্য কিছু নন- আপনি স্রেফ একজন সৈন্য, একজন স্পার্টান সৈন্য। শিক্ষাব্যবস্থাও এমনভাবে প্রণয়ন করা ছিল সেখানে, যেন স্পার্টানরা সেরা যোদ্ধা ছাড়া অন্যকিছু হবার কথা চিন্তাও না করতে পারে। স্পার্টানদের যুদ্ধের কলাকৌশল ছাড়া আর একটা জিনিসই শেখানো হতো, তা হলো লেখা পড়তে পারা। এছাড়া আর সবকিছুই ছিল নিষিদ্ধ। স্পার্টান বালকদের জন্য অবসর সময়ে যোগ-বিয়োগ কিংবা দর্শনশাস্ত্রের চর্চা করা ছিল একেবারেই নিষিদ্ধ।স্পার্টানদেরকে যদি দেখা যেত, তারা সৈন্য ছাড়া অন্য কিছু হওয়ার চেষ্টা করছে, তাহলে তারা যেন অন্য কিছু হতে না পারে, সেজন্য তাদের পড়ালেখার ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হতো।

---ত্রিশ বছর বয়সেও agoge পাস না করা স্পার্টান যুবকদের স্পার্টান স্টেট পূর্ণ নাগরিকের অধিকার দিতো না এবং তাদের থেকে সামরিক সেবা না পাওয়ার কারনে এই সকল স্পার্টানদের নিজস্ব জমি ভোগ করতেও দেওয়া হতো না। প্রশিক্ষণের দুই দশকেরও বেশি সময় পর, যদি একজন মানুষ স্পার্টার পূর্ণ নাগরিক হন তবে তিনি অন্য কোন পেশায় বা অন্য কোন ব্যবসা করতে পারতেন না।


---পাস করার পর আবার তারা ব্যারাকে ফিরে যেত। এবার তারা সৈন্য। তবে ট্রেনিংয়ের নতুন স্তর আরম্ভ হত। এর একটা হল: ‘নৈশকালীন যুদ্ধ’। রাতের অন্ধকারে পাহাড়ে কিংবা বনাঞ্চলে গেরিলা পদ্ধতিতে দাসদের ধরে ধরে হত্যা করত। 

---তারা এ সময় বিয়েও করত। রাষ্ট্র তাদের জমি দিত। জমিতে খাটত দাস। দাসরা ফসলের অর্ধেক তাদের দিত। কাজেই ফসল ফলানোর দুশ্চিন্তা ছিল না। তাছাড়া তাদের স্ত্রীরাও জমিজমা দেখাশোনা করত। কাজেই তারা ছিল সার্বক্ষণিক সৈন্য।যোদ্ধা হওয়া ব্যতিত বাকি অন্য পেশা তাদের জন্যে ছিল সম্পূর্ণ অবৈধ।  আসলে দাসশ্রমের ওপরই টিকে ছিল স্পার্টান সমাজ। জীবনের কেন্দ্রে ছিল যুদ্ধ। অবশ্য ৩০ বছর হলে পর পরিবারের সঙ্গে থাকা যেত। তবে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত তাদের রিজার্ভ যোদ্ধা হিসেবে ধরা হয় তারপরে অবসর জীবন। 

---স্পার্টান সমাজে আরও দুই শ্রেণীর নাগরিক বিদ্যমান ছিল।একটি সম্প্রদায় ছিল পেরিওইসি এবং অন্যটি ছিল হেলোটস।পেরিওইসি ছিল এমন নাগরিক সম্প্রদায় যারা কাছাকাছি বসবাস করতেন এবং যুদ্ধের সময় বিভিন্ন কৌশলে স্পার্টান যোদ্ধাদের সাহায্য করতেন।এদের অনেকেই ব্যবসায়ী, কারিগর এবং অন্যান্য অবকাঠামোগত কাজ করতেন। হেলোটসরা ছিল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ভুমিদাস বা কৃষক,মোট জনসংখ্যার সিংহভাগ। স্পার্টান রাষ্ট্রের সবকিছুই নগর-রাষ্ট্রের সামরিক শক্তি প্রদর্শন এবং শক্তিশালী করার জন্য ব্যবহার করা হতো। 

--১৮ বছর থেকেই একজন স্পার্টান পুরুষ সত্যিকার যোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি পায়। স্পার্টান বাহিনীর ছিলThe Krypteia নামের গোপন নিষ্ঠুর একদল যোদ্ধা বাহিনী। এই সিক্রেট সার্ভিসে নেওয়া হত ৩০ এর নিচের যোদ্ধাদের এবং যোগ দেওয়ার পূর্বে তাদের সবচেয়ে অমানবিক ও নিষ্ঠুর যে কাজটি করা লাগত তা হল নিরীহ দাসদের হত্যা করা! প্রক্রিয়াটি শুরু হয় একজন স্পার্টান নেতার যেকোনো কারণ দেখিয়ে অথবা ভুয়া বিদ্রোহের ধোয়া তুলে দাস হত্যার নির্দেশ দেওয়ার মাধ্যমে, যা স্পার্টার আইনব্যবস্থায় বৈধ। নির্দেশ পাওয়ার পর স্পার্টান যোদ্ধারা অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বেরিয়ে যেত দাস অধ্যুষিত এলাকায়, বেশিরভাগ সময়ে হত্যার জন্যে গেরিলা কায়দায় আক্রমণ পরিচালনা করা হয় এবং অবশ্যই রাতের অন্ধকারে। 

---Artemis Orthia মন্দিরের বেদীতে প্রতি বছর ধর্মীয়ভাবে আয়োজন করা হতো ভয়ংকর এক প্রথাগত উৎসব যেটি ডায়ামাস্টিগোসিস নামে একটি বার্ষিক উৎসব । এই বাৎসরিক প্রথায় সামরিক প্রশিক্ষণে থাকা স্পার্টান তরুনদের সাহসিকতা, ধৈর্য্য ও ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা পরীক্ষা করা হত , বালক থেকে পুরুষ- সব স্পার্টানরা ভীড়ের ভেতরে গিয়ে দাড়াতো আর তাদেরকে ক্রমাগত চাবুক দিয়ে  আঘাত করা হত বারবার। ভয়ংকরভাবে রক্তাক্ত হয়ে উঠে এই উৎসব এবং অনেক সময়ে তরুণ স্পার্টানদের কেউ কেউ যন্ত্রনায় ও রক্তক্ষরণে মারা যেত। প্রতিযোগিতা হত কে কতক্ষণ দাড়িয়ে থেকে আঘাত সহ্য করে তার ওপর ভিত্তি করে। মৃত্যু এলেও এটি ছিল স্পার্টানদের জন্যে গৌরবের বিষয়। সবাই চাইতো অংশ নিতে এই প্রতিযোগিতায়। একটা সময় দূর দেশ থেকেও স্পার্টায় এসে টিকেট কেটে এই প্রতিযোগিতা দেখা শুরু করে অন্য দেশের মানুষেরা। 

----স্পার্টানদের যোদ্ধাদের মধ্যে আত্মসমর্পন শব্দটির কোন জায়গা নেই, তাদের সার্বিক কর্তব্য সাহসিকতার সাথে এবং শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রে যদি একজনও অবশিষ্ট থাকে! আত্মসমর্পন করা যোদ্ধার কোন জায়গা ছিল না  স্পার্টান সমাজে, তাকে দেখা হয় ভীত কাপুরুষ হিসেবে এবং সমাজে এত লজ্জা ও অপমানের সম্মুখীন হতে হয় যে প্রায়ই এমন যোদ্ধারা আত্মহত্যা করত। স্পার্টার মায়েরা তাদের সন্তানদের হাতে ঢাল তুলে দিয়ে নাকি বলত "Come back with your shield, or on it." 

---যদি কোনো স্পার্টান বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যেত, তবে তার জন্য কেউ সম্মান দেখাত না; কোনরকম চিহ্ন ছাড়াই তার লাশকে পুঁতে ফেলা হত। স্পার্টানরা যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু হলেই সমাধির অধিকারী হতে পারতো। নারীরাও কবরফলক পাওয়ার সুযোগ পেত যুদ্ধ না করেই, তবে সেটা মাত্র একটি পদ্ধতিতেই- যদি সে বাচ্চা জন্ম দিয়ে মারা যেত। 

#স্পার্টান যোদ্ধা
#স্পার্টা

Friday, 27 April 2018

আলেকজান্ডার : দুনিয়া কাঁপানো এক যোদ্ধার সমাধি রহস্য

যিশু খ্রিস্টের জন্মের তিনশো বছর পূর্বের কথা।ম্যাসিডনের তৃতীয় আলেকজান্ডার খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন।প্রাচীন গ্রিসের ম্যাসিডনের রাজা ছিলেন তিনি। তাকে বলা হতো অর্ধেক পৃথিবীর রাজা। তিনি ছিলেন মেসিডোনিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ ও তার চতুর্থ স্ত্রী অলিম্পাসের সন্তান। তার অধীনে মূল রাজ্য ছিল গ্রিসের ছোট্ট রাজ্য ম্যাসিডন।


অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন আলেকজান্ডার। বলিষ্ট চেহারায় রূপ আর শক্তির মিশেলে তিনি অন্য সকল রাজার থেকে ছিলেন স্বতন্ত্র। সিংহের মতোই বিক্রম ছিল তার। মাথায় সবসময় সিংহের চামড়া জড়িয়ে রাখতেন। তার বাবা ফিলিপ আলেকজান্ডারকে বলেছিলেন, “ম্যাসিডন বড়ই ছোট তোমার পক্ষে, একদিন সারা পৃথিবী জয় করবে তুমি।” তার বাবার কথাই সত্যি হয়েছিল। একের পর এক দেশ জয় করতে করতে পারস্য, মিশর, এশিয়া মাইনর হয়ে ভারতের পশ্চিমেও চলে এসেছিল আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনী।
রাজা হিসেবে মাত্র ২০ বছর বয়সে পিতা দ্বিতীয় ফিলিপের স্থলাভিষিক্ত হন তিনি। তার শাসনামলের বেশিরভাগ সময় তিনি উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়া জুড়ে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। মাত্র ৩০ বছর বয়সের মধ্যেই তিনি মিসর থেকে শুরু করে উত্তর পশ্চিম ভারত পর্যন্ত ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। কথিত আছে, পৃথিবীর শেষপ্রান্তে পৌছানোর ইচ্ছে নিয়ে ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারত অভিযান শুরু করেন। কিন্তু তার সেনাবাহিনীর দাবির কারণে ফিরে যেতে বাধ্য হন। অ্যাড্রিয়াটিক সাগর থেকে সিন্ধু নদ পর্যন্ত এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধিশ্বর হয়ে ওঠেন আলেকজান্ডার। তিনি নিজেকে দেবতা জিউসের বরপুত্র ভাবতেন। তাকে নিয়ে প্রতিনিয়ত তৈরি হতে থাকে নানা রোমাঞ্চকর গল্প। শোনা যায়, প্রাচীন গ্রিসে দেবী আর্টেমিসের মন্দির ছিল পৃথিবীর অন্যতম এক আশ্চর্যময় স্থান। আলেকজান্ডারের জন্মের দিন সেই মন্দিরটি নাকি পুড়ে যায়। চারদিকে রটে যায়, স্বয়ং আর্টেমিস নাকি এসেছিলেন আলেকজান্ডারের জন্মের সাক্ষী থাকতে। এরকম নানা কিংবদন্তীতে ভরপুর সম্রাট আলেকজান্ডারের জীবন।


৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলনে দ্বিতীয় নেবুচাদনেজারের প্রাসাদে তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর কারণ নিয়েও নানা মতভেদ আছে। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর কারণটা আজও আমাদের কাছে একটি রহস্য। কীভাবে মারা গিয়েছিলেন এই অর্ধেক পৃথিবীর রাজা? অনেকে মনে করেন, আলেকজান্ডারের মৃত্যু হয়েছে অধিক মদ্যপানের কারণে। কারও কারও মতে, তিনি মারা গেছেন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে। আবার অনেকে দাবি করেন, তাকে বিষ প্রয়োগে মেরে ফেলা হয়েছে। যদিও বিষ দিয়ে মেরে ফেলার ব্যাপারে কোনো বিশ্বাসযোগ্য তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।


তবে সম্প্রতি ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয় ও ন্যাশনাল পয়জন সেন্টারের টক্সিকোলজিস্ট ড. লিও এসচেপের এক দীর্ঘ গবেষণায় বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর এক তথ্য। তার ভাষ্যমতে, ইউরোপীয় 'হোয়াইট হেলেবোর' নামক বিষাক্ত এক উদ্ভিদই আলেকজান্ডারের মৃত্যুর জন্য দায়ী। আলেকজান্ডারের দৃঢ বিশ্বাস ছিল, তিনি ইজিপ্সীয় পূরাণের দেবতা আমনের সন্তান। এমন বিশ্বাসের কারণে মৃত্যুর আগে তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর মরদেহ যেন ইউফ্রেটিস নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। কেননা তিনি মনে করতেন, নদীতে ভাসিয়ে দিলে তার দেহ সরাসরি চলে যাবে স্বর্গে। কিন্তু তার সহযোগী ও অনুরাগী প্রজারা তা পারেননি। তাই তারা আলেকজান্ডারের মরদেহের জন্য অতি যত্নে প্রায় দু’বছর ধরে তৈরি করেছিলেন সুদৃশ্য মানবাকৃতি শবাধার। এই দু’বছর নাকি তার মৃতদেহ সংরক্ষণ করা হয়।

বিখ্যাত ইতিহাসবিদ প্লুতার্ক এর বর্ণনায় পাওয়া যায়, মৃত্যুর পর ছ’দিন ধরে আলেকজান্ডারের দেহটি একটি সাধারণ কফিনে ফেলে রাখা হয়েছিল। কেননা, রাজার মৃত্যুর পর সবাই ব্যস্ত ছিল শোকে আর পরবর্তী সরকারগঠনের রাজনীতি নিয়ে। হঠাৎ সবার খেয়াল হল যে, আসল কাজটিই তারা করেননি। যে তাঁবুর ভিতরে সাধারণ কফিনটি রাখা হয়েছিল সবাই ছুটে গেলেন সেখানে। সাধারনত এতদিনে মরদেহ পচে যাওয়ারই কথা। তবেসেখানে গিয়ে সবাই নাকি হতবাক হয়ে যান। কফিন খুলে দেখা গেল, মৃতদেহটির কোনও ক্ষতি তো হয়ইনি বরং সেটি বেশ অক্ষতই রয়েছে।
এরপর সবাই মনোনিবেশ করলেন আলেকজান্ডারের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কাজে। শবদেহ বহন করার জন্য স্বর্ণ দিয়ে তৈরি করা হলো এক বিশাল শববাহী গাড়ি। আলেকজান্ডারের শবদেহও রাখা হলো সোনার তৈরি কফিনে। অতঃপর আরেকটি সোনার ক্যাসেটে ভরে তা তোলা হলো গাড়িতে। কফিনের পাশাপাশি গাড়িতে ছিল যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র। শববাহী গাড়ির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেনাপতি পারডিকাস। পরাক্রমশালী এই রাজার শবযাত্রা করতে সময় লেগেছিল প্রায় দুই বছর।
কিন্তু মেসিডোনিয়ায় যাওয়ার পথে ঘটল এক আকস্মিক দুর্ঘটনা। আলেকজান্ডারের বিশাল শবযাত্রাকে বাধা দিতে হাজির হলেন আলেকজান্ডারেরই এক ক্ষমতাশালী সেনাপতি টলেমি সোটার। আলেকজান্ডারের সমাধিবাহী গাড়িটা চুরি করে তারা নিয়ে গেলেন সিরিয়ায়। এরপর সেখান থেকে মিসরের মেমফিসে।

টলেমির এই চুরির কারণটি ছিল অবশ্য বেশ অদ্ভুত। রাজজ্যোতিষী অ্যারিস্টান্ডার একবার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, আলেকজান্ডার যেখানে সমাধিস্থ হবেন, সেই দেশ হবে সমৃদ্ধশালী, অপরাজেয় ও চিরশান্তির এক দেশ। টলেমি ভেবেছিলেন, আলেকজান্ডারকে মিসরকে সমাধিস্থ করা হলে ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী মিসরে উন্নতি সাধিত হবে। তখন তার রাজা হওয়ার পথ সুগম হয়ে যাবে। আলেকজান্ডারের শেষ ইচ্ছা পূরণ না হলেও টলেমির উদ্দেশ্য সফল হয়। আলেকজান্ডারকে মমি করে মিসরীয় রীতিতে সমাধিস্থ করা হয়। এর পর থেকেই আশ্চর্যজনকভাবে মিসরের উন্নতি সাধন হতে থাকে। শুধু তাই নয়, টলেমির বংশও দীর্ঘদিন রাজত্ব চালাতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে দ্বিতীয় টলেমি যখন মিসরের রাজা হলেন, কিছুদিন পর তার মনে হলো, প্রয়াত রাজার প্রতি আরও বেশি সম্মান জানানো উচিত। তাই আলেকজান্ডারকে তৃতীয়বার সমাধিস্থ করা হলো আলেকজান্দ্রিয়া শহরের সোমা নামক এক জেলায়।
সেখান থেকে আলেকজান্ডারের শবদেহ আর নড়চড় করা না হলেও শোনা যায়, টলেমি বংশের এক অপদার্থ উত্তরাধিকারী, নবম টলেমি আলেকজান্ডারের সোনার কফিন গলিয়ে মুদ্রা বানিয়ে নেয়।

অনেকের মতে, দীর্ঘদিন আলেকজান্দ্রিয়াতেই ছিল এই গ্রিক বীরের মরদেহ। রোমান সম্রাট অগাস্টাস নাকি দেখেছিলেন আলেকজান্ডারের মরদেহ। তাঁর নাকি জীবনীতে উল্লেখ আছে, এসময় তিনি সমাধির উপরে ফুল ছড়িয়ে দেন। মমির মাথায় পরিয়ে দেন মুকুট।এমনকি পরবর্তীতে জুলিয়াস সিজারের সময়ও নাকি সমাধিটি সেখানেই ছিল। আলেকজান্ডারের সমাধি দর্শনের কাহিনী নাকি জুলিয়াসের জীবনীতেও আছে।
এই মহান বীরের মরদেহ যদি সেখানেই চিরকালের জন্য থাকতো তাহলে কথা ছিল না। বাস্তবতা হল, সেখানে নেই মহান এই বীরের সমাধি। কোথায় আছে তা কেউ জানে না। ইতিহাসবিদ প্লুতার্ক কিংবা অগাস্টাস অথবা জুলিয়াস সিজারের বর্ণনায় সমাধির উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে এর অস্তিত্ব মেলেনি।

সম্রাট ক্যালিগুলা নাকি তার সারকোফেগাসের (মানুষের মতো দেখতে শবাগার) বুক থেকে বর্ম ছিড়ে স্মারক হিসেবে রেখেও দেন! আর রাজা অগাস্টাস সমাধির উপরে ফুল ছড়িয়ে দেন, মমির মাথায় পরিয়ে দেন মুকুট। তবে তিনি নাকি সারকোফেগাসের উপর ঝুঁকে সম্রাটকে চুমু খেতে গিয়ে তার নাকও ভেঙে দিয়েছিলেন! যদিও এ ধরনের সম্মান জানানো অনেকেরই পছন্দ হয়নি।

(৩৭৯-৩৯৫) সময়কালে আলেকজান্দ্রিয়ার ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়। পঞ্চদশ শতকে এ শহরের গুরুত্ব ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এর পাঁচ দশক পরই হঠাৎ আলেকজান্ডারের সমাধি অদৃশ্য হয়ে যায়। বিখ্যাত এ গ্রিক সম্রাটের দেহাবশেষ কোথায় রাখা আছে- তার উত্তর এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। অবশ্য ১৮৮৭ সালে লেবানন থেকে একটি শিল্পকীর্তি আবিস্কার হয়। সেটি একটি শবাধার,যা বর্তমানে রাখা আছে ইস্তানবুল জাদুঘরে। সেটির নামফলকে লেখা ‘আলেকজান্ডার সার্কোফেগাস’। অর্থাৎ আলেকজান্ডারের শবাধার। সেই হিসেবে আলেকজান্ডারের শবাধার মিলেছে বলে স্থাপত্যবিদেরা দাবি করলেও ইতিহাসবিদদেরা একমত নন।

তাদের মতে এটি সম্ভবত সিডন এর রাজা ‘আবদালোনিমাস’এর।সম্ভবত শবাধারটির গায়ে আলেকজান্ডার ও তাঁর সেনাবাহিনীর ছবি খোদাই থাকায় এটি জাদুঘরে ঠাঁই পেয়েছে।যাকে সবাই চেনে আলেকজান্ডারের সমাধি হিসেবে।এখন পর্যন্ত ১৪০ বারের মতো অনুসন্ধান চালিয়েও খুঁজে পাওয়া যায়নি বিখ্যাত এই গ্রিক সম্রাটের দেহাবশেষ। তবে কয়েক বছর আগে পূর্বে যেখানে ম্যাসিডন ছিল, সেখানে একটি প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র খুঁজে পান এক দল বিজ্ঞানী। ধারণা করা হয়, রোমান সম্রাট কারাকালা আলেকজান্ডারের শেষ ইচ্ছা পূরণ করার জন্য তাকে তার নিজ জন্মভূমিতে এনে সমাধিস্থ করেন। তবে এই সমাধি যে আলেকজান্ডারেরই, এ নিয়ে বিতর্কের অবসান এখনও হয়নি। তাহলে কোথায় আলেকজান্ডারের প্রকৃত সমাধি? ইতিহাসবিদদের ধারণা, গ্রিক বীরের শেষ সমাধিটি সম্ভবত ২৭০ খ্রিস্টাব্দে ভেঙে ফেলে দুষ্কৃতিকারীরা। অবশ্য এর পরেও অনেকেই আলেকজান্ডারের সমাধি দেখার দাবি করেছেন। এদের মধ্যে আছেন ইতিহাসবিদ ও পর্যটক ইবন আবদেল হাকাম, আল মাসুদি, লিও দি আফ্রিকানসহ অনেকেই। কিন্তু এরা শুধু দেখার কথাই বলেছিলেন। কোথায় দেখেছিলেন তার স্পষ্ট উল্লেখ নেই। আর এভাবেই এখনও রহস্য হয়ে রয়েছে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সমাধি।

#আলেকজান্ডার
#আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট

Tuesday, 24 April 2018

প্যৃথিবীর যেখানে গেলে ৩ টি সূর্য দেখতে পাবেন

একদিন যদি তাকিয়ে দেখেন সূর্যের চারপাশ ঘিরে তৈরি হয়েছে একটি নতুন বড়সড় বলয়, তখন আপনার অনুভুতি কি হবে একবার ভাবুন তো। ভাবছেন এমন আজগুবি কথা আপনাকে কেন শোনাচ্ছি? কারণ যা বলছি তা হয় ঘটতে দেখার কিছু হলেও সম্ভাবনা আছে আপনার। পৃথিবীর নানা দেশের নানান স্থানে দেখতে পাওয়া গেছে এমন বলয়।


সান ডগস হচ্ছে গোধূলির প্রহরের এমন একটি মুহূর্ত যখন সূর্যের দুপাশে সূর্যের মতই উজ্জ্বল আরও দুটি আলোকপিন্ড লক্ষ করা যায়। এই মুহূর্তটিকে অনেক যায়গায় মক সানস বা ফ্যান্টম সানসও বলা হয়ে থাকে এ অবস্থার বৈজ্ঞানিক নাম পারহেলিয়া। মাঝে মধ্যে দু পাশের এই আলোর প্রতিফলন থেকে থেকে বেরিয়ে আসা আলোর রেখা মিলে সূর্যের চারিদিকে একটি অর্ধ গোলাকার রিং এর মত সৃষ্টি করে।

আকাশে তিন সূর্যের উপস্থিতি এটাই প্রথম নয়। ঘটনাটি বিরল হলেও এমন ঘটেছে আরও অনেকবার। প্রস্তর যুগে প্রাকৃতিক এই ঘটনাকে অপয়া বলে মনে করা হতো।


  • সুইডিশ পেইন্টিং ভাদার্সোলস্তাভ­ান-এ তিন সূর্য আঁকা রয়েছে।
  • খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪ ও ৩২২ সালের মাঝে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল তার মিটিওরলজি ৩ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘দুটি নকল সূর্য আসল সূর্যের সঙ্গে উদয় হয়েছিল এবং সারাদিন তাকে ঘিরে থেকে আসল সূর্যের সঙ্গেই অস্ত হয়েছিল। এ দুটি নকল সূর্য সবসময় দুই পাশে থেকেছে, কখনও ওপর নিচে যায়নি। এছাড়া দিনের অন্যান্য সময়ের তুলনায় এদের সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের সময় বেশি স্পষ্ট দেখা গিয়েছিল।’
  •  খ্রিস্টপূর্ব ৩১০ ও ২৪০ সালের মাঝে কবি অ্যারাটাস তার ফেনমেনিয়া বইয়ে তিন সূর্যের আবির্ভাবের কথা বলে গেছেন। তার মতে এগুলো বৃষ্টি, বাতাস বা ঝড়ের পূর্বাভাস। 
  • এছাড়াও রোমান ইতিহাসে তাদের নানা বইয়ে একই সঙ্গে তিন সূর্যোদয়ের কথা উল্লেখ আছে। যেমন সিস্যারো-এর ‘অন দ্য রিপাবলিক’ বইয়ে এবং রোমান দার্শনিক অ্যাপিউলিয়াস-এর অ্যাপোলজিয়া ১৫-তে এ সম্পর্কে বর্ণনা পাওয়া যায়।
  • ইউরোপএর নানা অঞ্চলে নানা ভাবে বর্ণিত হয়েছে এই ঘটনা সম্পর্কে ইংল্যান্ডে ১৪৬১ সালে মরটিমেয়ারস ক্রস এর যুদ্ধে হিয়ারফরডশায়ার এক সাথে ৩ সূর্য দেখার ঘটনার বর্ণনা আছে। সে সময় ইয়র্কের কমান্ডার এডওয়ার্ড ৪ তার ট্রুপকে এই ঘটনা দেখিয়ে অনুপ্রানিত করেছিলেন এটি ঈশ্বর দ্বারা পাঠানো সংকেত বলে যার ফলে উনারা বিপুল বিক্রমের সাথে যুদ্ধে জিতেছিলেন। পরে এই ঘটনা শেক্সপিয়ার তার কিং হেনরি পার্ট ৩ নাটকে তুলে ধরেছিলেন। তবে সব থেকে পুরানো সঠিক ভিসুয়াল নির্দেশনা পাওয়া যায় সুইডিশ পেইন্টিং Vädersolstavlan এর মাধ্যমে। এর মানে হল সান ডগ পেইনটিং বা দা ওয়েদার সান পেইন্টিং।
  • সুইডিশ শহর স্টকহোমে ১৫২০ সালের ২০শে এপ্রিল দুই ঘণ্টা সময় ধরে সূর্যকে ঘিরে বলয় তৈরি হয়ে থাকে। খুব দ্রুতই সে সময় একটি গুজব রটে যায় যে রাজা গুতাভ ভাজার নানা অপকর্মের কারনে ঈশ্বরের দিক থেকে এই সংকেত দেয়া হয়েছে যে রাজার ধংস নিশ্চিত। এই রটনার প্রেক্ষিতে ঘটনাটি অমর রাখতে সে সময়ের চ্যান্সেলর ও স্কলার অলাউস পেত্রি এই ছবি আঁকতে নির্দেশ দেন। পরে এই ছবি নিয়ে রাজাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি এটিকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেন এবং অলাউস পেত্রি ও আরেকজন স্কলারকে শাস্তি দেন।আসল ছবিটি হারিয়ে গেলেও বর্তমানে ১৬৩০ সালের করা একটি কপি স্টকহোমের একটি চার্চে আজও শোভা পাচ্ছে।
  • বিশ্বব্যাপী এই অ্যাটমস্ফিয়ারিক ইলিউশন ঘটে থাকে। শীত প্রধান দেশে এর সংখ্যা বেশি হলেও গ্রীষ্মপ্রধান দেশেও এমন ঘটনা দেখা গেছে প্রচুর। কিছুদিন আগে রাশিয়ার আকাশে , মঙ্গোলিয়ার আকাশে  দেখা গেছে এই ঘটনা, ভিডিও চিত্রসহ প্রকাশ হয়েছে দ্য গার্ডিয়ান নিউজ সাইটে।গ্রিস, ইতালি, মেসিডোনিয়া, সুইডেন সহ মধ্য ইউরোপের অনেক দেশে এই দৃশ্য দেখা যায়।




আকাশে ভেসে থাকা বরফের ক্রিস্টালের ওপর সূর্যকিরণের প্রতিফলনই এ পারহেলিয়ার কারণ।
মাটি থেকে ৬ হাজার মিটার উঁচুতে বরফ কণা জমে মেঘ তৈরি হয়। সূর্যের আলো যখন পৃথিবীর দিকে ধাবিত হয় তখন যদি বাতাসে ভেসে বেড়ানো তুষারকণায় পড়ে তখন তা ২২ ডিগ্রি কোণে প্রতিফলিত হয়। এসব তুষারকণা প্রিজমের মতো কাজ করে। ফলে প্রতিফলিত আলো সূর্যের চারদিকে বলয়ের সৃষ্টি করে। সূর্যের চারপাশে একটি গোলাকার রিংয়ের মতো আলোকচ্ছটা দেখা যায়। সূর্যোদয়ের সময়ে এ ঘটনা ঘটলে সানডগগুলো ধীরে ধীরে সূর্য থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। সূর্যের কাছে থাকলে এদের লালচে মনে হয় এবং দূরে যেতে থাকলে এরা ক্রমশ হলুদ, কমলা এবং শেষের দিকে নীলচে হয়ে যায়। মাঝখানে সূর্য থাকে আলোকচ্ছটার মতো। আর এর দু’পাশে দেখতে পাওয়া যায় সূর্যের উপচ্ছায়া। শীতপ্রধান দেশে এ ঘটনা বেশি ঘটে। কারণ সেখানে হিমাঙ্কের নিচের তাপমাত্রায় বাতাসে বরফস্ফটিকের বেশি উপস্থিতি দেখা দেয়।

Friday, 20 April 2018

মানুষ খেকো রহস্যময় মন্দির

ভয় শব্দটি শুনলে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। প্রত্যেকেরেই ভয় পাওয়ার ধরণ আলাদা। কারো ভয় সাগরে, কারো পাহাড়ে আবার কারো বা ভূতে। কিন্তু ভয়ের মাত্রাটা আরো বেড়ে যায় যদি মানুষ খেকো কোন জন্তু-জানোয়ারের কথা শুনি কিংবা দেখি। তেমনই এ ভয়ের নাম মানুষ খেকো গুহা। এ গুহার কাছে গেলে নিমিষেই সে মানুষ গিলে খায়।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি পৃথিবীতে এমন একটি গুহা আছে যেটি মানুষ খেকো গুহা নামে পরিচিত। গুহা কি মানুষ খেতে পারে? হয়তো পারে আবার পারে না। কিন্তু আমরা যে গুহার কথা বলছি সেটাতে শুধু মানুষ কেন, যে কোন জীব জন্তু ঢুকলেই আর জীবিত বেরিয়ে আসতে পারে না। ভয়ানক সেই মানুষ খেকো গুহাটি তুরষ্কে অবস্থিত।


গ্রিক ভূগোলবিদ স্ট্রাবোর জানান,প্রাচীন গ্রিক শহর হিয়ারাপোলিসে একটি প্রাচীন এপোলো দেবতার মন্দির বানানো হয়েছিলো।পরে নানা কারণে সেটি রহস্যময় মন্দিরে পরিণত হয়।সেই মদিরের পাশেই ছিলো একটি গুহার অবস্থান।জানা গেছে সেই গুহার ভেতর কোনো জীব জন্তু অথবা কোনো পশুকে ছুড়ে দিলে তা আর কোনোভাবেই ফিরে আসতে পারতো না।এমনকি মানুষও যদি গুহার সামান্য পথ অতিক্রম করতো তাহলে সেও ফিরে আসতে পারতো না।


সবথেকে চমকে দেওয়ার ঘটনা হলো সেই গুহায় যদি কোনো পুরিহিত প্রবেশ করতো তাহলে সে একদম নিরাপদভাবে গুহা থেকে ফিরে আসতে পারতো।তবে তাদের মুখমন্ডল ফুলে যেতো ও রক্তাত্ব থাকতো।প্রাচীন গ্রিকবাসীরা মনে করতেন এটি পরলোকে গমন করার পথ।এই গুহায় অপদেবতারা রাজত্ব করেন।সাধারণ মানুষ বা জীব-জানোয়াররা সেখানে গেলে অপদেবতারা তাদের মেরে ফেলে আর দেবতারা গেলে তাদের ঐশ্বরিক ক্ষমতাবলে অপদেবতাদের সাথে লড়াই করে ফিরে আসতে পারে।প্রাচীন গ্রিকবাসীদের বিশ্বাস ছিল এই গুহা হল পরলোকে যাওয়ার পথ এবং সেখানে রাজত্ব করে অপদেবতারা। সাধারণ মানুষ বা জীব-জানোয়াররা সেখানে গেলে অপদেবতারা তাদের মেরে ফেলে আর দেবতারা গেলে তাদের ঐশ্বরিক ক্ষমতাবলে অপদেবতাদের সাথে লড়াই করে ফিরে আসতে পারেন সে কারণেই। স্ট্রাবো এই তথ্যটি তার পুঁথিতে লিখেছিলেন ২০০০ বছর আগে। অবশ্য বর্তমানে আধুনিক বিশ্বের মানুষ ভূত, প্রেত, দেবতা বা অপদেবতা বিশ্বাস করে না। বিজ্ঞানেও এদের কোন বাস্তবতা নেই। তাহলে কি সেখানে কোন অপদেবতা ছিল না? আবার না থাকলেই বা সেখানে মানুষ, জীব-জন্তুদের মেরে ফেলতো কারা? তাহলে কি ওই গুহাটি নিজেই মানুষ খেকো গুহা!



স্ট্রাবোর পুঁথির সূত্র ধরে আমেরিকার নিউইয়র্ক কলেজের অধ্যাপক শেলডেন এই বিষয়ে নির্ভরযোগ্য নতুন তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি মত প্রকাশ করেন, ওই গুহার নিচ থেকে প্রাকৃতিক ভাবে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গত হতো। ফলে কোন মানুষ বা জীব-জন্তু গুহার ভিতরে প্রবেশ করলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসের প্রভাবে শ্বাসকষ্টে মারা যেত।


তাহলে এখন প্রশ্ন দেবতারা ভিতরে ঢুকলে মারা যেত না কেন? এ ব্যাপারে শেলডেন বলেন, দেবতারা বিষয়টা পূর্ব থেকেই জানতো সেজন্য তারা এই গুহার ভিতরে ঢুকে দম বন্ধ করে থাকতো। এবং বাইরে এসে তাদের শক্তি ও ক্ষমতার মহিমা প্রচার করতো। তবে তারা যখন গুহার বাইরে আসতো তখন তাদের মুখম-ল গ্যাসের চাপে ফোলা ও রক্তাত্ত্ব থাকতো।

এই প্রাচীন গ্রিক শহরটি বর্তমানে পশ্চিম তুর্কির পাযুক্কাল শহরে অবস্থিত। সরেজমিনে সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে আছে প্রচুর উষ্ণ প্রসরণ। তার মধ্যে আছে অধিক পরিমাণ ক্যালসিয়াম কার্বনেট। এসিডের সঙ্গে বিক্রিয়ার ফলে এ থেকে উৎপন্ন হয় প্রচুর কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস। বাষ্প এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড কোনও ফাটল দিয়ে ঢুকে যায় গুহার ভেতর। আর তাই ভিতরে কয়েক পা গেলেই নিশ্চিত মৃত্যু। এপোলোর মন্দিরের সেই রহস্যময় গুহাটি আজও আছে।

কয়েক বছর আগে একদল অস্ট্রেলীয় ছাত্র অনুসন্ধিৎসা বশত: ওই গুহার ভেতরে ঢুকেছিল পরীক্ষার জন্য। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য এটাই যে, তারা আর ফিরে আসেনি। এরপর থেকে তুর্কি সরকার গুহামুখে লোহার পাত বসিয়ে দিয়েছে । যাতে আর কেউ ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে।

Sunday, 15 April 2018

ফ্রিম্যাসনারি: বিশ্বের প্রাচীনতম এক গুপ্তগোষ্ঠী

*** পোস্টটি বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য, জাতি, বিশ্বাস, সংস্কৃতি , কাহিনি,  থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে অনুপ্লেরাণিত হয়ে লেখা, যার পুরোপুরি সত্য হওয়ার দাবি আমি করতে পারিনা, কাউকে দোষারোপ করা আমার উদ্দেশ্য না ****

আমরা এযাবৎ প্রাপ্ত তথ্যাদি ঘেটে সবচেয়ে প্রাচীন যে গুপ্তগোষ্ঠির কথা জানতে পারি, তার নাম হলো ফ্রিম্যাসনারি। বলা হয়ে থাকে, খ্রিস্টের জন্মেরও তিন হাজার অব্দে জেরুজালেমের সলোমন মন্দিরের যে নির্মাতারা ছিলেন তাদের মধ্য থেকেই এই গুপ্তগোষ্ঠির উদ্ভব হয়েছিল। এই গোষ্ঠিটির সঙ্গে বিভিন্ন সময় বিশ্বের কিছু বিখ্যাত-কুখ্যাত সংগঠনের যোগাযোগ ঘটেছিল। এমনটি মধ্যযুগে ত্রাস সৃষ্টিকারী নাইট টেম্পলারদের সঙ্গেও ছিল এই গোষ্ঠির যোগাযোগ। তবে গোষ্ঠিটির বিরুদ্ধে যতই অভিযোগ থাকুক না কেন ইউরোপের আলোকপ্রাপ্তি বা এনলাইটেনমেন্টের পেছনের কারিগর কিন্তু তারাই। সময়ের ফেরে বিভিন্ন সময় গোষ্ঠিটি নাম বদলাতে বাধ্য হয়। কখনও একে দেখা যায় ম্যাসনিক গিল্ড নামে, আবার কখনও স্রেফ গায়েব হয়ে যায় গোষ্ঠির সকল কাজকর্ম। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায় বহু বছরের জন্য।


একটা সময় ছিল যখন আমেরিকার ভাগ্যনিয়ন্তা বলা হলো ফ্রিম্যাসনারিদের। কারণ এই গোষ্ঠিটিরই সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকের সেই উত্তাল সময়ে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং আমেরিকার রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং সমাজ উত্থানের পেছনে শক্তিশালী ভুমিকা ছিল। আপনার ধারনার বাইরে গিয়ে এই গোষ্ঠির সদস্যাদের মধ্যে ছিলেন ফরাসি লেখক ভলতেয়াল, জার্মান সঙ্গীতবিদ মোজার্ট, আমেরিকান বৈজ্ঞানিক বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন থেকে শুরু করে কিছুকাল আগে প্রেসিডেন্ট থাকা জর্জ ডব্লিউ বুশ। আর এই চাঞ্চল্যকর তথ্য জানা যায় ক্রিস্টোফার নাইট ও রবার্ট লোমাসের লেখা হিরাম কী নামক বইটিতে।

গুপ্তগোষ্ঠির সদস্যা হওয়া স্বত্ত্বেও এই দুই লেখকই সর্বপ্রথম লিখিত কোনো বক্তব্য নিয়ে আসেন এই গোষ্ঠিটি সম্পর্কে। জন্মসূত্রে ম্যাসন বা রাজমিস্ত্রী হবার পরেও জ্ঞান বিজ্ঞানের শাখা উতরাতে না পারায় সংঘের সেই গুপ্ত অংশে তারা আর যেতে পারেননি। কিন্তু প্রাচীন অধিকাংশ নথি ঘেটে, যেমন ধরা যায় ডেড সী স্ক্রল ঘেটেও তারা ফ্রিম্যাসনারিদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জানার চেষ্টা করেন। এই বইটিতেই তারা প্রথমবারের মতো জানানোর চেষ্টা করেন যে, এতোদিন এই গোষ্ঠিটির উদ্ভব ইউরোপে মনে করা হলেও আসলে তা ঠিক নয়। বরং এই দুই লেখক প্রমাণ করবার চেষ্টা করেন যে, গোষ্ঠিটি গঠিত হয়েছিল জেরুজালেমের সলোমন মন্দিরে। কারণ হিসেবে বলা হয়, যিশু খ্রিস্টের জন্মের এক হাজার বছর আগে সলোমন মন্দিরের কাজ শুরু হয়েছিল। মন্দিরটিতে অলংকরণের জন্য খুব উচুদরের নকশার সম্মিলন ঘটানো হয়েছিল, যা শেষমেষ শুধু নকশাই ছিল না। ছিল এক অগাধ জ্ঞানের আকর যেন।


রাজা সলোমন (খ্রিস্টপূর্ব দশম শতক) যাদুবিদ্যা ও আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞার জন্য প্রখ্যাত ছিলেন। যে কারণে তাঁর পক্ষে টেম্পল অভ সলোমন-এর স্থাপত্য নকশাটি স্বয়ং ইয়াওয়ের কাছ থেকে পাওয়া সম্ভব হয়েছিল। যে কারণেই ওই স্বর্গীয় নকশাটি হয়ে উঠেছিল এক অতীন্দ্রিয় জ্ঞানের উৎস। সে নকশা সম্বন্ধে জানতেন হাইরাম আবিফ নামে এক মেধাবী কারিগর। ইনি ছিলেন টেম্পল অভ সলোমন- এর প্রধান স্থপতি। হিব্রু বাইবেলে টায়ার নগরের রাজা হাইরাম এর নাম থাকলেও হাইরাম আবিফ -এর নাম নেই। অবশ্য বাইবেলে হাইরাম আবিফ কে নাপ্তালি গোত্রের ‘বিধবার সন্তান’ বলা হয়েছে । হিব্রু বাইবেলের সেকেন্ড বুক অভ ক্রনিকলস-এর দ্বিতীয় অধ্যায়ে সে বর্ণনা রয়েছে।এই কারিগরকে নিয়ে আছে বেশকিছু রহস্য। বাইবেলে এই মিস্ত্রির নাম উল্লেখ থাকলেও মন্দিরের গায়ের ট্যাবলেটে তার নাম লেখা নেই। অথচ ওই মন্দিরের মূল স্থপতিই বলা হয় তাকে। তৎকালীন সময়ে হাজার খানেক কারিগরের মধ্য থেকে তাকেই বেছে নেয়া হয়েছিল এই কাজের জন্য। কারণ হিসেবে জানা যায়, তৎকালীন কারিগরদের মধ্যে একমাত্র আবিফ হাইরামই স্বর্ন, রৌপ্য এবং ব্রোঞ্জ নিয়ে কাজ করতে পারতেন। শুরু তাই নয়, বিভিন্ন রংয়ের সন্নিবেশ ঘটিয়ে তাতে নকশা করার জন্যও তিনি বিখ্যাত ছিলেন। জেরুজালেমে কাজ করতে যাবার পর ওই মন্দিরে থাকাকালীন সময়েই পাথর কাটা মিস্ত্রিদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল ম্যাসনিক গিল্ড। বলা হয়ে থাকে, আবিফ হাইরামই অন্য নকশাকারদের ঈশ্বর থেকে প্রাপ্ত নকশাটি বুঝিয়ে দিতেন। এনিয়ে কিছু নকশাকারদের সঙ্গে বাদানুবাদও হয়েছিল আবিফের। সেই বাদানুবাদের এক পর্যায়ে নিজেরই তিন শিষ্যের হাতে তিনি নিহত হন।

ম্যাসন বা রাজমিস্ত্রিদের প্রতীক হিসেবে স্বীকৃত কম্পাস ছিল এই গুপ্তগোষ্ঠিটির প্রতীক। কম্পাস এবং বর্গক্ষেত্রের মাঝে থাকা ‘জি’ মানে গড এবং জিওম্যাট্রি এই দুটি শব্দের প্রতীক। এই গোষ্ঠিটির কাছে সৃষ্টিকর্তা হলেও একজন বিশাল মাপের আর্কিটেক্ট। আর জ্যামিতির জ্ঞান ছাড়া যেহেতু স্থাপত্যকলা সম্ভব নয়, তাই জ্যামিতিকেই ধরা হয় মূল উপজীব্য এবং পালনীয় রীতি। আজও ইউরোপের ম্যাসনরা বিভিন্ন মন্দিরের গোপন স্থানে মিলিত হয় এবং তাদের মধ্যকার জ্ঞানের বিনিময় হয়।
আধুনিক ফ্রিম্যাসনারি গোষ্ঠীতে তিনটি ডিগ্রি রয়েছে। যেমন, (১) Entered Apprentice – দীক্ষার প্রাথমিক স্তর। (২) Fellow Craft – এটি মধ্যবর্তীকালীন ডিগ্রি, এসময় নানা ধরণের শিক্ষালাভ হয় (৩) Master Mason – এই ডিগ্রি না-হলে গোষ্ঠীর অন্যান্য গোপন কৃত্যে অংশ নেওয়া যায় না। Master Mason হওয়াই একজন প্রাথমিক ফ্রিম্যাসনারি সদস্যের মূল লক্ষ।
Melaka Malaysia Freemason-Hall

ফ্রিম্যাসনরা বলে, যারা মুক্ত এবং স্বাধীন চিন্তার অধিকারী তিনটি শক্র তাদের সর্বদা ধ্বংস করতে চায়। (১) অজ্ঞতা;(২) গোঁড়ামি; এবং (৩) স্বৈরাচার।

বাইবেল- এর উক্তি বাদে হাইরাম আবিফ কিংবা টেম্পল অভ সলোমন-এর অস্তিত্ব সর্ম্পকে আধুনিক ঐতিহাসিকগণ নিশ্চিত নন। তবুও টেম্পল অভ সলোমন-এর আদলে পরবর্তীকালে ইউরোপ এবং আমেরিকায় প্রায় ১৫০০ হাজার ‘মেসোনিক লজ’ (মিস্ত্রীদের কুঠির) গড়ে উঠেছে । যে লজের গোপন চেম্বারে ফ্রিম্যাসনরা সমবেত হয়ে আজও গোপন কৃত্যে অংশ নেয়-যে কৃত্যের কেন্দ্রে ৩০০০ বছরের প্রাচীন টেম্পল অভ সলোমন এর প্রধান স্থপতি হাইরাম আবিফ !

ইতিহাসে তাদের অবস্থান যেমনই হোক না কেন, সরাসরি তাদের অস্তিত্বের বিরোধিতা করাটা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, নানান সময়ে নানান রকম আকার-ইঙ্গিত এবং বিতর্কিত গোপন তথ্য তাদেরকে করে তুলেছে আরও রহস্যময়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা নানা রকম প্রথা এবং গোপন আচার-অনুষ্ঠান পালন করে আসছে। ফলে, এদের কোনগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে, আর কোনগুলো আজও পালিত হচ্ছে, তা বুঝে ওঠা মুশকিল। তবে, এতো কিছুর পরও, ব্যাপারগুলোর আকর্ষণ কিংবা সাধারণ মানুষের জানার আগ্রহ কিন্তু মোটেও কমেনি।

 সকলের অগোচরে এই ধর্মীয় সংগঠনটির পালন করা এমনই কিছু গোপন প্রথা ও রীতি ----

--একে অন্যের বিরুদ্ধে তারা কখনওই সাক্ষ্য প্রদান করে না


ফ্রিম্যাসনরা এ নিয়মটি খুবই গুরুত্বের সাথে মেনে চলে। কোনো বিচারে একজন ফ্রিম্যাসন কখনওই অন্য একজন ফ্রিম্যাসনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ দেয় না। বিচারে সাক্ষ্য দেয়ার আগে যদিও প্রতিটি মানুষকেই শপথ করানো হয়। অর্থাৎ প্রয়োজনে তারা শপথভঙ্গ করার মতো পাপ করতেও রাজী। কারণ তাদের কাছে, শপথভঙ্গ করার চেয়ে স্বজাতিকে রক্ষা না করাটা অনেক বেশি পাপের কাজ ।

 --গোপন হ্যান্ডশেক


যদিও ফ্রিম্যাসনরা সাধারণত তাদের গোপন ব্যাপারগুলি কখনও সরাসরি স্বীকার করেনা। কিন্তু, তাদের আছে হ্যান্ডশেক করার এক বিশেষ পদ্ধতি- যার নাম ম্যাসনিক হ্যান্ডশেক। ধারণা করা হয়, বিপদে পড়লে ফ্রিম্যাসনরা বিশেষ কোনো মন্ত্রও পড়ে। তাদের বিশ্বাস এতে অন্য ফ্রিম্যাসনরা তার সাহায্যে ছুটে আসতে পারবে। কথিত আছে, মোরমনিজম এর প্রতিষ্ঠাতা, জোসেফ স্মিথ মৃত্যুর সময় সেই মন্ত্র পড়েছিলেন ।

ফ্রিম্যাসনারি প্রতীক। কম্পাস এবং স্কয়্যার এর মানে সহজেই বোঝা যায়। মাঝখানের ইংরেজি ‘G’ অক্ষরটি God এবং Geometry- এ দুটি শব্দের প্রতীক। ফ্রিম্যাসনরা মনে করে ঈশ্বর হলেন মহাবিশ্বের Grand Architect এবং জ্যামিতির জ্ঞান ব্যতীত স্থাপত্যবিদ্যা সম্ভবপর নয়। এ কারণেই উনিশ শতকের একজন প্রখ্যাত ফ্রিম্যাসনারি লেখক অ্যালবার্ট পাইক-এর একটি বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় রয়েছে ইউক্লিড- এর উক্তি।  


--তাদের আছে একাধিক গোপন পাসওয়ার্ড


এ ব্যাপারটা যদিও অনেকেই জানেন। কিন্তু, সাধারণত সবাই মনে করে, ফ্রিম্যাসনদের একটি মাত্র গোপন পাসওয়ার্ড আছে। প্রকৃতপক্ষে, নানান পরিস্থিতিতে এবং উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার জন্য তারা ভিন্ন ভিন্ন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে। প্রতিটি সিক্রেট পাসওয়ার্ডের শেষ সিলেবল অনুসারে নাম আছে এমন কাউকে খুন করার মধ্য দিয়ে সেই পাসওয়ার্ডটির ব্যবহার শুরু হয়। এমনই একটি পাসওয়ার্ড হলো “মর-বন-জি”, যদিও প্রকৃত শব্দটা খুব কম লোকেই জানে। একই ভাবে, শুধুমাত্র অনুষ্ঠানগুলোতে বিশেষভাবে ব্যবহার করার জন্য ফ্রিম্যাসনরা একটি পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে থাকে, সেটি হলো “টু-ব্যাল-কেইন” ।

---অনুষ্ঠানে ফাঁসির দড়ি


সাধারণত, ম্যাসনরা তাদের প্রাথমিক অনুষ্ঠানগুলোকে খুবই মনোমুগ্ধকর বলে বর্ণনা করে থাকে। কিন্তু, কোনো অনুষ্ঠানে ফাঁসির দড়ির উপস্থিতিকে কি স্বাভাবিক বলা যায়? এর প্রকৃত অর্থ কিংবা উদ্দেশ্য বলা কঠিন। কেউ কেউ বলেন, এটা নীরবতা বজায় রাখতে জোরারোপ করার এক নীরব হুমকি। কেউবা আবার একে নাড়ি (Umbilical Cord) হিসেবে ব্যাখ্যা করে থাকেন। যে যাই বলুক না কেন, ব্যাপারটা যে একটু অস্বাভাবিক তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই ।

--সূর্যের প্রতি ভালবাসা


ফ্রিম্যাসনদের বিশ্বাস, পূর্বদিক পুনর্জন্মের প্রতীক। আর আকাশের বুকে সূর্যের গৌরবান্বিত যাত্রা দেখে তারা গেয়ে ওঠে সূর্যের জয়গান। ম্যাসনিক লজগুলো এজন্য পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে মুখ করে বানানো হয় যেন, সৌরশক্তিকে তারা নিজেদের কাজে ব্যবহার করতে পারে ।

 --নাস্তিকদের কোনো স্থান নেই


আপনি যদি নাস্তিক হয়ে থাকেন, তাহলে, ফ্রিম্যাসনদের পরিবারে আপনার কোনো স্থান নেই। একজন ফ্রিম্যাসন হবার প্রথম এবং প্রধান শর্ত হলো, অবশ্যই কোনো শক্তিমান সত্ত্বায় আপনার বিশ্বাস থাকতে হবে। যদিও, সে শক্তিমান সত্ত্বার পরিচয় নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু, আপনাকে অবশ্যই সেই সত্ত্বার প্রতি নিজেকে সমর্পণ করতে হবে। প্রয়োজনে আপনি মিথ্যাও বলতে পারেন। কিন্তু, ধর্মীয় অনুসারী হওয়াকে তারা শ্রদ্ধার সাথে দেখে। পাশাপাশি, ঐতিহ্যগতভাবে অবাঞ্ছিত জনগোষ্ঠীগুলো যেমন, সমকামী জনগোষ্ঠীকে ম্যাসনারিতে স্বাগত জানানো হয়। একটু আজব হলেও সত্য যে, তাদের মন্দিরগুলোতে মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। অনেক গ্রুপই অবশ্য আজকাল এর বিরোধিতা করছে।

--বিভিন্ন দেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতি তারাই নিয়ন্ত্রণ করে!


ম্যাসনদের অফিসিয়াল দুর্নীতির বহু নজির আছে। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব দারুণভাবে ধামাচাপা দেয়া হয়। প্রায় অর্ধ মিলিয়ন ম্যাসন ছড়িয়ে আছে ইংল্যান্ডের ব্যাংকিং, রাজনীতি এবং সরকারী খাতে। এমনকি হাসপাতাল এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তারাই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

--ডলার নোটে ম্যাসনদের চিহ্ন 


কখনও কি ভালভাবে আমেরিকান ডলার নোট খেয়াল করেছিলেন? যদি খেয়াল করেই থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই, পিরামিডের ওপর সেই রহস্যময় চোখ আপনার নজর এড়ায় নি। এটি ফ্রিম্যাসনদের অন্যতম একটি চিহ্ন। আর এর নিচে ল্যাটিন ভাষায় লেখা আছে ফ্রিম্যাসনদের নীতিবাক্য, যার অর্থ, "নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার"। অনেকের মতে, এটা ফ্রিম্যাসনদের প্রভাবে করা হয়নি। বরং ডিজাইন কমিটিতে থাকা একমাত্র ফ্রিম্যাসন- বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের প্রস্তাবনাতেই এই চিহ্ন ডলার নোটে বসানো হয়েছিল।

--অ্যান্ডার ব্রিভিক ছিলেন একজন ম্যাসন


২০১১ সালে নরওয়েতে গণহত্যাকারী ব্রিভিক ছিলেন অসলোর সেইন্ট ওলাফ লজের একজন সদস্য। পরবর্তীতে, তাকে মৌখিকভাবে বহিষ্কার করা হলেও, প্রতিষ্ঠানটির সাথে তার সম্পৃক্ততা কখনওই ছিন্ন হয়নি ।

--মহাকাশ অভিযানে ম্যাসনদের অবদান 


অনেকেই বলেন, ম্যাসনদের প্রধান উদ্দেশ্য পৃথিবীর কর্তৃত্ব নেয়া। কিন্তু, কোনো কোনো ম্যাসনদের হয়তো আবার চাঁদের দিকেও নজর আছে। বাজ অলড্রিন সহ অ্যাপোলো প্রোগ্রামের মহাকাশচারীরা প্রত্যেকেই ছিলেন স্বপ্রণোদিত ম্যাসন। তারা বিশেষ ছাপ রেখে এসেছে চাঁদের বুকে। কে জানে, অলড্রিন আবার তার টেক্সাসের ম্যাসনিক লজের জন্য চাঁদের বুকে নিজেদের অধিকারও দাবী করে বসতে পারেন! পৃথিবীর মাটি ছাড়িয়ে তখন ফ্রিম্যাসন বৃক্ষের শাখা-প্রশাখাও হয়তো ছড়িয়ে যাবে মহাকাশে ।



ফ্রিম্যাসোনারি গোষ্ঠীর সঙ্গে মধ্যযুগের ক্রসেড-যুগের নাইট টেম্পলার দের ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে।’ চতুদর্শ শতকে যাদের ওপর ধর্মদ্রোহীতার অভিযোগে গির্জা এবং রাষ্ট্রের খড়গ নেমে আসে । তা সত্ত্বেও তাদের অনেকেই স্কটল্যান্ড এবং অন্যত্র পালিয়ে যেতে পেরেছিল। এ প্রসঙ্গে Born in Blood, The lost secrets of Freemasonry বইতে জন জে. রবিনসন লিখেছেন: ...some French Templars fled to Scotland after the suppression of the Order, fearing persecution from both Church and state. ফেরারি নাইট টেম্পলাররা স্কটিশ stonemason দের কুটিরে অর্থাৎ লজে আশ্রয় নেয়। তারা মেইসনদের আনুগত্য এবং virtues of chivalry শেখায়। কী ভাবে? মেইসনদের হাতিয়ারগুলি প্রতীক হিসেবে ধরে নিয়ে। এভাবে নাইট টেম্পলার সংঘটি এক নতুর রূপ নেয়। স্কটল্যান্ডের রোজলিন নামে একটি গ্রাম আছে। সেই গ্রামে পঞ্চদশ শতকের মধ্যভাগে নির্মিত একটি গির্জায় সেই রূপান্তরের ছাপ স্পষ্ট। তারপর ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে ম্যাসনদের United Grand Lodge of England প্রতিষ্ঠিত হয়। রবিনসন মনে করেন, তার আগ পর্যন্ত নাইট টেম্পলারদের সংঘটি স্কটিশ stonemason দের মধ্যে টিকে ছিল। এরপর ইউরোপে সামাজিক পরিবর্তন আসে, ফলে নাইট টেম্পলারদের মেইসনিক লজেও আমূল পরিবর্তন আসে।

মধ্যযুগের মেইসনদের (মেইসন= somebody who works with stone) সঙ্গে ফ্রিম্যাসনারি গোষ্ঠীর এক বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে।  তাদের প্রতিষ্ঠিত ব্যাঙ্কের ওপর ইউরোপের ধনী অভিজাত এবং শাসকবর্গের আস্থা ছিল। সুতরায় নাইটরা হয়ে ওঠে ধনী ব্যাঙ্কার এবং এভাবে তারা প্রভূত অর্থের মালিক হয়ে ওঠে। এবং সে অর্থে তারা ইউরোপজুড়ে বিশাল বিশাল সব দূর্গ এবং ক্যাথিড্রাল নির্মান করেছিল এবং এর ফলে তারা প্রথম Stonemason দের সংস্পর্শে আসে। মেইসনদের বিশেষ কারিগরি জ্ঞান ছিল- যে জ্ঞানকে আধ্যাত্মিক ভাবা হত, হয়তো আজও ...জ্যামিতি তো কেবল গণিতের শাখা নয় ... সে অপার্থিব এক জগতের ইঙ্গিত দেয় ... এই জ্ঞানের সঙ্গে নাইট টেম্পলারদের নিজস্ব নিগূঢ় জ্ঞানের সংযোগ ঘটেছিল। যে জ্ঞানের সমন্বয়ের ফলে পরবর্তীকালে ফ্রিম্যাসনারি গোষ্ঠীর উদ্ভব বলে অনেকেই মনে করেন।
মানবসভ্যতায় পাথর কেটে স্থাপত্য নির্মাণ বহু প্রাচীন ঐতিহ্য। এ ক্ষেত্রে প্রাচীন মিশরই পথিকৃৎ । বিশেষ করে প্রাচীন মিশরের পিরামিড যুগের মেইসনরা বিশেষ এক গাণিতিক জ্ঞান আয়ত্ম করেছিল, যাকে গূহ্য এবং নিগূঢ় মনে করা হত। পরবর্তী যুগের মেইসনরা পিরামিড নির্মাণকারী সেই আদি মেইসনদের শ্রদ্ধা করত। কারিগরি ও গাণিতিক জ্ঞান অনেকটা গুপ্ত উপায়ে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছেছিল।
প্রাচীন মেইসনদের নিগূঢ় এবং রহস্যময় কারিগরি জ্ঞান প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মধ্যযুগ পৌঁছেছিল। মধ্যযুগের ক্যাথিড্রাল এবং দূর্গ নির্মাণকারী মেইসনরা সেই জ্ঞান প্রয়োগ করেছিল।
মধ্যযুগের ইউরোপে ক্যাথিড্রাল নির্মাণের যুগে মেইসনরা ছিল স্বাধীন। এর অর্থ- তারা ইউরোপের যে কোনও অঞ্চলে সীমান্ত অতিক্রম করে চলে যেতে পারত । এই কারণে তাদের বলা হত Freemason. তাদের বিশেষ কারিগরি জ্ঞান থাকলেও তারা ছিল শিক্ষাবঞ্চিত; তারা লিখতে-পড়তে জানত না। সে জন্য তারা নিজেদের মধ্যে বিশেষ সঙ্কেত ব্যবহার করত। এর অন্যতম অন্যতম হল করমর্দন।
হাইরাম আবিফ-এর হত্যাকান্ডটি ঘটেছিল দুপুর বেলায়। খুনিরা তাঁর মৃতদেহ রাবিশের নীচে লুকিয়ে রাখে এবং রাত্রে অত্যন্ত গোপনে নিকটবর্তী এক পাহাড়ে সমাহিত করে। পরের দিন খুনিরা ধরা পড়ে এবং ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে রাজা সলোমনের কানে যায়। তিনি করিগরদের নিয়ে পাহাড়ে যান। তারপর কারিগররা হাইরাম আবিফ কে কবর থেকে টেনে তুলতে ব্যর্থ হলে রাজা সলোমন প্রবল বিক্রমে সিংহের থাবায় হাইরাম আবিফ কে কবর থেকে টেনে তোলেন এবং যাদুকরী শক্তিতে নবজীবন দান করার চেষ্টা করেন । টেনে তোলার বিশেষ ধরণের কারণেই মেইসনদের করমর্দন ছিল ভিন্ন ধরনের। আমাদের মনে রাখতে হবে মধ্যযুগের মেইসনদের কাছে রাজা সলোমন এবং হাইরাম আবিফ ছিলেন আদর্শস্থানীয়। রাজা সলোমনের ‘গ্রিপ’ ভিন্ন ছিল বলেই মেইসনদের ‘গ্রিপ’ও ভিন্ন ধরনের। বর্তমান কালেও ফ্রিম্যাসনদের handshake ভিন্ন ধরনের যা ওই গোষ্ঠীর বাইরে সাধারণ মানুষ ব্যাপক কৌতূহল ও বিস্ময় সৃষ্টি করে ।


মধ্যযুগের ফ্রিম্যাসনদের বলা হত operative mason. এর অর্থ তারা কর্মরত। তারা বাস করত কুটিরে। এই কুটিরগুলোকে বলা হত ‘লজ’; সাদামাটা লজগুলি তৈরি করা হতো নির্মীয়মান ক্যাথিড্রাল বা দূর্গের আশেপাশে। ফ্রিম্যাসনরা ছিল দরিদ্র; তবে জ্ঞানী। তাদের হৃদয়ে ছিল জ্ঞানের আলো। তারা লজে বসে নানা বিষয়ে আলোচনা করত। এর মধ্যে অন্যতম ছিল মহাবিশ্বের 'মাস্টার ম্যাসন' ঈশ্বর, গণিত এবং তার অপার বিস্ময়। কখনও প্রাচীন পিরামিডের স্থাপত্য কৌশল ... কখনও-বা খ্রিস্টপূর্ব দশম শতকে জেরুজালেমে নির্মিত টেম্পল অভ সলোমন -এর ‘মাস্টার মেইসন’ হাইরাম আবিফ ...
মধ্যযুগের মেইসনরা ষোড়শ শতকে গঠন করেছিল সংঘ বা guild; সেই গিল্ডে ছিল গনতন্ত্র এবং সাম্য। মাস্টার মেইসনকে গনতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত করা হত। গিল্ডের সদস্যরা সহযোগী কারিগরদের (এদের বলা হয় ‘ Fellow Craft’) ভালোমন্দের খোঁজখবর নিত। কেনন, তৎকালীন মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রটি কল্যানমূলক ছিল না। কোনও মেইসন অসুস্থ হলে বা মৃত্যুবরণ করলে কোনও ধরণের রাষ্ট্রীয় সাহায্য ছিল না। সুতরাং মেইসনদের গিল্ড তহবিল গঠন করেছিল।
পরবর্তীতে মেইসনদের লজে যোগ দিয়েছিল একদল স্বশিক্ষিত এবং জ্ঞান অনুরাগী আলোকিত মানুষ। পরবর্তীকালে যাদের বলা হয় speculative mason. এই আলোকিত মানুষগুলি gentlemen masons নামেও পরিচিত ছিল। কিন্তু মেইসনদের লজে সেই সব স্বশিক্ষিত এবং জ্ঞান অনুরাগী আলোকিত মানুষদের যোগ দেওয়ার কি কারণ? মেইসনদের লজগুলি ছিল অনেকটা আজকের যুগের ‘পাঠচক্রের’ মতো, যেখানে জ্ঞানচর্চা হত। ফ্রিম্যাসনদের প্রতীক ছিল কম্পাস এবং স্কয়্যার; এবং এর মানে সহজেই বোঝা যায়। মাঝখানের ইংরেজি 'G’ অক্ষরটি God এবং Geometry এ দুটি শব্দের প্রতীক। ফ্রিম্যাসনরা মনে করে ঈশ্বর হলেন মহাবিশ্বের Grand Architect এবং জ্যামিতির জ্ঞান ব্যতীত স্থাপত্যবিদ্যা সম্ভবপর নয়। এ কারণেই উনিশ শতকের একজন প্রখ্যাত ফ্রিম্যাসনারি লেখক অ্যালবার্ট পাইক-এর একটি বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় রয়েছে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের গ্রিক গণিতবিদ ইউক্লিড- এর উক্তি।
মধ্যযুগে সমগ্র ইউরোপ ছিল খ্রিস্টীয় গির্জার কঠোর নিয়ন্ত্রনে। তারা এক বিশেষ ধরণের ‘সত্য’ লালন করত। সেই সত্যের বাইরে তারা কোনও ভিন্নমত সহ্য করত না। কিন্তু মানবমন কৌতূহলী বলেই সে প্রতিষ্ঠিত সত্যকে নেড়েচেড়ে দেখতে চায়। কাজেই ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকের ইউরোপের একদল স্বশিক্ষিত জ্ঞান অনুরাগী মানুষ বাস্তব জগতের বাস্তব ব্যাখ্যায় অনুসন্ধানে ব্রতী হয়। ইউরোপের ওই যুগটি Age of Enlightenment বা ‘জ্ঞানদীপ্তির যুগ’ হিসেবে চিহ্নিত।  জ্ঞানদীপ্তি যুগের সেইসব আলোকিতগণ সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্ব বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিয়মিত মেইসন লজে যেতেন । অশিক্ষিত মেইসনরা যে নিগূঘ জ্ঞানের চর্চা করত, speculative mason-রা সেই জ্ঞানের বিষয়টি বুঝতে চাইলেন ঐতিহাসিক এবং যৌক্তিক চিন্তার প্রেক্ষাপটে। এভাবে প্রাচীন প্রজ্ঞা এবং আধুনিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় ঘটেছিল। এবং ইউরোপে একটি সমাজবিপ্লব হয়ে উঠল আসন্ন!
জ্ঞানদীপ্তির যুগে নিউটন গীর্জা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সত্য অস্বীকার করে নিজস্ব বুদ্ধি এবং যুক্তিবোধের ওপর প্রকৃতি ও বিশ্বজগৎকে বোঝার চেষ্টা করলেন। আলকেমি বিষয়ে নিউটনের গভীর কৌতূহল ছিল । তিনি ‘ফিলসোফারস স্টোন’ (The philosopher's stone (Latin: lapis philosophorum) is a legendary alchemical substance said to be capable of turning base metals (lead, for example) into gold (chrysopoeia) or silver.) নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। তিনি মনে করতেন খ্রিস্টপূর্ব দশম শতাব্দীতে নির্মিত জেরুজালেমের টেম্পল অভ সলোমন-এর নকশার বিন্যাসে ‘ফিলসোফারস স্টোন’- তৈরির ইঙ্গিত রয়েছে। নিউটন এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলেও একটি বিষয় আমাদের কাছে পরিস্কার যে টেম্পল অভ সলোমন-এর স্থাপত্যরীতি এবং এর প্রধান স্থপতি বা ‘মাস্টার মেইসন’ বারবার ইউরোপের ইতিহাসে আলোচিত হয়েছেন
ইউরোপীয় রাজনীতির ওপর জ্ঞানদীপ্তির যুগের অনিবার্য প্রভাব পড়েছিল। ১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে স্বৈরাচারী ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চালর্সকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়; এরপর পার্লামেন্ট বা আইনসভার ভূমিকা হয়ে ওঠে মূখ্য, রাজতন্ত্রের ক্ষমতা খর্ব করে ইংল্যান্ডে রিপাবলিক গঠন করা হয়। রাজা চতুদর্শ লুই শাসিত ফ্রান্স এবং ইউরোপরে অন্যত্রও নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের ভিত কেঁপে ওঠে। একই সঙ্গে জ্ঞানদীপ্তির যুগের আলোকিতগণের ওপর নেমে আসে রাষ্ট্রের নির্যাতন। স্বাধীন চিন্তা গির্জা এবং গির্জার পৃষ্ঠপোষক রাজতন্ত্রের অন্তরায় বলে গির্জা রাজতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নেয় । গির্জার নির্যাতন, যাকে ‘ইনকুইজিশন’ বলে, সেটি অবশ্য আরও আগে থেকেই অব্যাহত ছিল। জ্ঞানদীপ্তির যুগের আলোকিতগণ রাষ্ট্র ও গির্জার পৃথকীকরণের সঙ্গত দাবি তুলেছিল। এখান তারা লুকিয়ে প্রাণ বাঁচাতে চাইল । ফ্রিম্যাসনদের লজ হয়ে উঠেছিল তাদের নিরাপদ আশ্রয়। এর আগেই ফ্রিম্যাসনদের গনতন্ত্র এবং সাম্যের বোধ তাদের আকর্ষন করেছিল।

১৭১৭ সালের ২৪ জুন লন্ডনে প্রথম ফ্রিম্যাসনদের গ্রান্ড লজ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন আইজাক নিউটনের এক বন্ধু। গ্রান্ড লজ-এর
প্রথম গ্রান্ড মাষ্টার হন আন্থনি সেয়ার।  ১৭১৭ সালে আধুনিক ফ্রিম্যাসন গোষ্ঠীর যাত্রা শুরু। তাদের লিখিত চার্টারে প্রথম ধারাটি ছিল ধর্মীয় সহনশীলতা। গনতান্ত্রিক উপায়ে গ্রান্ড মাষ্টার নির্বাচিত করা হত (কেননা,মধ্যযুগের মেইসনরা গনতান্ত্রিক উপায়ে তাদের মাস্টার মেইসন নির্বাচিত করত) যা ইউরোপীয় সমাজে প্রভাব ফেলেছিল। তবে খ্রিস্টপূর্ব দশম শতাব্দীর প্রধান স্থপতি বা Master Mason হাইরাম আবিফ এর স্মৃতি লজের সদস্যদের (কৃত্যের রিচুয়াল) মাধ্যমে জীবন্ত হয়ে ওঠে।

এসব কারণেই পরবর্তীকালে ফ্রিম্যাসনারী গোষ্ঠীতে এক প্রতীকময় ভাষা তৈরি হয়, যা গোষ্ঠীর বাইরে সাধারণ মানুষের কাছ গুপ্ত এবং রহস্যময় বলে মনে হয়।
ফ্রিম্যাসনদের ওপর যথাসময়ে গির্জার খড়গ নেমে এসেছিল । দীর্ঘকাল ধরেই রোমান ক্যাথলিক চার্চ ফ্রিম্যাসনদের কট্টর সমালোচনা করে আসছিল। ফ্রিম্যাসনদের গোষ্ঠীতে যোগদানের ওপর ১৭৩৮ খ্রিস্টাব্দে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়; বলা হয় যে- কোনও ক্যাথলিক ওই অশুভ সংঘে যোগ দিলে তাকে বহিস্কার করা হবে। ফ্রিম্যাসনদের ওপর গির্জার এই অক্রোশ পরবর্তীকালেও অব্যাহত থাকে।
ফ্রিম্যাসনারি গোষ্ঠীর সঙ্গে ইলুমিনাতি (Illuminati) নামে আরেকটি গুপ্ত গোষ্ঠীর সর্ম্পক অত্যন্ত গভীর। যে কারণে বলা হয়- The Freemasons and the Illuminati are hand in glove. কাজেই ইলুমিনাতি গোষ্ঠীর উত্থান, ইতিহাস ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে পরিস্কার ধারণা না থাকলে ফ্রিম্যাসনারি গোষ্ঠী সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা গড়ে উঠবে না। এ কারণেই এ পর্বের আলোচনার বিষয় ইলুমিনাতি । ইলুমিনাতি বিশ্বময় One World Order প্রতিষ্ঠা করতে চায় । এই উদ্দেশ্যে তারা ধর্মসমূহের বিনাশ চায়, সরকারগুলির উৎখাত চায়। ইলুমিনাতির শক্তির মূলে রয়েছে অকাল্ট (গূহ্য জ্ঞান) এবং ইকোনমি (অর্থনীতি)। এই গুপ্ত গোষ্ঠটি দীর্ঘদিন ধরে আর্ন্তজাতিক ব্যাঙ্ক, তেলব্যবসা, শিল্পকারখানা, এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসাবানিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। আর্ন্তজাতিক রাজনীতি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের সরকার কে প্রভাবিত করে আসছে।
Illuminati শব্দটির অর্থ:- ‘জ্ঞানের দীপমালায় উদ্ভাসন।’ তবে ইলুমিনাতি বলতে ক্ষুদ্র এক গুপ্ত গোষ্ঠীকে বোঝায়। এ বিষয়ে মাইক্রোসফট এনকার্টা লিখেছে: ... group claiming enlightenment: অথবা a group claiming to have received special religious or spiritual enlightenment, especially an 18th-century German secret society with deist (deism= rational belief in God: a belief in God based on reason rather than revelation and involving the view that God has set the universe in motion but does not interfere with how it runs. Deism was especially influential in the 17th and 18th centuries... ) ... and republican ideas. কিন্তু, প্রশ্ন হল কোন ধরণের জ্ঞান? মধ্যযুগে খ্রিষ্টীয় চার্চ চায় নি যে সাধারণ মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়াক বা মানুষ বিজ্ঞান চর্চা করুক । কাজেই একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী জ্ঞানের জন্য ঈশ্বর-এর বিপরীত শক্তি (শয়তান)-এর আরাধনা করে। ইলুমিনাতির জ্ঞানের ভিত্তি সম্বন্ধে পশ্চিমে এরকম ধারণাই প্রচলিত।
অ্যাডম ভাইসার্ট ছিলেন জার্মানির (তৎকালীন বাভারিয়ার) ইনগলস্টাড বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক। তিনি ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে ইলুমিনাতি গোষ্ঠীটি প্রতিষ্ঠিত করেন। ভাইসার্ট -এর পূর্বপুরুষ ইহুদি হলেও পরবর্তীতে তারা ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহন করেছিল। পরিবারটির সঙ্গে জেসুইটস সম্প্রদায়ের সম্পর্ক ছিল। জেসুইটস সম্প্রদায়টি অকাল্ট এবং ভারতীয় যোগশাস্ত্র চর্চা করত বলে সম্প্রদায়টি ছিল রহস্যময় । অনেকের মতে জেসুইটস সম্প্রদায়ের গূহ্য প্রতীক এবং সংকেত পরবর্তী কালে ভাইসার্ট তার প্রতিষ্ঠিত গোষ্ঠীর প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। ভাইসার্ট জার্মান ফ্রিম্যাসনারি লজ-এ যোগ দিয়েছিলেন। এরপর created the Illuminati as an organization within an organization, infiltrating numerous Masonic lodges and taking control of them, as well as the universities.ভাইসার্ট ইলুমিনাতি গোষ্ঠীকে ফ্রিম্যাসনারি গোষ্ঠীর ‘চূড়ান্ত স্তর’ হিসেবে দেখতেন।
জার্মানির মানচিত্রে ইনগলস্টাড এর অবস্থান। এখানেই অষ্টাদশ শতকের শেষে ইলুমিনাতি গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল। অষ্টাদশ শতকে ইনগলস্টাড ছিল বাভারিয়ার অর্ন্তগত । অ্যাডম ভাইসার্ট -এর জন্মস্থান হওয়ায় ছোট্ট শহরটি আলোচনা উঠে এসেছে। যে ভাইসার্ট বলেছিলেন: G is Grace, the Flaming Star is the Torch of Reason. Those who possess this knowledge are indeed Illuminati.


ভাইসার্ট ইলুমিনাতি গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠান দিন হিসেবে ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের ১ তারিখ বেছে নিয়েছিলেন । কেননা ওই দিনটি আদিম প্যাগানদের পবিত্র দিন। অনেকে কমিউনিষ্ট আন্দোলনকে ফ্রিম্যাসনারি এবং ইলুমিনাতি গোষ্ঠীর পরিকল্পিত ‘প্রজেক্ট’ বা ‘এজেন্ডা’ হিসেবে দেখেন। মে মাসের ১ তারিখ কমিউনিষ্টদের এক বিশেষ দিন। তা ছাড়া ওই ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দই American Declaration of Independence ঘোষিত হয়েছিল এবং মার্কিন ওই ঐতিহাসিক ঘটনার নায়কদের অনেকেই ছিলেন ফ্রিমেইসন যারা ইউরোপ থেকে অষ্টাদশ শতকে ‘নতুন বিশ্বে’ গিয়েছিল। (পরবর্তী পর্বগুলোয় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব ...)...যাক। ইলুমিনাতি গোষ্ঠীর ভিতরে ভাইসার্ট ছদ্মনাম ধারণ করেছিলেন। ভাইসার্ট এর ছদ্মনাম ছিল ‘স্পার্তাকাস’; যিনি বলেছিলেন: ইলুমিনাতি বিশ্বময় One World Order প্রতিষ্ঠা করতে চায় ।১৪ জুলাই, ১৭৮৯। ফ্রান্সের বাস্তিল দূর্গ জ্বলছে। ফরাসি বিপ্লবের পিছনেও ইলুমিনাতি গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ ইন্ধন ছিল বলে ঐতিহাসিকগণ ধারণা করেন।

 
Wes Penre লিখেছেন: ভাইসার্ট- এর ‘স্পন্সর’ ছিল ইউরোপের সম্পদশালী রথচাইল্ড পরিবার। পরিবারটি তখনও এবং এখনও ফ্রিম্যাসনারি গোষ্ঠীর হর্তাকর্তা। ফ্রিম্যাসনারি গোষ্ঠীতে 33 degrees বা স্তর রয়েছে। এই ৩৩ ডিগ্রির ওপরে ইলুমিনাতি গোষ্ঠীর নিজস্ব গ্রেড বা স্তর রয়েছে। এমন কী যারা ফ্রিম্যাসনারি গোষ্ঠী উচুঁ স্তরে বা লেভেলে অবস্থান করে তারাও এ বিষয়ে সচেতন নয়। বিষয়টি এমনই গোপন। ভাইসার্ট ১৮৩০ সালে মারা যান। তিনি সম্ভবত কোনও ফ্রিম্যাসনের হাতে খুন হয়েছিলেন। সে যাই হোক। আসলে ভাইসার্ট ছিলেন রথচাইল্ড পরিবারের মতো ইউরোপীয় অভিজাতদের ক্রীড়নক। কারণ ইউরোপীয় অভিজাতরাই ছিল ইলুমিনাতি প্রতিষ্ঠার মূলে। যারা ‘নিউ ওয়ার্ল্ড অডার’ প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। ... যে ইউরোপীয় অভিজাতদের সঙ্গে প্রাচীন ব্যাবিলনের সরীসৃপ-কাল্টের একটি স্পস্ট যোগসূত্র রয়েছে।
স্বর্গরাজ্যে আদম ঈভ ও সরীসৃপ। গবেষকদের মতে ইলুমিনাতি এবং অন্যান্য ইউরোপীয় গুপ্তগোষ্ঠীর মূলে রয়েছে Brotherhood of the Snake; স্বর্গরাজ্যে যে সরীসৃপ ঈশ্বরের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে আদমকে জ্ঞান দিয়েছিল বা আদমকে ‘ইলুমিনেট’ করেছিল বা আদমকে ‘জ্ঞানের দীপমালায় উদ্ভাসন’ করেছিল। সরীসৃপ কে ইংরেজিতে Snake ছাড়াও বলা হয় reptile । এই বিষয়টি নিয়ে ব্রিটিশ লেখক David Vaughan Icke বিস্তারিত গবেষনা করেছেন: ...David Icke identified the Brotherhood as originating from reptilians from the constellation Draco, who walk on two legs and appear human, and who live in tunnels and caverns inside the earth. অবশ্য এই তত্ত্বে আমার তেমন আস্থা নেই।

আসলে ভাইসার্ট এর মতোই ফ্রিম্যাসনারি এবং ইলুমিনাতি অভিজাত ইউরোপীয় রথচাইল্ড পরিবারের ক্রীড়নক; এবং গত ৩/৪ শ বছর ধরে ইউরোপ এবং আমেরিকার সব গুপ্ত গোষ্ঠীই ফ্রিম্যাসনারী এবং ইলুমিনাতির নিয়ন্ত্রণে।
 বর্তমানে ইলুমিনাতি নিয়ন্ত্রণ করছে ইউরোপ এবং আমেরিকার ১৩টি সম্পদশালী পরিবার; যাদের শক্তির মূলে রয়েছে অকাল্ট এবং ইকোনমি । ( যারা এই ধারাবাহিক পোস্টগুলো পড়ছেন তারা এরই মধ্যে জেনে গিয়েছেন যে মধ্যযুগের ইউরোপের নাইট টেম্পলারদের শক্তির মূলেও ছিল ওই অকাল্ট এবং ইকোনমি ) এই পরিবারগুলি ব্ল্যাক ম্যাজিক এবং অকাল্টচর্চা (মূলত শয়তানের উপাসনা) করে বলেই এদের বলা হয় ‘কৃষ্ণ অভিজাত’ বা ‘ব্ল্যাক নোবেলিটি’। বর্তমান বিশ্ব এই ‘শয়তান উপাসক’ সিক্রেট কাল্টই শাসন করছে। এদের পূর্বপুরুষও প্রাচীনকালে বিশ্ব শাসন করত। এরা আজও আজও আর্ন্তবিবাহের মাধ্যমে প্রাচীন রক্তের ধারা বা ‘ব্লাডলাইন’ অক্ষুন্ন রেখেছে। ...
ইলুমিনাতি ক্রমশ ‘এক সরকার’ এবং ‘নতুন বিশ্বব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য সমগ্র বিশ্বকে দাসত্বে আবদ্ধ করে রাখা। এ জন্য তারা দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেছে। আধুনিককালে শিল্পায়ন এবং ‘ইর্ফেমেশন টেকনোলজি’ তাদের উদ্দেশ্য পূরণে সাহায্য করছে। ইলুমিনাতির অন্যতম উদ্দেশ্য হল ইউরোপ এবং আমেরিকার মতো উন্নত দেশগুলির জীবনযাত্রার মান নিচুস্তরে রাখা, যাতে রাষ্ট্র সহজেই জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল বিশ্বেও সামাজিক উন্নয়ন ঘটিয়ে জীবনযাত্রার মান উন্নত করে ইউরোপ এবং আমেরিকার মতো উন্নত দেশগুলির জীবনযাত্রার মানের সমকক্ষ করে তোলা।
পূর্বে একবার উল্লেখ করেছি যে ইলুমিনাতির প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডম ভাইসার্ট-এর স্পন্সর ছিল রথচাইল্ড পরিবার। ইউরোপের সম্পদশালী রথচাইল্ড পরিবার ইলুমিনাতির প্রধান হয়ে উঠেছিল। কাজেই অ্যাডম ভাইসার্ট-এর মৃত্যুর পর তার গোপন পরিকল্পনা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে যায়নি। রথচাইল্ড পরিবারটি আজও তেরোটি ইলুমিনাটি পরিবারের অন্যতম। সিসিল রোহডস নামে একজন প্রভাবশালী ফ্রিম্যাসন নেতা পরিবারটিকে মদদ যুগিয়েছিল।
সিসিল রোহডস উনিশ শতকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে ‘অভিন্ন বিশ্বব্যবস্থা’ নির্মাণের চেষ্টা করেছিলেন। রথচাইল্ড পরিবার সেই ‘এজেন্ডায়’ ‘স্পন্সর’ করেছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সেই পরিকল্পনারই ফল বলেই অনেকে মনে করেন। বিশেষ করে ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষ হতাশ হয়ে পড়ে। ফলে তারা জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠায় স্বস্তি পায়। শান্তিরক্ষাই জাতিসংঘের প্রধান কর্তব্য। কাজেই বিশ্বযুদ্ধ আর সংগঠিত হবে না।
ইলুমিনাতি অগ্রসর হয় সমস্যা -প্রতিক্রিয়া-সমাধান পদ্ধতিতে । বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত করে তারা সমস্যা তৈরি করে; এতে বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া হয়; মানুষ সমস্যার সমাধান চায়। কাজেই জাতিসংঘ সৃষ্টি করে ইলুমিনাতি সমস্যার সমাধান করে -যা one further step toward a One World Government.
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর ইলুমিনাতির পরবর্তী সাফল্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন । যা, অনেক বিশ্লেষকের মতে, একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে পরিনত হতে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে অচিরেই ই ইউ-র সদস্য রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা এবং সার্বভৌমত্ম হ্রাস পাবে। একটি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে মুষ্টিমেয় অভিজাত শাসকদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে ইউরোপ। এরাই গ্রিস এর অর্থনীতি ধ্বংস করে ফেলেছে। কাজেই প্রশ্ন ওঠে- who are running EU?? উত্তর The Freemasons and the Illuminati.

১৭১৭ সালের ২৪ জুন লন্ডনে প্রথম ফ্রিম্যাসনদের গ্র্যান্ড লজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন আইজাক নিউটনের এক বন্ধু। প্রথম গ্র্যান্ড মাষ্টার নিযুক্ত হন আন্থনি সেয়ার। এর অল্প কিছুকাল পরই ফ্রিমেইসনরা ‘নতুন বিশ্বে’ পাড়ি জমায়। সেই নতুন বিশ্বের ভার্জিনিয়ার দক্ষিণে ক্যারোলিনায় ততদিনে প্রথম ইংরেজ বসতি গড়ে উঠছিল;এবং ১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই জর্জিয়াসহ তেরোটি উপনিবেশের পত্তন হয়। নতুন উপনিবেশের ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য ছিল বহু ধর্মসম্প্রদায়ের বহুমাত্রিক সমাবেশ, এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জার্মান এবং ডাচ সংস্কারবাদীগণ, রোমান ক্যাথলিক এবং স্কচ-আইরিশ Presbyterians; এছাড়া অনেক রাজকীয় কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ী ছিলেন এঞ্জেলিকান। জোনাথন এডওয়ার্ড নামে একজন ধর্মপ্রচারক ১৭৪০ সালে যে ধর্মবিপ্লবের ডাক দেন তা The First Great Awakening নামে পরিচিত। এই ধর্মবিপ্লবের সময়েই ফ্রিমেইসনারি গোষ্ঠীর সদস্যরা উপনিবেশ-আমেরিকায় আসতে থাকে। অ্যালবার্ট পাইক নামে এই গোষ্ঠীর একজন তাত্ত্বিক মুক্ত এবং স্বাধীন আমেরিকায় পরবর্তীকালে উচ্চারণ করবেন: “Masonry, successor to the Mysteries (Babel, Mythras, Tummuz, Whicka,etc.) still follows the ancient manor of teaching.” [ “Morals and Dogma.p.22 ]

সপ্তদশ শতকজুড়ে হেনরি প্রাইস- এর তত্ত্বাবধানে ইংল্যান্ড থেকে ফ্রিমেইনারিরা আমেরিকায় আসতে থাকে। গ্র্যান্ড লজ অভ ইংল্যান্ড হেনরি প্রাইস কে উপনিবেশের অন্যত্র লজ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দেয়। প্রাইস ১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে ফিলাডেলফিয়ায় আরেকটি লজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে যে আমেরিকান বিপ্লব সূচিত হয়েছিল সেই সময়ের আগেই তেরোটি উপনিবেশে প্রায় ১৫০টি লজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । অগ্রসর ইউরোপীয় চেতনা (অর্থাৎ এনলাইটমেন্ট) ধারণ করত বলে বহু মানুষ লজে যোগ দেয়। নতুন উপনিবেশে ফ্রিমেইসনারি গোষ্ঠীটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে।
 ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকান বিপ্লব । ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে উত্তর আমেরিকার তেরোটি উপনিবেশ যুদ্ধ ঘোষনা করে। এই বিপ্লবের পরই গঠিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র । বিপ্লবের মূল কারিগরদের অনেকেই ছিলেন ফ্র্রিমেইসন।
১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই প্রতিটি উপনিবেশ শাসন করার জন্য প্রাদেশিক কংগ্রেস গঠিত হয়। তবে তখনও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়নি। যারা ওই সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার কাজে মূল ভূমিকা রাখেন তারা হলেন: বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, জন হ্যানকক, পল রিভেরি, জন মার্শাল, জোসেফ ওয়ারেন এবং জন পল জোন্স। এরা সবাই মেইসন!
ফ্রিমেইসনারি গোষ্ঠী সদস্য হিসেবে জর্জ ওয়াশিংটন বাদে পরবর্তীতে যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন, তারা হলেন-জেমস মনরো, অ্যান্ড্রু জ্যাকসন, জেমস কে. পোল্ক, জেমস বুচানান, অ্যান্ড্রু জনসন, জেমস এ. গারফিল্ড, উইলিয়াম ম্যাককিনলে, থিওডোর রুজভেল্ট, উইলিয়াম হাওয়ার্ড টাফট, ওয়ারেন জি. হার্ডিং, ফ্যাঙ্কলিন ডি.রুজভেল্ট, হ্যারি এস. ট্রুম্যান, জেরাল্ড আর. ফোর্ড। কোনও কোনও গবেষক অবশ্য মনে করেন যে থমাস জেফারসন এবং জেমস ম্যাডিসনও ছিলেন ফ্রিমেইসনারি গোষ্ঠী সদস্য। কিন্তু প্রমাণের অভাবে বিষয়টি নিশ্চিত নয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিপেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রিম্যাসনারি সংঘে দীক্ষিত হন। ফ্রিম্যাসনারি মতবাদ সর্ম্পকে তাঁর ধারণা ছিল অত্যন্ত উঁচু । কেননা, তিনি, অর্থাৎ প্রেসিপেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন ইউরোপের জ্ঞানদীপ্তি যুগের যুক্তিবাদের প্রতি আকৃষ্ঠ হয়েছিলেন। তবে তিনি রাজনৈতিক ব্যস্ততার কারণেই নিয়মিত লজের বৈঠকে অংশ নিতে পারতেন না। ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে ভার্জিনিয়া লজে যে কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয় তাতে জর্জ ওয়াশিংটন কে গ্র্যান্ড মাষ্টার করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল। যদিও জর্জ ওয়াশিংটন সে পদ গ্রহন করতে পারেননি সেই সময়কার যুদ্ধবিক্ষুব্দ রাজনৈতিক ডামাডোলের কারণে ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির অবস্থান ঠিক কোথায় হবে সেটি প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনই নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে ‘ডিসট্রিক্ট অভ কলম্বিয়ার’ পোটোম্যাক নদীর ধারে গড়ে উঠল ভবিষ্যৎ পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী নগর ওয়াশিংটন ডিসি। যে শহরটি কিন্তু অন্য কোনও শহরের মতো নয়। কেন? ওয়াশিংটন ডিসি কে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে একটি ম্যাসনারি-নগর গিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল। এবং সেই উদ্দেশ্যে শহরটি প্রধান প্রকৌশলী বা মাস্টার ম্যাসন হিসেবে Pierre Charles L’Enfante নামে একজন ফরাসি ফ্রিমেইসন কে নিযুক্ত করা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে সপ্তদশ শতক থেকেই এদিকে যেমন ফ্রিমেইসর দের ধ্যানধারণা অনুযায়ী লজ এবং নিগূঢ় প্রতীক সম্বলিত ভবন গড়ে উঠছিল । তেমনি ফ্রিম্যাসনারি মতবাদের তাত্ত্বিক ভিত্তি জোরদার হচ্ছিল বিভিন্ন লেখকদের লেখায়। এদের অন্যতম ছিলেন অ্যালবার্ট পাইক, যিনি ছিলেন একাধারে আইনবিদ, কনফেডারেট কর্মচারী এবং একজন ফ্রিমেইসন। অ্যালবার্ট পাইক ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রিমেইসন লজে যোগ দেন এবং ১৮৭১ সালে একটি বই লিখে ফ্রিমেইসন গোষ্ঠীর কৃত্য ও আচার অনুষ্ঠান নির্ধারণ করে দেন (a book that describes in detail the 33 ranks of Freemasonry, the stories and teachings associated with each rank, the rituals connected to each rank, and other lodge proceedings) সে বইয়ের নাম: Morals and Dogma of the Ancient and Accepted Scottish Rite of Freemasonry.
জর্জ ওয়াশিংটন এবং অন্য ম্যাসনারিরা আমেরিকান বিপ্লবে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন বলে মার্কিন সমাজে তারা অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল। সাধারণ মার্কিনীদের মধ্যে তাদের ছিল প্রভূত সম্মান, তাদের জয়জয়াকার। যদিও সাধারণ নাগরিক তাদের গোপন পরিকল্পনা ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি। অবশ্য ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে হাওয়া তাদের বিরুদ্ধে চলে যায়, তাদের সব হিসেব উলটে যায়। উইলিয়াম মরগ্যান নামে নিউইয়র্ক শহরের এক নাগরিক অপহৃত এবং খুন হন ফ্রিম্যাসনারিদের হাতে। উইলিয়াম মরগ্যান ফ্রিম্যাসনারি গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছিল। (ফ্রিম্যাসনারি গোষ্ঠীর নিয়ম এই যে কেউ গোষ্ঠীর গোপন ত্য ফাঁস করে দিলে তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড!) After Morgan announced his intention to publish a book exposing Freemasonry’s “secrets”, he was arrested, kidnapped by Masons, and believed murdered. এতে স্ফূলিঙ্গের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্টজুড়ে ফ্রিমেইসনবিরোধী রোষানল ছড়িয়ে পড়ে । নিউইর্য়কবাসী রাজনীতিবিদ থারলো উইড ম্যাসনারি-বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠন করেন। যারা প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসন এর বিরোধীতা করেছিলেন।
তবে আজও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফ্রিমেইসন গোষ্ঠীর প্রভাব অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন ফ্রিমেইস লেখক এই গোষ্ঠীর পক্ষে নিরন্তর লিখে যাচ্ছেন। এদের একজন বিংশ শতকের ফ্রিম্যাসনারি তাত্ত্বিক ম্যানলি পামার হল । ইনি ১৯২৮ সালে The Secret Teachings of All Ages নামে একটি বই লিখেছেন। তিনি কি বিশ্বাস করতেন? দেখা যাক। ম্যানলি পামার হল লিখেছেন: “Man is a god in the making. And as the mystic myths of Egypt, on the potter’s wheel, he is being molded. When his light shines out to lift and preserve all things, he receives the triple crown of godhood.” The Lost Keys of Freemasonry, p. 92) ম্যানলি পামার হল আরও লিখেছেন: “European mysticism was not dead at the time the United States of America was founded. The hand of the mysteries controlled in the establishment of the new government for the signature of the mysteries may still be seen on the Great Seal of the United states of America. Careful analysis of the seal discloses a mass of occult and Masonic symbols chief among them, the so-called American Eagle. … the American eagle upon the Great Seal is but a conventionalized phoenix.

অধিকাংশ সিক্রেটগুলোই গল্পের আড্ডায় প্রচলিত হলেও, এদের অস্তিত্ব ঠায় বাক্যে অস্বীকার করাটা কিন্তু মোটেও সম্ভব নয়। অন্তত একটা বিষয় তো নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় যে, ম্যাসনারি মোটেও হারিয়ে যাওয়া কিংবা বিলুপ্ত হওয়া কোনো ধর্মবিশ্বাস নয়। বরং ফ্রিম্যাসনরা একাধারে কাজ করে চলেছে, বিশেষ কোনো লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে। যারা ছড়িয়ে আছে, আমাদেরই চারপাশে। মিশে আছে আমাদেরই মাঝে ।