তিব্বত নামটি বলার বা শোনার সাথে সাথে যে আরেকটি শব্দ মনে চলে আসে তা
হচ্ছে “নিষিদ্ধ”। বিশ্ববাসীর কাছে তিব্বত ও এর রাজধানী লাসার পরিচিতি
যথাক্রমে নিষিদ্ধ দেশ এবং নিষিদ্ধ নগরী হিসেবে। কিন্তু কেন তিব্বত বা
লাসাকে নিষিদ্ধ বলা হয় তা অনেকের কাছেই অজানা। আর তাই সবার মনেই রয়েছে
তিব্বত সম্পর্কে জানার কৌতূহল। চলুন তাহলে জেনে নেয়া যাক নিষিদ্ধ নগরীর
রহস্য সম্পর্কে-
তিব্বত মূলত আলাদা কোন দেশ হিসেবে স্বীকৃত নয়। এটি চীনের একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল যদিও অনেক তিব্বতি একে চীনের অংশ মানতে রাজি নয়।সমগ্র পৃথিবী যে সব ভূগোলবিদরা চষে বেড়িয়েছেন তিব্বত অঞ্চলটি তাদের কাছেও একটি রহস্যেঘেরা অঞ্চল।
তিব্বত রয়েছে হিমালয়ের উত্তরে। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে ত্রয়োদশ দালাইলামা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত গণচীনের একটি স্বশাসিত অঞ্চল তিব্বত। যদিও চীন ও তিব্বতের কিছু মানুষ প্রায়শই তিব্বতকে নিজেদের অংশ বলেই দাবি করেন। এটাও সত্যি সেখানকার অনেক তিব্বতীয় আবার এই অঞ্চলকে চীনের অংশ মানতে রাজি নয়। ১৯৫৯ সালে গণচীনের বিরুদ্ধে তিব্বতিরা স্বাধিকার আন্দোলন করেছিল। অবশ্য সেটি ব্যর্থ হয়েছিল।তখন দালাইলামার নেতৃত্বে অসংখ্য তিব্বতি ভারত সরকারের আশ্রয় গ্রহণপূর্বক হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায় বসবাস শুরু করেন। সেখানে স্বাধীন তিব্বতের নির্বাসিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।সেখানে স্বাধীন তিব্বতের নির্বাসিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানেও তিব্বতিরা নিজেদেরকে চীনের অংশ হিসেবে ভাবেন না। তিব্বতের রাজধানীর নাম লাসা। তিব্বতের অধিকাংশ মানুষই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।
পৃথিবীর
সকল দেশ সম্পর্কে সবাই বিস্তারিত জানলেও তিব্বতের মতো অজ্ঞাত দেশ পৃথিবীতে
আর একটিও নেই। তিব্বতের প্রকৃতি ও পরিবেশ এতই দুর্গম যে তার কারণে এটি
সবার কাছে অপরিচিত থেকে গেছে।মানুষ কেন সেখানে যেতে পারছে না? আসলে তিব্বত খুবই দুর্গম। প্রকৃতি চোখ
ধাঁধিয়ে দিলে সেখানে পৌঁছানো খুব কঠিন। কিছুক্ষেত্রে জীবন ধারণ করা রীতিমতো
ভয়ঙ্কর। প্রাণ শঙ্কার কথা যদি ওঠে তবে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তে হয়। একটু
ভেবে দেখুন লাসার চারদিক। রাজধানী লাসা থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে
রয়েছে মরুভূমি। গোবি মরুভূমি। বালুর সমুদ্র। এদিক দিয়ে লাসায় পা বাড়ানোর
কথা কেউ ভাববে না এটা চোখ বন্ধ করেই বলা যায়।
এটি পেরিয়ে তিব্বতে আসা সত্যিকার অর্থেই প্রাণঘাতী। দুর্গম পাহাড় পেরোনোর তো প্রশ্নই ওঠে না। যে কারণে শত শত বছর মানুষ তিব্বতকে এড়িয়ে চলেছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো তিব্বতের উচ্চতা। পাহাড় ঘেরা তিব্বত যেন পৃথিবীবাসীর কাছ থেকে মুখ লুকিয়ে রেখেছে। তিব্বতের বেশিরভাগ ভূ-ভাগ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬ হাজার ফুটেরও ওপরে অবস্থিত। এই উচ্চতার স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস চালানো মোটেই সম্ভব নয়। বাইরের জগতের মানুষের কাছে সেটি এড়িয়ে যাওয়াটাই প্রথম ও একমাত্র সিদ্ধান্ত। এই উচ্চতায় বসবাস করা সম্ভব নয় বলেই লাসার দিকে পা বাড়ায়নি কেউ। লাসা এতই উঁচু যে, একে পৃথিবীর ছাদ বলা হয়ে থাকে। এ তো গেল উচ্চতা। এবার বিরূপ আবহাওয়ার দিকটাও জেনে নেওয়া যায়। তিব্বতের স্থল ভাগ বছরের প্রায় ৮ মাস তুষারে ঢেকে থাকে। এই শীতে জীবন ধারণ কঠিনতর। যোগাযোগ ব্যবস্থা বলে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এসব কারণে বহুকাল ধরেই তিব্বতকে নিয়ে বহু রহস্য ঘুরপাক খাচ্ছে। এগুলোর কিছুটা মিথ। কিছুটা সত্য। সবটাই তিব্বতের রাজধানী লাসাকে ঘিরে। একসময় লাসায় বহির্বিশ্বের কারও ঢোকার অনুমতি ছিল না। লাসায় বাইরের বিশ্ব থেকে কারও প্রবেশ করার আইন না থাকাই এই অঞ্চলটি দীর্ঘ দিন ধরে সবার কাছে একটি রহস্যময় জগৎ হিসেবে পরিচিত ছিল। সম্রাট সগেন পো তিব্বতের রাজধানী লাসা নগরীর প্রতিষ্ঠাতা। ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট একটি বিরাট জলাশয় ভরাট করে প্রাসাদ এবং মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তিব্বতের বিভিন্ন মন্দিরের ভিতরে সোনার তৈরি বড় বড় প্রদীপ মাখন দিয়ে জ্বালানো থাকে। ৪ হাজার ভরি ওজনের একটি প্রদীপও সেখানে রয়েছে। তিব্বতের চতুর্দিকে বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য পাহাড় ও গুহা। সেই পাহাড়ি গুহাগুলোতে বাস করে বৌদ্ধ পুরোহিত— লামারা।
তিব্বতিদের মধ্যে ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তাদের প্রধান ধর্মগুরুর নাম দালাইলামা। ধর্মগুরু বা দালাইলামা বাস করেন সোনার চূড়া দেওয়া পোতালা প্রাসাদে। লাসা নগরীতে ছিল বিখ্যাত
পোতালা নামক একটি প্রাসাদ। এই প্রাসাদটি
প্রথমবারের মতো বহির্বিশ্বের মানুষেরা দেখতে পায় ১৯০৪ সালে। আমেরিকার
বিখ্যাত ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকায় এই বিখ্যাত অট্টালিকার ছবি ছাপা হয়।
তিব্বতের চতুর্দিকে বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য পাহাড় ও গুহা।
সেই পাহাড়ি গুহাগুলোতে বাস করে বৌদ্ধ পুরোহিত লামারা।
১৯৮০ সাল থেকে তিব্বত ভ্রমণের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয় এবং তিব্বতকে পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। যদিও ভ্রমণের নিয়ম কানুনের কঠোরতা কিছুটা রয়েই গিয়েছে।
তিব্বতিদের জীবন যাপন আর সামাজিক রীতিনীতি অনেকাংশেই ধর্ম নির্ভর। তাদের এই সকল ধর্মীয় এবং সামাজিক রীতিনীতিও অনেকটা রহস্যময়।তাদের প্রধান ধর্মগুরুর নাম দালাইলামা। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা তিব্বতে লামা নামে পরিচিত। লামা শব্দের অর্থ সর্বপ্রধান, আর দালাই শব্দের অর্থ জ্ঞান সমুদ্র। অর্থাৎ দালাইলামা শব্দের অর্থ হচ্ছে জ্ঞান সমুদ্রের সর্বপ্রধান।১৩৯১ সালে প্রথম দালাইলামার আবির্ভাব ঘটে। দালাইলামাকে তিব্বতিরা বুদ্ধের অবতার মনে করে থাকে। তিব্বতিদের বিশ্বাস, যখনই কেউ দালাইলামার পদে অভিষিক্ত হয় তখনই ভগবান বুদ্ধের আত্মা তার মধ্যে আবির্ভূত হয়। এক দালাইলামার মৃত্যুর পর নতুন দালাইলামার নির্বাচন হয়। দালাইলামা নির্বাচনের পদ্ধতিটাও বেশ রহস্যময় এবং রোমাঞ্চকর।নতুন দালাইলামাকে নির্বাচন করা নয় বরং তার খোঁজ করা হয়। কারণ এটা বিশ্বাস করা হয় যে মৃত্যুর পর নতুন শরীর বাছাই করে তার মাধ্যমে তিনি পুনর্জন্ম লাভ করেন। এর মানে হচ্ছে নতুন দালাইলামা মৃত দালাইলামার পুনর্জন্ম লাভকৃত রূপ।
পুনর্জন্ম নেয়া দালাইলামার খোঁজ করার দায়িত্ব থাকে উচ্চ স্থানীয় লামাদের এবং তিব্বত সরকার এর। আর এই নতুন দালাইলামার খোঁজ করতে অনেক সময় বছরের পর বছর লেগে যায় এবং তা তিব্বতের অভ্যন্তরেই সীমাবদ্ধ থাকে। ১৪ তম দালাইলামার খোঁজ করতে চার (৪) বছর লেগে যায়।
কোন দালাইলামা মারা গেলে নতুন লামার খোঁজ করতে অন্যান্য লামারা কোন একটা স্বপ্ন বা দিব্যদৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করেন। যখন মৃত লামার দাহ করা হয় তখন তারা এর ধোয়ার গতির দিকে লক্ষ্য রাখে কারণ ঐ দিকেই দালাইলামার পুনর্জন্ম হবে বলে ধরে নেয়া হয়। কোনো লামার মৃত্যু হলে লাসার পূর্বে লহামপূর্ণ সরোবরের তীরে লামারা ধ্যান করতে বসে। ধ্যানযোগে লামারা দেখতে পায় সেই সরোবরে স্বচ্ছ পানির ওপর ভেসে উঠছে একটি গুহার প্রতিবিম্ব। যে গুহার পাশে আছে একটি ছোট্ট বাড়ি। প্রধান লামা তার সেই অলৌকিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এঁকে দেবে নতুন দালাইলামার ছবি। বড় বড় লামারা সেই ছবির তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করে। তারপর কয়েকজন লামা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে তিব্বতের বিভিন্ন স্থানে যায় শিশু অবতারের খোঁজে। তারা তিব্বতের ঘরে ঘরে গিয়ে সেই ছবির হুবহু শিশুটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। আর এভাবেই তারা খুঁজে বের করে তাদের নতুন দালাইলামাকে।
তিব্বতিদের খাবার-দাবারের মধ্যেও রয়েছে রহস্য। মজার ব্যাপার হলো, তিব্বতিরা উকুন খায়। একাধিক পর্যটকের বিবরণ থেকে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, বছর পঞ্চাশেক আগে এক পর্যটক সেই নিষিদ্ধ দেশে গিয়ে এ দৃশ্য দেখে লিখেছিলেন, "তিব্বতিরা সহজে গোসল করতে চায় না। শুকনো থাকার মধ্যে তাদের এক রকম স্বাচ্ছন্দ্য রয়েছে। তবে সেজন্য তাদের ভোগান্তিরও শেষ নেই। এ ক্ষেত্রে অনেকের দেহেই উকুন বাসা বাঁধে। মেয়েদের পরনে থাকে গরম কাপড়ের ছুপা, উপরে চাপানো থাকে রেশম, এন্ডি অথবা মুগার রঙিন জ্যাকেট। সেই সঙ্গে থাকে সুতির ঘাঘরা। পোশাকের যে অংশ গায়ের সঙ্গে সেঁটে থাকে, উকুন সেখানেই বাসা বাঁধে”।
কিন্তু তিব্বতের এমন কয়েকটা রহস্য রয়েছে যার সমাধান এখনো কেউ করতে পারেনি। চলুন জেনে নিই সেগুলো সম্পর্কে-
-- ইয়েতি রহস্য: তিব্বতি ইয়েতি নামটির মানে হল কুৎসিত তুষার মানব। এই ইয়েতি হলো গরিলা বা শিম্পাঞ্জীর মত দেখতে একটি প্রাণী যার বাস হিমালয়ের তিব্বত ও নেপালের মধ্যবর্তী অঞ্চলে। ইয়েতির সন্ধানে অনেক অভিযান চালানো হয়েছে কিন্তু শুধুমাত্র এর বিশালাকৃতির পদচিহ্ন ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি।
-- শাম্ভালা বা শাংরি-লা রহস্য: শাম্ভালা বা শাংরি-লা মানে হচ্ছে পবিত্র স্থান। বৌদ্ধ পুরাণ অনুযায়ী এই স্থানই তন্ত্র মন্ত্র ও যাদুবিদ্যা শিক্ষার জন্মস্থান। এছাড়াও বৌদ্ধ পণ্ডিতরা এই স্থানকে কাল্পনিক স্বর্গ বলেও মনে করে। কিন্তু শাম্ভালার অস্তিত্ব রয়েছে কি নেই তা আজও রহস্য।
-- লাল রঙের তুষার: হিমালয়ের পাদদেশ থেকে ৫,০০০ মিটার উচ্চতায় প্রায়ই টুকটুকে লাল রঙের তুষার দেখা যায়। বরফের উপর জন্মানো এক ধরনের শ্যাওলার কারণে তুষারের রঙ লাল দেখা যায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এটা যে মাইনাস ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কঠিন বরফের স্তরে এই উদ্ভিদ জীবন ধারণ করে কিভাবে।
যাই হোক, সময়ের সাথে সাথে তিব্বতিদের জীবন ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন এসেছে এবং তিব্বতের রহস্যও অনেক উন্মোচিত হয়েছে। কিন্তু তারপরও বিশ্ববাসীর কাছে তিব্বত একটি রহস্যময় অঞ্চল।
তিব্বত মূলত আলাদা কোন দেশ হিসেবে স্বীকৃত নয়। এটি চীনের একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল যদিও অনেক তিব্বতি একে চীনের অংশ মানতে রাজি নয়।সমগ্র পৃথিবী যে সব ভূগোলবিদরা চষে বেড়িয়েছেন তিব্বত অঞ্চলটি তাদের কাছেও একটি রহস্যেঘেরা অঞ্চল।
তিব্বত রয়েছে হিমালয়ের উত্তরে। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে ত্রয়োদশ দালাইলামা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত গণচীনের একটি স্বশাসিত অঞ্চল তিব্বত। যদিও চীন ও তিব্বতের কিছু মানুষ প্রায়শই তিব্বতকে নিজেদের অংশ বলেই দাবি করেন। এটাও সত্যি সেখানকার অনেক তিব্বতীয় আবার এই অঞ্চলকে চীনের অংশ মানতে রাজি নয়। ১৯৫৯ সালে গণচীনের বিরুদ্ধে তিব্বতিরা স্বাধিকার আন্দোলন করেছিল। অবশ্য সেটি ব্যর্থ হয়েছিল।তখন দালাইলামার নেতৃত্বে অসংখ্য তিব্বতি ভারত সরকারের আশ্রয় গ্রহণপূর্বক হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায় বসবাস শুরু করেন। সেখানে স্বাধীন তিব্বতের নির্বাসিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।সেখানে স্বাধীন তিব্বতের নির্বাসিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানেও তিব্বতিরা নিজেদেরকে চীনের অংশ হিসেবে ভাবেন না। তিব্বতের রাজধানীর নাম লাসা। তিব্বতের অধিকাংশ মানুষই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।
এটি পেরিয়ে তিব্বতে আসা সত্যিকার অর্থেই প্রাণঘাতী। দুর্গম পাহাড় পেরোনোর তো প্রশ্নই ওঠে না। যে কারণে শত শত বছর মানুষ তিব্বতকে এড়িয়ে চলেছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো তিব্বতের উচ্চতা। পাহাড় ঘেরা তিব্বত যেন পৃথিবীবাসীর কাছ থেকে মুখ লুকিয়ে রেখেছে। তিব্বতের বেশিরভাগ ভূ-ভাগ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬ হাজার ফুটেরও ওপরে অবস্থিত। এই উচ্চতার স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস চালানো মোটেই সম্ভব নয়। বাইরের জগতের মানুষের কাছে সেটি এড়িয়ে যাওয়াটাই প্রথম ও একমাত্র সিদ্ধান্ত। এই উচ্চতায় বসবাস করা সম্ভব নয় বলেই লাসার দিকে পা বাড়ায়নি কেউ। লাসা এতই উঁচু যে, একে পৃথিবীর ছাদ বলা হয়ে থাকে। এ তো গেল উচ্চতা। এবার বিরূপ আবহাওয়ার দিকটাও জেনে নেওয়া যায়। তিব্বতের স্থল ভাগ বছরের প্রায় ৮ মাস তুষারে ঢেকে থাকে। এই শীতে জীবন ধারণ কঠিনতর। যোগাযোগ ব্যবস্থা বলে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এসব কারণে বহুকাল ধরেই তিব্বতকে নিয়ে বহু রহস্য ঘুরপাক খাচ্ছে। এগুলোর কিছুটা মিথ। কিছুটা সত্য। সবটাই তিব্বতের রাজধানী লাসাকে ঘিরে। একসময় লাসায় বহির্বিশ্বের কারও ঢোকার অনুমতি ছিল না। লাসায় বাইরের বিশ্ব থেকে কারও প্রবেশ করার আইন না থাকাই এই অঞ্চলটি দীর্ঘ দিন ধরে সবার কাছে একটি রহস্যময় জগৎ হিসেবে পরিচিত ছিল। সম্রাট সগেন পো তিব্বতের রাজধানী লাসা নগরীর প্রতিষ্ঠাতা। ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট একটি বিরাট জলাশয় ভরাট করে প্রাসাদ এবং মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তিব্বতের বিভিন্ন মন্দিরের ভিতরে সোনার তৈরি বড় বড় প্রদীপ মাখন দিয়ে জ্বালানো থাকে। ৪ হাজার ভরি ওজনের একটি প্রদীপও সেখানে রয়েছে। তিব্বতের চতুর্দিকে বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য পাহাড় ও গুহা। সেই পাহাড়ি গুহাগুলোতে বাস করে বৌদ্ধ পুরোহিত— লামারা।
তিব্বতিদের মধ্যে ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তাদের প্রধান ধর্মগুরুর নাম দালাইলামা। ধর্মগুরু বা দালাইলামা বাস করেন সোনার চূড়া দেওয়া পোতালা প্রাসাদে। লাসা নগরীতে ছিল বিখ্যাত
পোতালা |
১৯৮০ সাল থেকে তিব্বত ভ্রমণের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয় এবং তিব্বতকে পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। যদিও ভ্রমণের নিয়ম কানুনের কঠোরতা কিছুটা রয়েই গিয়েছে।
তিব্বতিদের জীবন যাপন আর সামাজিক রীতিনীতি অনেকাংশেই ধর্ম নির্ভর। তাদের এই সকল ধর্মীয় এবং সামাজিক রীতিনীতিও অনেকটা রহস্যময়।তাদের প্রধান ধর্মগুরুর নাম দালাইলামা। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা তিব্বতে লামা নামে পরিচিত। লামা শব্দের অর্থ সর্বপ্রধান, আর দালাই শব্দের অর্থ জ্ঞান সমুদ্র। অর্থাৎ দালাইলামা শব্দের অর্থ হচ্ছে জ্ঞান সমুদ্রের সর্বপ্রধান।১৩৯১ সালে প্রথম দালাইলামার আবির্ভাব ঘটে। দালাইলামাকে তিব্বতিরা বুদ্ধের অবতার মনে করে থাকে। তিব্বতিদের বিশ্বাস, যখনই কেউ দালাইলামার পদে অভিষিক্ত হয় তখনই ভগবান বুদ্ধের আত্মা তার মধ্যে আবির্ভূত হয়। এক দালাইলামার মৃত্যুর পর নতুন দালাইলামার নির্বাচন হয়। দালাইলামা নির্বাচনের পদ্ধতিটাও বেশ রহস্যময় এবং রোমাঞ্চকর।নতুন দালাইলামাকে নির্বাচন করা নয় বরং তার খোঁজ করা হয়। কারণ এটা বিশ্বাস করা হয় যে মৃত্যুর পর নতুন শরীর বাছাই করে তার মাধ্যমে তিনি পুনর্জন্ম লাভ করেন। এর মানে হচ্ছে নতুন দালাইলামা মৃত দালাইলামার পুনর্জন্ম লাভকৃত রূপ।
পুনর্জন্ম নেয়া দালাইলামার খোঁজ করার দায়িত্ব থাকে উচ্চ স্থানীয় লামাদের এবং তিব্বত সরকার এর। আর এই নতুন দালাইলামার খোঁজ করতে অনেক সময় বছরের পর বছর লেগে যায় এবং তা তিব্বতের অভ্যন্তরেই সীমাবদ্ধ থাকে। ১৪ তম দালাইলামার খোঁজ করতে চার (৪) বছর লেগে যায়।
কোন দালাইলামা মারা গেলে নতুন লামার খোঁজ করতে অন্যান্য লামারা কোন একটা স্বপ্ন বা দিব্যদৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করেন। যখন মৃত লামার দাহ করা হয় তখন তারা এর ধোয়ার গতির দিকে লক্ষ্য রাখে কারণ ঐ দিকেই দালাইলামার পুনর্জন্ম হবে বলে ধরে নেয়া হয়। কোনো লামার মৃত্যু হলে লাসার পূর্বে লহামপূর্ণ সরোবরের তীরে লামারা ধ্যান করতে বসে। ধ্যানযোগে লামারা দেখতে পায় সেই সরোবরে স্বচ্ছ পানির ওপর ভেসে উঠছে একটি গুহার প্রতিবিম্ব। যে গুহার পাশে আছে একটি ছোট্ট বাড়ি। প্রধান লামা তার সেই অলৌকিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এঁকে দেবে নতুন দালাইলামার ছবি। বড় বড় লামারা সেই ছবির তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করে। তারপর কয়েকজন লামা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে তিব্বতের বিভিন্ন স্থানে যায় শিশু অবতারের খোঁজে। তারা তিব্বতের ঘরে ঘরে গিয়ে সেই ছবির হুবহু শিশুটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। আর এভাবেই তারা খুঁজে বের করে তাদের নতুন দালাইলামাকে।
তিব্বতের লামারা সহ সাধারণ মানুষেরাও প্রেতাত্নাকে খুবই ভয়
পায়। তারা সর্বদা প্রেতাত্মার ভয়ে আড়ষ্ট থাকে। লামারা প্রেতাত্মাদের খুঁজে বেড়ায়
তাদের হাত থেকে সাধারণ মানুষদের রক্ষা করার জন্য। অধিকাংশ তিব্বতির ধারণা, মানুষের
মৃত্যুর পর দেহের ভেতর থেকে প্রেতাত্মারা মুক্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে।
ওই প্রেতাত্মার লাশ সৎকার হওয়ার আগ পর্যন্ত সে মানুষের ক্ষতি করার জন্য ঘুরে
বেড়ায়। তারা কখনও মানুষের উপর ভর করে, কখনো পশু-পাখি কিংবা কোনও গাছ অথবা পাথরের
উপরও ভর করে। প্রেতাত্নাদের হাত থেকে বাচতে ও প্রেতাত্মাদের খুশি রাখতে তিব্বতিরা পূজা
করে থাকে। এই পূজার আবার রয়েছে বিশেষ লগ্ন। লগ্নের সময় আসলে বিশেষ মুখোশ পরে ভূত-পিশাচ সেজে
পূজা করে তিব্বতিরা।
তিব্বতে সরকারি ভাষা হিসেবে চীনা ভাষার প্রচলন থাকলেও তিব্বতিদের
ভাষার রয়েছে সুপ্রাচীন
ইতিহাস। তাই চীনের বেশ কিছু প্রদেশ এবং ভারত, পাকিস্তান, নেপাল
ও ভুটানে
তিব্বতি ভাষাভাষী মানুষ রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে ভাষার আলাদা আলাদা ধরন
রয়েছে। জনজাতি হিসেবে জোংখা,
সিকিমি,
শেরপা এবং লাদাখিরা যে ভাষায়
কথা বলে সেই ভাষার সঙ্গে তিব্বতি ভাষার যথেষ্ট মিল রয়েছে। তিব্বতি
ভাষার নিজস্ব
লিপি এবং লিখন পদ্ধতি রয়েছে। সর্বত্র সে লিপির ব্যবহার নেই, তবে
মূল ভিত্তি এ ভাষা থেকে এসেছে।
তিব্বতিদের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী আচার হলো মৃতদেহের সৎকার। এদের
মৃতদেহ সৎকার পদ্ধতি
খুবই অদ্ভুত। কোনও তিব্বতি যদি মারা যায়, তবে ওই মৃতদেহ কাউকে ছুঁতে দেওয়া
হয় না। ঘরের এক কোণে মৃতদেহটি বসিয়ে চাদর অথবা পরিষ্কার কাপড় দিয়ে ঢেকে
রাখা হয়। মৃতদেহের ঠিক পাশেই জ্বালিয়ে রাখা হয় পাঁচটি প্রদীপ। তারপর পুরোহিত
পোবো লামাকে ডাকা হয়। পোবো লামা একাই ঘরে ঢোকে এবং ঘরের দরজা-জানালা
সব বন্ধ করে দেয়। এরপর পোবো মন্ত্র পড়ে শরীর থেকে আত্মাকে বের
করার চেষ্টা করে। প্রথমে মৃতদেহের মাথা থেকে তিন-চার গোছা চুল টেনে উপরে
আনে। তারপর পাথরের ছুরি দিয়ে মৃতদেহের কপালের খানিকটা কেটে প্রেতাত্মা বের
করার রাস্তা করে দেওয়া হয়। শবদেহ নিয়ে যাওয়ার সময় লামা ডম্বুরু বাজাতে বাজাতে
চলে। শবদেহকে নিয়ে রাখে একটা বড় পাথরের টুকরোর ওপর। ঘাতক একটি মন্ত্র
পড়তে পড়তে মৃতদেহের শরীরে বেশ কয়েকটি দাগ কাটে। দাগ কাটার পর একটি ধারালো অস্ত্র
দিয়ে সেই দাগ ধরে ধরে মৃতদেহকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা হয়। তারপর পশুপাখি, শকুনদের খাইয়ে দেয়া হয়। তিব্বতিদের বিশ্বাস যে শকুন হচ্ছে দেবদূতের
প্রতিরূপ এবং তারা মৃত ব্যক্তির আত্মাকে স্বর্গে নিয়ে যাবে আর সেখানেই
আত্মা পুনর্জন্মের জন্য অপেক্ষা করবে।
তিব্বতে হাজার হাজার বছর ধরে মৃতদেহ সৎকারের জন্য এই প্রথা চলে আসছে এবং তিব্বতের প্রায় ৮০ ভাগ বৌদ্ধ এই প্রথা অনুসরণ করেন। এসব অদ্ভুত কর্মকাণ্ডের বাইরেও তিব্বতের সামাজিক একটা অবস্থা রয়েছে।
তিব্বতের সামাজিক অবস্থার কথা বলতে গেলে বলতে হয় এমন এক সমাজের কথা, যা গড়ে
উঠেছিল আজ থেকে প্রায় ছয় হাজার বছর আগে। তখন পীত নদীর উপত্যকায় চীনারা
জোয়ার ফলাতে শুরু করে। অন্যদিকে আরেকটি দল রয়ে যায় যাযাবর। তাদের মধ্য
থেকেই তিব্বতি ও বর্মী সমাজের সূচনা হয়।
তিব্বতিদের খাবার-দাবারের মধ্যেও রয়েছে রহস্য। মজার ব্যাপার হলো, তিব্বতিরা উকুন খায়। একাধিক পর্যটকের বিবরণ থেকে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, বছর পঞ্চাশেক আগে এক পর্যটক সেই নিষিদ্ধ দেশে গিয়ে এ দৃশ্য দেখে লিখেছিলেন, "তিব্বতিরা সহজে গোসল করতে চায় না। শুকনো থাকার মধ্যে তাদের এক রকম স্বাচ্ছন্দ্য রয়েছে। তবে সেজন্য তাদের ভোগান্তিরও শেষ নেই। এ ক্ষেত্রে অনেকের দেহেই উকুন বাসা বাঁধে। মেয়েদের পরনে থাকে গরম কাপড়ের ছুপা, উপরে চাপানো থাকে রেশম, এন্ডি অথবা মুগার রঙিন জ্যাকেট। সেই সঙ্গে থাকে সুতির ঘাঘরা। পোশাকের যে অংশ গায়ের সঙ্গে সেঁটে থাকে, উকুন সেখানেই বাসা বাঁধে”।
ঐতিহ্যগত তিব্বতি সমাজের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ
যাযাবর বা রাখাল জীবনযাপন। ভেড়া,
ছাগল ও ঘোড়া পালন তাদের প্রধান জীবিকা।
শুধু চীনের তিব্বত
স্বশাসিত অঞ্চলের
মোট জনসংখ্যার ২৪ শতাংশ এই যাযাবর রাখাল সম্প্রদায়। এরা কখনো চাষাবাদের কাজ করে
না। মোট ভূমির ৬৯ শতাংশ এলাকা চারণ বা তৃণভূমি। চীনা ঐতিহ্যের সঙ্গে মিল
রেখে তিব্বতিরাও ভীষণ চা প্রিয়। তাদের বিশেষ চায়ে মেশানো হয় মাখন এবং লবণ।
তবে তিব্বতিদের প্রধান খাবার হলো চমবা। গম এবং যবকে ভেজে পিষে নিয়ে চমবা তৈরি
করা হয়। তারা খাবার পাত্র হিসেবে ব্যবহার করে কাঠের পেয়ালাকে।
আধুনিক বিশ্ব দিন দিন আধুনিক হলেও আজও তিব্বত বিশ্বে
রহস্যময় একটি অঞ্চল। নিষিদ্ধ শহর লাসা আজও সবার কাছে আগ্রহের কেন্দ্র বিন্দু।
বর্তমানে তিব্বতে রাজনৈতিক সমস্যা দেখা দেওয়ায় তিব্বতের বর্তমান দালাইলামা দেশের
বাইরে রয়েছেন ফলে সেখানে বর্তমানে দালাইলামার প্রভাবও অনেক হ্রাস পেয়েছে।
-- ইয়েতি রহস্য: তিব্বতি ইয়েতি নামটির মানে হল কুৎসিত তুষার মানব। এই ইয়েতি হলো গরিলা বা শিম্পাঞ্জীর মত দেখতে একটি প্রাণী যার বাস হিমালয়ের তিব্বত ও নেপালের মধ্যবর্তী অঞ্চলে। ইয়েতির সন্ধানে অনেক অভিযান চালানো হয়েছে কিন্তু শুধুমাত্র এর বিশালাকৃতির পদচিহ্ন ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি।
-- শাম্ভালা বা শাংরি-লা রহস্য: শাম্ভালা বা শাংরি-লা মানে হচ্ছে পবিত্র স্থান। বৌদ্ধ পুরাণ অনুযায়ী এই স্থানই তন্ত্র মন্ত্র ও যাদুবিদ্যা শিক্ষার জন্মস্থান। এছাড়াও বৌদ্ধ পণ্ডিতরা এই স্থানকে কাল্পনিক স্বর্গ বলেও মনে করে। কিন্তু শাম্ভালার অস্তিত্ব রয়েছে কি নেই তা আজও রহস্য।
-- লাল রঙের তুষার: হিমালয়ের পাদদেশ থেকে ৫,০০০ মিটার উচ্চতায় প্রায়ই টুকটুকে লাল রঙের তুষার দেখা যায়। বরফের উপর জন্মানো এক ধরনের শ্যাওলার কারণে তুষারের রঙ লাল দেখা যায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এটা যে মাইনাস ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কঠিন বরফের স্তরে এই উদ্ভিদ জীবন ধারণ করে কিভাবে।
যাই হোক, সময়ের সাথে সাথে তিব্বতিদের জীবন ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন এসেছে এবং তিব্বতের রহস্যও অনেক উন্মোচিত হয়েছে। কিন্তু তারপরও বিশ্ববাসীর কাছে তিব্বত একটি রহস্যময় অঞ্চল।
No comments:
Post a Comment