1325 থেকে 1800 সালের মধ্যে হাই-ব্রাজিল ছিল পৃথিবীর ম্যাপে একটি রহস্যময় ভূখন্ড। আইরিশ জনশ্রুতি অনুযায়ী বলা হয়, এই ভূখণ্ডটি সবসময় রহস্যময় মেঘে বা ধোঁয়াশায় ঢাকা থাকে। কেবলমাত্র সাত বছরের মধ্যে একটি দিন একে দেখা যায় যদিও সেখানে পৌঁছানো যায় না।
এই ভূখন্ডের সম্পর্কে পুরো ইউরোপ জুড়ে বহুকাল ধরে প্রবাদ মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়; শোনা যায় এখানে সাধু-সন্ন্যাসীরা বসবাস করে অথবা এটি একটি স্বর্গদ্বার এর মত যেখানে উন্নত সভ্যতার প্রাণীরা বসবাস করে।
বেশিরভাগ মানচিত্র অনুযায়ী এই আইসল্যান্ডটি আয়ারল্যান্ড এর পশ্চিম সমুদ্রতল থেকে থেকে মোটামুটি 321 কিলোমিটার দূরে উত্তর আটলান্টিকের উপর অবস্থিত।
হাই-ব্রাজিল কথাটি এসেছে সেলটিক ইতিহাসের 'breasal' শব্দটি থেকে যার অর্থ পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু রাজা বা সবচেয়ে বড় রাজা। এটিকে 1325 সালে জেনোইস কার্টোগ্রাফার অ্যাঞ্জেলিনা ডালশার্ট 'bracile' নাম দিয়ে নোট করেন।
পরবর্তীকালে এটিকে ক্যাটালান এটলাস ম্যাপে 1375 সালের পাওয়া যায়; যদিও এখানে নামটি 'লা-দে-ব্রাজিল' একই রকম থাকলেও একে দুটি আলাদা দ্বীপ হিসাবে দেখানো হয়। 1436 সালে,
কার্টোগ্রাফার অন্দ্রিয়া বিয়াঙ্কর তৈরি ভেনেটিয়ান ম্যাপে একে সোলা দে ব্রাজিল নামে দেখানো হয় এবং 1595 সালে আবার অর্টেলিয়াস ম্যাপ অফ ইউরোপ এবং ইউরোপা মারকেটর ম্যাপ এ দেখানো হয়; এছাড়া মাঝেমাঝেই বিভিন্ন ম্যাপে কিছুটা আলাদা অবস্থানে বিভিন্ন সময় একে পাওয়া যায়।
1480 সালে জন জে জুনিয়ার ব্রিস্টল থেকে রওনা দেন ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। এই যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল এই কিংবদন্তি দ্বীপটি খুঁজে বের করা। কিন্তু দুই মাস সমুদ্রে কাটানোর পর খালি হাতে ফিরে আসতে হয়েছিল। 1481 সালে 'ট্রিনিটি' এবং 'জর্জ' নামে আরো দুটো জাহাজ ব্রিস্টল থেকে হাই-ব্রাজিল খোঁজার জন্য এক্সপিডিশন করেছিল কিন্তু তাতেও কোনো সাফল্য আসেনি। মজার ব্যাপার হচ্ছে 1497 সালের স্প্যানিশ ডিপ্লোম্যাট পেদ্রো দে আয়লা স্পেনের তৎকালীন ক্যাথলিক রাজাকে রিপোর্ট করেন যে, জন ক্যবট (যিনি প্রথম ইউরোপিয়ান, যে ভাইকিংদের পর উত্তর আমেরিকায় পা রাখেন) ব্রিস্টলের একজনকে খুঁজে পেয়েছেন যিনি সেই ভূখন্ড খুঁজে খুঁজে পেয়েছিল । এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে ব্রিস্টল এক্সপিডিশন এর মধ্যে কেউ একজন সত্তিকারের এই দ্বীপটিকে খুঁজে পেয়েছিল। মোটামুটি 2 শতাব্দি পরে স্কটিশ জাহাজের ক্যাপ্টেন জন নিসবাট দাবি করেন যে তিনি 1674 সালে ফ্রান্স থেকে আয়ারল্যান্ডের উদ্দেশ্যে তার যাত্রাপথে হাই-ব্রাজিল দ্বীপটিকে দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি এটিও বলেন, যে তিনি সেখানে কয়েকজন কে পাঠান এবং নাবিকরা সেই দ্বীপে একটা পুরো দিন কাটায়।
তারা দাবি করে, সেখানে তারা এক বয়স্ক সন্ন্যাসীর সাথে দেখা করেন এবং তিনি তাদের সোনা এবং রুপো দিয়ে অভ্যর্থনা জানান। একটি রহস্যজনক বিষয় হল ক্যাপ্টেন বলেছিলেন দ্বীপটিতে প্রচুর বড় বড় কালো খরগোশ বসবাস করে এবং একজন রহস্যময় জাদুকর যিনি তার তৈরি বিশাল বড় পাথরের তৈরি দুর্গে বসবাস করেন। এরপর ক্যাপ্টেন আলেকজান্ডার জনসন একটি এক্সপিডিশন করেন যাতে তিনিও হাই-ব্রাজিল খুঁজে পান এবং ক্যাপ্টেন নিসবেটের দাবি গুলিকে সত্যি বলে জানান। পরবর্তীকালে হাই-ব্রাজিল আবার অদৃশ্য জগতে চলে যায়। যেহেতু এটা কে খোঁজার প্রচেষ্টা গুলি পরবর্তীকালে আবার ব্যর্থ হতে থাকে তাই বেশিরভাগ ম্যাপ নির্মাতারা একে মানচিত্র তে রাখতে বিরত হোন। 1865 সালে যখন শেষবার এটিকে ম্যাপে দেখা যায় সেখানে এটির বর্ণনা 'ব্রাজিল রক' হিসাবে করা হয়।
হাই-ব্রাজিলের শেষ দেখার ঘটনা নথিভূক্ত করা হয়েছিল 1872 সালে রবার্ট-ও-ফ্লার্টি ও টি-জে-ওয়েস্টরপের দ্বারা।
তারা দাবি করেন যে এর আগে তারা বিভিন্ন উপলক্ষে তিনবার সেই ভূখণ্ডে গিয়েছিলেন এবং সেখানকার বাসিন্দাদের আপ্যায়ন তাদের এতই ভাল লেগেছিল যে পরবর্তীকালে তারা পুরো পরিবারকে সাথে নিয়ে আসেন এবং সেই সময় তারা দেখতে পান হঠাৎ করে দ্বীপটি তাদের সামনে দৃশ্যমান হয়ে উঠলো এবং আবার তাদের চোখের সামনেই অবাক করে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
এই হাই-ব্রাজিলকে নিয়ে প্রচুর কিংবদন্তি এবং পৌরাণিক কথা রয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকটা জায়গায় বলা হয়েছে এই দীপটি আইরিশ পুরান মতে দেবতাদের ঘর। আবার কোথাও কোথাও বলা হয় এখানে সন্ন্যাসী এবং পুরোহিতরা বসবাস করত যাদের কাছে প্রাচীন জ্ঞানের সংগ্রহ ছিল এবং যা ব্যবহার করে তারা উন্নত প্রাণিজগতের জন্য বসতি স্থাপন করে। কোথাও কোথাও বলা হয়ে থাকে হিব্রু বাইবেলে বর্ণিত যে প্রমিস ল্যান্ডের খোঁজে সেন্ট ব্রেন্ডেনের বিখ্যাত যাত্রা হয়েছিল সেটি আসলে এই হাই-ব্রাজিল।
একটি বিখ্যাত ইউএফও সংক্রান্ত ঘটনা ঘটেছিল যেটি 'রেন্দেলসাম ফরেস্ট ইন্সিডেন্ট' হিসাবে পরিচিত তাতে ইউনাইটেড কিংডম এ অবস্থিত ইউ এস এর মিলিটারি বেস এর বাইরে একটি অদ্ভুত রকমের যানের অবতরণের কথা নথিভুক্ত করা হয়েছিল; যেখানে সার্জেন্ট জিম পেনিস্টন সেই যানটি ছুঁতেই টেলিপ্যাথিক কোন প্রক্রিয়ায় তার মাথায় 16 পাতার বাইনারি কোড চলে আসে। পরের দিন তিনি এই কোড গুলি লিখে রাখেন এবং এর মানে বের করা হয় প্রায় কয়েক দশক বাদে। জানতে পারা যায় এই কোডের খুব নির্দিষ্টভাবে কিছু কোঅর্ডিনেট দেওয়া আছে যা পুরনো ম্যাপে বর্ণিত হাই-ব্রাজিলের অবস্থানটির দিকে নির্দেশ করে। কোডের মধ্যে আরো কিছু তথ্য পাওয়া যায় যা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন প্রাচীন নিদর্শন স্থানগুলির অবস্থানকে নির্দেশ করে; যেমন- গিজার পিরামিড, গ্রিসে অ্যাপেলো মন্দির এবং নাজকা লাইন।
সেই কোডটির একেবারে শেষে হাই-ব্রাজিলের কোঅর্ডিনেট গুলোতে তার উৎপত্তি সাল 8100 হিসাবে দেখা গিয়েছিল।
যদিও হারিয়ে যাওয়া সভ্যতা গুলোর মধ্যে আটলান্টিসকে সবচেয়ে বিখ্যাত বলা হয় কিন্তু হাই ব্রাজিলের বিবরণের নথিপত্র এবং প্রত্যক্ষদর্শী এর তুলনায় বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়। একটি কিংবদন্তি যা বহুকাল ধরে লোকমুখে প্রচলিত হয়ে এসেছে সেটি হল যখন শেষ শৈত্য যুগ চলছিল তখন সমুদ্রপৃষ্ঠ অনেকখানি নীচে ছিল। যেমন পর্কুপাইন ব্যাংক নামে স্থানটি 1862 সালে খোঁজ পাওয়া যায় যা দেখে বোঝা যায় এক সময়ে এটি একটি দ্বীপ ছিল।
এটি আয়ারল্যান্ডে পশ্চিম চর থেকে 193 কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এবং 1830 সালের ম্যাপ অনুযায়ী যেখানে 'ব্রাজিল রকের' অবস্থান ছিল তার সবচেয়ে কাছে অবস্থিত। এই স্থানটির সবচেয়ে উঁচু জায়গাটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এখন 200 মিটার নিচে এবং মনে করা হয় ক্যাটাস্ট্রপ বা সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে হয়তো এই দ্বীপটি ডুবে যায়।
বর্তমানে কোন ম্যাপে হাই ব্রাজিল ভূখণ্ডটি পাওয়া যায় না এবং এর কি হয়েছিল তা নিয়েও কোন ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়নি। এটা ইতিহাসের এমন একটি রহস্যময় ও বিতর্কিত ধাঁধা যা হয়ত বর্তমানে আলোচিত হতে পারে।
No comments:
Post a Comment