আয়ারল্যান্ডের পূর্বদিকে নির্জন রাস্তাটি ধরে গাড়ি চালিয়ে গেলে খুব সহজেই সেখানকার সবচেয়ে ভয়ানক ও ভূতুড়ে বাড়িতে পৌঁছে যাওয়া যায়।
এর ঐতিহাসিক দেয়ালগুলি যুদ্ধ, দখল, প্লেগ, দুর্ভিক্ষ এবং প্রচুর ব্যক্তিগত দুঃখদায়ক ঘটনার সাথে ভুতুড়ে প্রবাদ গুলি বয়ে নিয়ে চলেছে।
লোফটাস হলের নথিভুক্ত ইতিহাস প্রায় 800 বছরের বেশি পুরনো কিন্তু স্থানীয়দের মতে এই স্থানটি জুড়ে প্রায় হাজার বছর আগের ইতিহাস জুড়ে রয়েছে একসময় এটি ড্রুইডস এবং প্রাচীনকালের উচ্চমানের পেশাদার এবং ধর্মীয় সংগঠন সেলটিক এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে।
গল্পটি শুরু হয় 1170 সাল থেকে যখন রেমন্ড বা লে গস নামক ব্যক্তি হুক পেনিসুএলার বাগিনবুনে যা এখন আয়ারল্যান্ডের ওয়্যাক্সফর্ড গ্রাম হিসেবে পরিচিত, সেখানে আসেন। রেমন্ড নরমান নাইটদের সদস্য ছিলেন যিনি আয়ারল্যান্ডে নরমানদের শাসন আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি জমি দখল করার পর সেই স্থানটিতে দুর্গ তৈরি করেন যার নামকরণ হয় - 'হাউসলান ক্যাসেল'। বহু বছর বাদে এটি ভগ্নদশা প্রাপ্ত হলে 1350 সালে রেমন্ডের বংশধররা একটি নতুন দুর্গ তৈরি করে যার নাম দেয় 'দি হল' বা 'রেদমন্ড দুর্গ'।
এই ভবনটি রেডমন্ড পরিবারের সঙ্গে প্রায় 1616 সাল অব্দি থাকে কিন্তু এরপর আইরিশ কনফেডারেট ওয়ার শুরু হয় এবং দুর্গটি পরপর আক্রমণের শিকার হয় এবং অবশেষে ক্রমওয়ালিয়ান্ডের দাঁড়া অধিগ্রহণ করা হয়। একটি উল্লেখযোগ্য লড়াইয়ের ঘটনা ঘটে 20 জুলাই, 1642 সালে যখন আলেকজান্ডার রেডমন্ড যিনি তখন 68 বছর বয়সে ছিলেন তিনি তার দুই ছেলে, কিছু ভাড়াটিয়া, দুইজন সৈনিক এবং একজন দর্জির সাহায্যে প্রায় 90 জন ইংরেজ আক্রমণকারী থেকে ভবনটিকে রক্ষা করতে সফল হন।
তারা এরপর আরও কিছু আক্রমণ করে এবং এরপর আলেকজান্ডার কে ক্রমওয়েল এর থেকে লাভজনক এক পদের প্রস্তাব দেওয়া হয়। 1651 সাল নাগাদ আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয় এবং বাড়িটি নিলামে দেওয়া হয়। 1666 সালে ইংল্যান্ডের ইর্কশিয়ারের হেনরি লফটাস বাজেয়াপ্ত জমিটি কিনে নেন এবং ম্যানশন এর নাম রাখেন 'loftus হল'।
এরপর বেশ কয়েক যুগ ধরে loftus পরিবার উন্নতি করতে থাকে এবং এক এক করে দেশের বিভিন্ন পদমর্যাদার এর সাথে এগিয়ে যেতে থাকে। তাদের আকাঙ্ক্ষা থাকে যে একদিন তারা রানী ভিক্টোরিয়া পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারবেন।
এই আকাঙ্খার সাথে তৎকালীন বংশধর জন হেনরি লোফটাস যিনি চতুর্থ মারকেশ পদাধিকারী ছিলেন, ভবনটির পুনঃনির্মাণ শুরু করেন 1870 থেকে 1879 সালে এবং এটিকে আগের থেকে আরও শ্রেষ্ঠ করে তোলেন। যদিও বলা হয় যে পুরো দুর্গটিকেই ভেঙ্গে নতুন করে তৈরি করা হয়েছিল কিন্তু প্রমাণ পাওয়া গেছে যে পুরনো হলের অনেকটাই রয়ে গেছে যা পুনর্নির্মাণের সময় ব্যবহার করা হয়েছিল এবং সেখানে কাজ করা হয়েছিল।
এই কাজে টাকা পয়সার কোন অভাব রাখা হয়নি। থ্রি-স্টোরি ম্যানশন যা খুব ব্যয়বহুল দ্রব্য ও আসবাব দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল যা সত্যিই রাজকীয় ছিল এবং ইটালিয়ান শিল্পীদের হাতে তৈরি কারুকার্য এখানে ছিল। বাড়িটি সত্যিই একজন রানীর থাকার পক্ষে উপযোগী ছিল। কিন্তু কুইন ভিক্টোরিয়া লোফটাস পরিবারের প্রতি তার হতাশার কারণে কখনও সেখানে যাননি।
যদিও এটির ঐতিহাসিক তাৎপর্যময় এবং অভিজাত্ত পূর্ণ ও রঙিন অতীত ছিল কিন্তু পরবর্তীকালে অবর্ণনীয় রহস্য এবং ভৌতিক বিভিন্ন ঘটনা এই স্থানটিকে আয়ারল্যান্ডের সবচেয়ে ভুতুড়ে দুর্গে পরিণত করে। কিংবদন্তি ঘটনার সূত্রপাত এনা টটেনহ্যামের জন্ম ও মৃত্যু ঘিরে। 1600 শতকের মাঝের দিকে চার্লস টটেনহ্যাম এনা লোফটাস কে বিবাহ করেন যিনি প্রথম শেরিফ, লোফটাসএর কন্যা ছিলেন এবং পরবর্তীকালে তাদের 6 জন সন্তান হয় চারজন ছেলে এবং দুইজন মেয়ে এলিজাবেথ এবং এনা কিন্তু যখন তার মেয়েরা খুব ছোট ছিল তার পত্নী অসুস্থ হয়ে মারা যান। দুই বছর বাদে টটেনহ্যাম আবার তার নিকট আত্মীয় জেন ক্লিফ কে বিবাহ করেন এবং তারা এনার সাথে লোফটাস হলে বসবাস করতে থাকেন। একদিন এক বিশাল ঝড়ের সময় একটি জাহাজ হুক পেনিন্সুয়ালায় অবতরণ করে এবং সেখান থেকে এক যুবক লোফটাস হলে আসে এবং তাদের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে। আগন্তকদের আনাগোনা এখানে খুব একটা অবাক করা বিষয় ছিল না কারণ, সাউথ ওয়্যাক্সফর্ডের সমুদ্রতীরে জল খুব একটা ভালো না থাকার কারণে অনেক সময়ই এইখান দিয়ে যাওয়ার সময় জাহাজকে দাঁড়াতে হতো অথবা এই কারণে অনেক সময় পাথরের সাথে ধাক্কা খাওয়ার কারণে মেরামতির জন্য দাঁড়াতে হত। যুবকটিকে অভ্যর্থনা জানানো হল এবং অবশেষে সে সেখানে কয়েক সপ্তাহ জন্য থেকে গেল। এই সময়ে এনা যে কম বয়সী যুবতী ছিল, আগন্তুক এর প্রেমে পড়ে গেল এবং ঘন্টার পর ঘন্টা তারা কথা বলতে থাকতো। স্থানীয় কিংবদন্তি গল্প থেকে জানা যায় এক রাত্রে এনা, সেই আগন্তুক এবং অন্যান্য অতিথিরা একসাথে তাস খেলছিল সেই সময় এনার হাত থেকে একটি কার্ড নিচে পড়ে যায় এবং সেটা তুলতে গেলে এনা দেখতে পায় আগন্তুক এর পায়ের জায়গায় খুর আছে। এটা দেখেই সে ভয়ে চেঁচিয়ে ওঠে যার ফলে আগন্তুক তার আসল চেহারা শয়তান প্রতিরূপ অবতরণ করে সে একটি আগুনের গোলায় রূপান্তরিত হয়ে ছাদ ভেঙ্গে লাফিয়ে বেরিয়ে যায় এবং এর ফলে এনা একটি মানসিক ধাক্কা খায় যা কোনদিনও ঠিক হয় না।
এনার মানসিক অবস্থা ক্রমশ অবনতির দিকে এগোতে থাকে এবং তার পরিবার তার আচরণে অবসাদগ্রস্থ হয়ে, বাড়ির একটি ঘরে ঘরে আটকে রেখে দেয় যেখানে সে 1775 সালে তার মৃত্যু অবধি অবস্থান করতো। বলা হয় এরপর থেকেই লোফটাস হলে ভৌতিক উপদ্রব শুরু হয়; অতীতের ঘটনাটি এনাকে শান্তিতে মরতে দেয়নি। সেই পরিবার এইটাকে থামানোর জন্য এবং শয়তানি শক্তি থেকে গৃহ কে বাঁচানোর জন্য অনেক রকম প্রটেস্টান্ট পাদ্রীদের ডেকে আচার-আচরণ করানো হয়েছিল কিন্তু সব কিছুতেই বিফল হতে হলো।এরপর প্রটেস্টান্ট হওয়া সত্বেও তারা এক ক্যাথলিক পাদ্রীকে ডেকেছিলেন যিনি তাদেরই রাজ্যের এক ভাড়াটিয়া ছিলেন। ফাদার থমাস নামে পাদ্রী বাড়িটিকে সাফল্যের সাথে নেগেটিভ শক্তি মুক্ত করেন। এই স্থানে সব জায়গাতেই শোনা যায় যে থমাস নামক পাদ্রির সমাধিতে লেখা হয়েছিল, "এইখানে শুয়ে আছেন থমাস ব্রুডার। যিনি সবার জন্য প্রার্থনা করেছেন এবং ভালো কাজ করেছেন এবং তিনি লোফটাস হল থেকে শয়তানকে দূর করতে সক্ষম হয়েছেন।" যদিও এর সেরকম কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
একটা প্রশ্ন সকলের মনে আসে যে এনাকে কি সত্যি মানসিক অসুস্থতার কারণে বন্দী করে রাখা হয় নাকি এর পিছনে অন্য কোন রহস্য ছিল। আরো একটি ভিন্ন মত অনুযায়ী বলা হয় আগন্তুক এনার প্রেমে পড়ে যায় এবং চার্লস টটেনহ্যামের কাছে এনাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয় কিন্তু অনুমতি পাওয়া যায় না ।এরপর সে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় এনাকে ভগ্নহৃদয় রেখে।
কিন্তু গল্পে আরো একটি মোর আসে যখন পরবর্তীকালে লোফটাস হল পুনর্নির্মিত করা হয় । যে ঘরটিতে এনাকে বন্দী রাখা হয়েছিল তার দেওয়ালের ভিতর একটি ছোট বাচ্চার কঙ্কাল খুঁজে পাওয়া যায়। তবে কি এনা আগন্তুক এর বাচ্চার মা হয়েছিল? যা পরিবারের পক্ষে লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল? এটাও একটা কারণ হতে পারে যার জন্য হয়তো তার পিতা তাকে আটকে রেখেছিল । আরেকটি স্থানীয় মত অনুযায়ী বলা হয়, এনা বাচ্চা প্রসবের সময় মারা যায় কারণ তার বাবা চাইছিল না কেউ তার গর্ভাবস্থার কথা জানতে পারুক এমনকি স্থানীয় ডাক্তারও ফলে সে গর্ভাবস্থা জনিত সমস্যার কারনে মারা যেতে পারে। বর্তমানে এনা টটেনহ্যামের সমাধিটি ওয়্যাক্সফর্ড এর স্থানীয় কবরখানায় অবস্থিত। কিন্তু এখানে একটি অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করা গেছে সেটি হল আশেপাশের অন্যান্য কবর গুলির তুলনায় এই খবরটি পুরোপুরি সিমেন্ট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। যারা তাকে কবর দিয়েছিল তারা চেয়েছিল যাতে আর কেউ তার দেহ ছুঁতে না পারে। এনা তার কবরের সাথে কি এমন ভয়ঙ্কর গোপনীয় বিষয় নিয়ে গেছিল?
লোফটাস হল তার অন্ধকারময় এবং ও শান্তিপূর্ণ ইতিহাসের জন্য ভুতুড়ে মনে হতে পারে। কেউ সেখানে গেলে এর দেওয়ালের দুঃখ এবং আঘাত গুলি অনুভব করতে পারবে। কিন্তু সত্যিই কি এনার ভূত এখনো সেই ঠান্ডা এবং খালি ঘরগুলো জুড়ে ঘুরে বেড়ায়? অনেকেই বিশ্বাস করেন সত্যি। 'আমেরিকান ঘোস্ট হান্টার্স' নামক দলটি এখানে একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করেন এবং দাবি করেন এখানে অনেক গুলি ব্যতিক্রমী ঘটনা তারা লক্ষ্য করেন।
কিন্তু 2014 সালে লোফটাস হল আয়ারল্যান্ডের সবচেয়ে ভুতুড়ে বাড়ির মর্যাদা পায় যখন একজন দর্শনার্থী দাবি করে, সেখানে ভ্রমণকালে সে একটি ভুতুড়ে ছবি তার ক্যামেরায় তুলতে পেরেছিল। এটা খুবই বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল যার ফলে পৃথিবীজুড়ে বহু মানুষের নজর এখানে পড়েছিল। 21 বছর বয়সী থমাস বেভিস বলেন, তিনি যখন তার সেখানে তোলা ফটোগুলি দেখছিলেন তখন একটি ফটোয় এক জানালায় কম বয়সী ও তার সাথে এক বেশি বয়সী মহিলার ভুতুড়ে অবয়ব লক্ষ্য করেন। কুড়ি শতকের প্রথম দিকে যখন লোফটাস পরিবার দেউলিয়া হয়ে যায় এবং তাদের শেষ সদস্য টি মারা যায় তখন এই বাড়িটি বেনেডিক্টইনস সম্প্রদায় অধিগ্রহণ করে 1935 সাল অব্দি। 1937 সালে 'সিস্টার অফ প্রভিডেন্স' এটাকে একটি খ্রিস্টান মঠ ও মিশনারি স্কুলে রূপান্তরিত করেন, কম বয়সী মহিলাদের জন্য যারা অর্ডার যোগদান করতে চান। স্থানীয় মতে তখন মানুষেরা খুবই ভীত ছিল যে তারা সেখানকার প্রার্থনা সভায় কখনো একা যেত না কারণ কিংবদন্তি অনুযায়ী সেখানকার হলে শয়তান আসত।
1938 সালে লোফটাস হল মাইকেল দেভেরক্স কিনে নেন এবং 'লোফটাস হল হোটেল' নামে এটিকে খুলে দেন। মাইকেল হলে মারা যান এবং তার পত্নী বেশ কিছু বছর ধরে হোটেলটিকে নিজের প্রচেষ্টায় চালানোর চেষ্টা করেন এবং হঠাৎ এক রাত্তিরে তিনি কোন কারণ ছাড়া কাউকে না জানিয়ে সবকিছু ছেড়ে চলে যান। এরপর লোফটাস হল এক অন্ধকার যুগে প্রবেশ করে। সম্পত্তিটি পরিতক্ত ছিল কিন্তু এক যুগ ধরে সেটা একদল লোক দখল করে যারা সেখানে শতানীক আচার অনুষ্ঠান পালন করত এবং সভা করত। এরপর 2011 সালে এটিকে বর্তমান মালিক কুইগলি পরিবার কিনে নেন যারা এটিকে পূনর্গঠনের জন্য একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রজেক্ট তৈরি করেন। আজকে অর্থাৎ বর্তমানে লোফটাস হল সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত; যে কেউ এখানে 45 মিনিটের গাইডেড ট্যুরে যেতে পারেন এবং এই ভবন সম্পর্কে ইতিহাস এবং অন্যান্য বহু কিংবদন্তি সম্পর্কে জানতে পারেন। এই স্থানে ঘুরে আসার পর মানুষের মনে উত্তরের থেকে অনেক বেশি প্রশ্নের উদয় হয়। লোফটাস হল এর তথ্য এবং গল্পের মধ্যে দূরত্ব খুবই কম যার ফলে এটা বলা খুবই অসম্ভব যে, এর ইতিহাস কখন শেষ হয়েছে আর কিংবদন্তির কখন শুরু হয়েছে।
No comments:
Post a Comment