'ক্র্যাকেন' -- এই ভয়ানক সামুদ্রিক দানবটিকে বিভিন্ন জনপ্রিয় কমিক বুক গেম এবং টেলিভিশন শো এবং চলচ্চিত্রে দেখা গেছে -- এই সূত্র গুলি থেকে সাধারণভাবে এই প্রাণী সম্পর্কে জানা যায় যে এটি একটি বিশালকায় স্কুইড জাতীয় প্রাণী যা বিভিন্ন জাহাজকে আক্রমণ করে এবং এত শক্তিশালী যে চাইলেই যেকোনো জাহাজকে ডুবিয়ে দিতে পারে। যুলে ভার্নের "20000 leagues beneath the the sea" বইটিতে এবং ডিজনির বিভিন্ন গল্পের মুভি ভার্সনে এই ভাবেই প্রাণীটিকে দেখানো হয়েছিল এবং সম্প্রতি প্রাণীটিকে ডিজনির 'পাইরেটস অফ দি ক্যারিবিয়ান' মুভিটিতে দেখানো হয়েছিল।
অবশ্যই বৈজ্ঞানিকরা এই কিংবদন্তী সম্পর্কে সমালোচনা করতে বেশি সময় নেননি। তারা প্রশ্ন করেছিলেন স্কুইডের এই বিশাল আকৃতি হওয়া নিয়ে এবং কখনো এত বিশাল কোন স্কুইডকে দেখা যায়নি যে একটি জাহাজ ডুবিয়ে দিতে পারবে এবং এই বিশাল আকৃতির সাথে তাদের এই আক্রমনাত্মক মেজাজ সম্ভবত অতিরঞ্জিত করা হয়েছে বলে তারা মত প্রকাশ করেন।
এই ক্র্যাকেন সম্পর্কে প্রথম তথ্য আনা হয় প্রায় 3000 বছর আগে যেখানে ক্র্যাকেনকে স্কুইড হিসাবে বর্ণনা করা হয়নি এবং একে আক্রমনাত্মক বলেও অভিযোগ করা হয়নি।
13 শতকে 'orvar-oddr' এ প্রথম এর বর্ণনা পাওয়া যায় - একটি পৌরাণিক যেখানে দুজন সমুদ্রের দানবের কথা বর্ণনা করা হয়েছিল এই সময়কালিন 1250 সালে ক্র্যাকেন সম্পর্কে আরেকটি তথ্য Norwegian সাইন্টিফিক ওয়ার্ক চলার সময় সংগ্রহ করা হয়, সেটি হল এদের কেবল মাত্র দুটি বর্তমান ছিল কারণ এগুলি প্রজনন করতে পারত না এবং এদের বেঁচে থাকার জন্য প্রচুর খাদ্যের দরকার হতো।
17 শতকের মাঝামাঝি সময়ে এর উপর সাইন্টিফিক লিটারেচার প্রকাশ করা হয় কিন্তু তাতেও তাকে বর্তমানের মত হিংসাত্মক কোন বিশালাকৃতির স্কুইড হিসাবে বর্ণনা করা হয়নি। এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে ছোট ছোট তথ্যের এদিক-ওদিক হলে কোন ঘটনাকে সম্পূর্ণ বদলে দিতে পারে।
1751 সালে যখন বারগেনএর বিশপ এরিক তার লেখা 'ন্যাচরাল হিস্ট্রি অফ নরওয়ে' বইটি প্রকাশ করেন। তিনি সমুদ্রগামী জেলেদের থেকে ক্র্যাকেনএর বর্ণনা সংগ্রহ করেন -- যারা এই প্রাণীর সম্মুখীন হয়েছিল। বলা হয়, এই প্রাণীটি কখনো সম্পূর্ণ সামনে আসেনি কারণ এর বিশাল আকৃতি এবং সমুদ্রের অনেক নিচে থাকার কারণে এটি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য উঠে আসতো। যদিও এরিক প্রাণীটির আসল আকৃতি এবং বর্ণনা দিতে পারেননি; কিন্তু তিনি মনে করতেন যে তিনি যা দিয়েছেন তা ভবিষ্যতের গবেষকদের তদন্ত করার পক্ষে যথেষ্ট।
গরমকালের এই প্রাণীটি প্রায়ই সমুদ্রে উপরের দিকে উঠে আসে। এটা কখনো ঝড় অথবা অশান্ত সমুদ্র থাকাকালীন উপরে আসে না। এই দানবটিকে সমুদ্রতট থেকে কিছুটা দূরে যেখানে অন্তত 80 ফুট গভীরতা থাকে এই সকল স্থানে দেখা যায়।
ক্র্যাকেন মাছদের প্রতি আকৃষ্ট হয়; সমুদ্রের যেখানে মাছ বেশি থাকে সেইখানে তাদের গতিবিধি বেশি দেখা যায় বিশেষ করে কড ও লিং মাছ তাদের সবচেয়ে বেশি প্রিয় তাই যখন কোথাও শোনা যায় ক্র্যাকেনকে দেখা গেছে সেখানে অন্তত মাছ ধরার আশায় অন্তত কুড়ি পঁচিশ খানা নৌকাকে পৌঁছে যেতে দেখা যায়।
শিকার করার সময় ক্রাকেন আস্তে আস্তে সমুদ্রপৃষ্ঠের দিকে উঠে আসে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠে উঠলে তাকে অনেকটা সমুদ্রের মাঝে দ্বীপের মতো দেখায় যার ওপর প্রচুর মাছ ছটফট করতে থাকে, এরপর তার সুরগুলি উঠে আসে এগুলি অনেকটা মাঝারি আকৃতির জাহাজের মত উঁচু হয় এবংনিচের দিকে মোটা থাকে এবং উপরের দিকে আস্তে আস্তে সরু হয়। এরিকএর মত অনুযায়ী, এগুলি আসলে এই প্রাণীটির হাত যেগুলি একে চলাচল করতে সাহায্য করে। তিনি দাবি করেন, এই প্রাণীটির দৃশ্যমান দেহটি প্রায় এক মাইলের মতো ডায়ামিটার নিয়ে বিস্তৃত যদিও তিনি বলেছিলেন জেলেরা এর থেকেও বড় আকৃতির দাবি করেছিল, কিন্তু তিনি ন্যূনতম আকারের বর্ণনা দিয়েছেন।
জেলেদের মতে এরপর এই প্রাণীটি কিছুক্ষণ বাদে ডুবে যায় এবং নিচে যাওয়ার সময় ঘুরতে ঘুরতে একটি ঘূর্ণি সৃষ্টি করে যা এর আশেপাশের সব কিছুকে টেনে নিচে নিয়ে যায়।
তার তথ্য অনুযায়ী, ক্র্যাকেন বছরের কিছু মাস ধরে খাবার খেয়ে যায় এবং তারপর কয়েক মাস ধরে মলত্যাগ করতে থাকে। এদের মল ঘন হয় ও জলকে ভীষণ ঘোলাটে করে দেয়; কিন্তু মাছেদের দারুন রকম ভাবে আকৃষ্ট করে এবং এই সময় প্রচুর মাছ ক্র্যাকেন এর উপর এসে জমা হয় এবং তারপর ক্রাকেন এগুলোকে খেয়ে নেয়।
এরিক এর মতে ক্র্যাকেন চাইলেই যেকোনো নৌকাকে টেনে নিয়ে চলে যেতে পারে কিন্তু কখনো একে এত আক্রমনাত্মক হিসেবে দেখা যায়নি। যে যে মানুষের মৃত্যু বা আঘাত হয়েছিল সবগুলোই দুর্ঘটনাবশত এবং সাধারণত জেলেরাও এই প্রাণীকে ততটা চিন্তিত থাকতো না। বিশপ লিখেছিলেন, কয়েক বছর আগে একটি ছোট বোট নিয়ে দুজন জেলে ক্র্যাকেনের সমুদ্রপৃষ্ঠে উঠে আসার সময় তার অনেকটা কাছাকাছি চলে গিয়েছিল এবং সময়মতো দূরে পৌঁছাতে পারেনি। এই প্রাণীটির একটি সুর এই সময় বোর্ডের সামনে এসে পড়ে ফলে নৌকাটি ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে তাদের ভাঙা কাঠ অবলম্বন করে ভেসে ভেসে সমুদ্রের পাড়ে যেতে হয়।
এরিক আরো একটি ঘটনার কথা লিখেছিলেন যেটি 1680 সালে মিনিস্টার অফ নর্ডলান্ড এর রেভারেন্ড ফ্রিসে ঘটেছিল। একটি কম বয়সী ক্র্যাকেন সাঁতার কাটতে কাটতে সমুদ্রের ধারের সংকীর্ণ পাথর গুলির মধ্যে আটকে গিয়েছিল এবং তার একটি সুর গাছে আটকে গিয়েছিল ফলে সেটি সেখান থেকে বেরোতে পারেনি এবং মারা গিয়েছিল। এর দেহটি পচন ঘটায় বহুদিন ধরে দুর্গন্ধের ফলে সেই এলাকাটি অসহনীয় হয়ে গিয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত: এই সময় এর দেহের ছবি আঁকা বা মাপ নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এরিক মনে করতেন, এই প্রাণীটি হয়তো কোন প্রবাল কীট জাতীয় বা তারা মাছ অর্থাৎ স্টারফিশের মত কিছু হতে পারে এবং হয়তো এইটা পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন দ্বীপের গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনার সাথে জড়িত।
পরবর্তী 50 বছরে এই প্রাণীকে অনেকেই সমুদ্রের অন্যান্য কিংবদন্তির দানবের সাথে গুলিয়ে ফেলে এবং এর গল্পগুলি অন্যান্য সমুদ্রের প্রাণীর বা গল্পের সাথে সাথে মানুষ মিশিয়ে ফেলে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি বিখ্যাত আরবিক লোককাহিনী যেখানে সিনবাদ বলে এক নাবিক তার যাত্রাকালে সমুদ্রের মাঝে একটি রহস্যময় সবুজ রঙের দ্বীপে অবতরণ করেন বিশ্রাম নেওয়ার জন্য এবং তিনিই একমাত্র বাঁচতে সক্ষম হন যখন দ্বীপটি সমুদ্রের ঢেউ এর নিচে সাঁতরে চলে যায়।
আর একটি বিখ্যাত কাহিনী শোনা যায়, যেখানে আয়ারল্যান্ডের সেন্ট ব্রেন্ডন একটি ছোট্ট দ্বীপে রাত কাটানোর জন্য অবতরণ করেন এবং সকালে যখন নাবিকরা রান্না করার জন্য আগুন জ্বালাতে দিয়েছিল, তখন দ্বীপটি কাঁপতে শুরু করে এবং ডুবতে থাকে, তারপর সাঁতরে সমুদ্রের নিচে চলে যায়। সেই সময় কোন মানুষের মৃত্যু হয়নি এবং সকলে অবাক হয়ে গিয়েছিল যে ব্রেন্ডন প্রথম থেকেই জানতেন যে, এটি একটি মাছ ছিল। ঈশ্বর তাকে বলেছিলেন যে, রাত্রিরে তাদের জাহাজের অবতরণ করার পক্ষে একটি সুরক্ষিত। এই গল্পগুলি থেকে জানা যায় যে কীভাবে নাবিকরা ক্র্যাকেনএর উপর অবতরণ করে ক্যাম্প তৈরি করেছিল এবং যখন আগুন জ্বালিয়ে ছিল তখনই তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছিল এবং যখন এটি আগুন থেকে বাঁচতে সমুদ্রের তলায় ডুবে যেত এবং ঘূর্ণি সৃষ্টি হতো একমাত্র সেই ঘূর্ণির কারণেই মানুষ ডুবে মারা যেত।
1801 সালে নামক এক ফরাসি নামক বই প্রকাশ করেন এবং তাতে তিনি বিশাল আকৃতি অক্টোপাসএর অস্তিত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করেন এবং তিনি দাবি করেন যে এই ক্র্যাকেনগুলি আসলে এক ধরনের বিশালাকৃতির অক্টোপাস এবং তাদের সুরগুলি হচ্ছে তাদের হাতের মত এবং এবং তাদের দেহ থেকে নির্গত যে বস্তুটি মাছেদের আকৃষ্ট করত সেটি হচ্ছে অক্টোপাস 'ইনক'। তিনি একটি ছবিতে বর্ণনা দিয়েছিলেন কিভাবে এরা জাহাজকে জলে ডুবিয়ে দিত। এই বই সেই সময় যুক্তিবাদী মানুষেরা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু 1819 সালে পরিবেশবিদ এবং বৈজ্ঞানিকরা বিশাল আকৃতি স্কুইডের অস্তিত্ব নিয়ে অস্তিত্বের প্রমাণ খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছিলেন এবং এনার ক্র্যাকেন নিয়ে দাবি গুলিকে তারা পর্যালোচনা করেছিলেন তবে তাঁরা এগুলিকে অক্টোপাস না একটি স্কুইড হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন।
পরবর্তীকালে 1870 সালে জুল ভার্নের লেখা '20000 লীগস আন্ডার দ্য স্কাই' বইটিতে ক্র্যাকেনকে একটা কিংবদন্তিরূপে পরিচয় দেওয়া হয় এবং বইটির একটি অংশে বর্ণনা দেয়া হয় যে কিভাবে দৈত্যাকার স্কুইড জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছিল এবং এই বইটি বিখ্যাত হয়ে যাওয়ার পর ক্রাকেন সম্পর্কে এক নতুন ধারণা ছড়িয়ে পড়ে।
1735 সালে পৃথিবী বিখ্যাত সুইডিশ বোটানিস্ট, ফিজিশিয়ান এবং জুলজিস্ট কার্লোস লিনিয়াস তার 'সিস্টেমা নেচারে' বইটির প্রথম এডিশনে ক্র্যাকেনের কথা উল্লেখ করেন। 'ইকনোমিক ক্লাসিফিকেশন অফ লিভিং অর্গানিজম' এ এর কথা বর্ণনা করেন। তিনি রাখেন ক্র্যাকেনকে 'সেফালোপড' শ্রেণীভূক্ত করেন। যদিও পরবর্তী এডিসনগুলোয় এর কথা উল্লেখ করা হয়নি। লিনিয়াস 1746 সালে তার পরবর্তী প্রজেক্ট 'fauna suecica' তে একে এক 'ইউনিক মনস্টার' হিসাবে দাবী করেন, "যে নরওয়ের সমুদ্রে বাস করে কিন্তু আমি কখনো এই প্রাণীটিকে নিজে চোখে দেখিনি। "
যদিও ক্র্যাকেনকে বিশাল আকৃতির অক্টোপাস বা স্কুইড হিসাবে বর্ণনা করা হতো কিন্তু এটাকে কোথাও কোথাও কাঁকড়া জাতীয় প্রাণী হিসেবেও বর্ণিত করা হয়।
No comments:
Post a Comment