বহুকাল ধরে মনে করা হয় এক প্রকার দানব জাতীয় প্রাণী আফ্রিকার কঙ্গো রিভার বেসিনের উপরের দিকে বিচরণ করে বেড়ায় যার নাম দেওয়া হয়েছে 'মোকেলে মবেমবে'।
পল অহিন যিনি একজন মিশনারি এবং প্রায় এক দশক ধরে সেখানে বায়াকা পিগমি দের সাথে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে কাটিয়েছেন তার মতে, এই শব্দটির লিঙ্গলা ভাষা থেকে উৎপত্তি যার সাধারণ অর্থ হলো 'যে নদীর গতিপথকে থামায়'; বলা হয়, যেহেতু এই প্রাণীটি কঙ্গো নদীর বাক গুলির কাছে দেখা গিয়েছিল, সেই অনুসারে এই অর্থ করা হয়েছে; কারণ নদীর বাঁকে নদীর স্রোত কমে যায়। এছাড়াও 'রামধনু' এবং 'রহস্য' এর জায়গায় সেখানে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
যুগ যুগ ধরে মোকেলে মবেমবে নামের এই প্রাণীটির গঠন ও আকৃতি সম্পর্কে অনেক রকম বর্ণনা পাওয়া গেছে। তবে অনেক রকমের বর্ণনার মধ্যে সকলেই একমত হয়েছে যে, এই প্রাণী বিশালাকৃতির, এর গলা লম্বা ও তার তুলনায় ছোট আকৃতির মাথা এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বলা হয়েছে এর লম্বা লেজ আছে। এছাড়া জানা গেছে এই প্রাণীটি তৃণভোজী ও নদীর কাছাকাছি গুহায় বসবাস করে এবং যেখানে সে তার পছন্দের খাবারগুলি পেতে পারে অর্থাৎ কয়েক প্রকারের লিয়ানা গাছ।
যদিও প্রাণীটি তৃণভোজী কিন্তু একটি তথ্য অনুযায়ী, যদি মানুষরা তাদের দিকে এগিয়ে আসে তাহলে এটি আক্রমণাত্মক আচরণ করতে পারে। আবার অন্য একটি তথ্য অনুযায়ী, এই দানবের একটি শিং আছে অনেকটা রাইনোসরাস এর মত যা দিয়ে এটা হাতি কে মেরে ফেলেছিল। অনেকে এটাও দাবি করে যে মোকেলে মবেমবে আসলে একটি আধ্যাত্মিক বিষয় এটা কোন শারিরীক সত্তা নয়।
প্রথম এই প্রাণীটির কথা পাশ্চাত্য জগতে 1776 সালে পৌঁছায় কঙ্গো নদীর কাছে যাওয়া ফ্রেঞ্চ মিশনারি লেভিন বনাভেঞ্চার প্রয়াট এর দ্বারা। এই মিশনারি বলেছিলেন, যে তিনি এই অঞ্চলে 3.28 ফুটের ডায়ামিটারের বহু পায়ের ছাপ দেখতে পেয়েছেন। যদিও যে প্রাণীটি এই পায়ের ছাপ ফেলে গিয়েছিল তাকে দেখতে পাননি। এরপর কুড়ি শতক অবধি এই প্রাণীর তেমন কোন খবর পাওয়া যায়নি।
1909 সালের এক্সপ্লোরার লেফটেনেন্ট পল গ্রাজ একটি প্রাণীর কথা লেখেন যার বর্ণনা মোকেলে মবেমবে এর মত, ছিল যাকে স্থানীয়রা 'nsanga' বলে ডেকে থাকেন। বর্তমানে জাম্বিয়ায় বসবাসকারী অধিবাসীদের কিংবদন্তি কাহিনীতে এই প্রাণীটির কথা জানতে পারা যায় এবং বলা হয় এটি বাঙ্গৌলু লেকের কাছাকাছি এলাকায় বসবাস করত। গ্রাজ এর এই রিপোর্টটি খুবই উল্লেখযোগ্য ছিল কারণ তার বর্ণনা অনুযায়ী প্রাণীটি ডাইনোসরের মত দেখতে ছিল। তখন থেকেই মোকেলে মবেমবে নামের এই প্রাণীটিকে এক প্রকার ডাইনোসর হিসাবে মনে করা হতে থাকে।
ঠিক এই সময়ই একজন বিখ্যাত জার্মান শিকারি কার্ল হেগেনবাক দাবি করেন, তিনি এই প্রাণীটির কথা শুনেছেন। 'বিস্টস অ্যান্ড মেন' নামে তার অটোবায়োগ্রাফিতে তিনি লিখেছিলেন, তাকে একটি বিশাল বড় দানবের কথা বলা হয়, যে আধা হাতি ও আধা ড্রাগনের মতো দেখতে ছিল। যেটি রোডেশিয়ার (বর্তমানে জিম্বাবুয়ে) গভীর জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতো। হ্যানকক আরো লিখেছেন যে, "আমি এই সরীসৃপটির অস্তিত্ব সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম। এরপর এই দানবটিকে খোঁজার জন্য অনেক খরচা করে আমি একটি এক্সপিডিশন টিম পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এদের মধ্যে কেউ কেউ বাড়ীতে ফিরে আসতে পেরেছিল কিন্তু প্রমাণ কিছু করতে পারেনি।
হেগেনব্যাক হয়তো প্রথম বিদেশি ছিলেন যিনি এই প্রাণীটির উদ্দেশ্যে এক্সপিডিশন পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি শেষ ছিলেন না। এই প্রাণীটিকে খোঁজার উদ্দেশ্যে 2011 অব্দি প্রায় 50 এর উপর অভিযান চালানো হয়। পায়ের ছাপ, কিছু অস্পষ্ট ছবি এবং 1960 সালে এক মিশনারি রিপোর্ট, যাতে তিনি প্রত্যক্ষদর্শীকে পান, যে দাবি করে কিছু পিগমিকে সে একটি মোকেলে মবেমবে মারতে দেখেছিল। এছাড়া মোকেলে মবেমবে এর স্বপক্ষে তেমন কোনো জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
কোনো জোরালো প্রমাণের অনুপস্থিতির বিষয়টি ছাড়াও এই প্রাণীর অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ হয় আরো কিছু কারণে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যেমন অনেকে দাবি করে মোকেলে মবেমবে একটি প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসর তবে সে অনুযায়ী, এটা খুবই অসম্ভব যে সেটি কেবলমাত্র একটি থাকবে অথবা সামান্য কয়েকটি থাকবে। যদি মোকেলে মবেমবে নিজেকে পরিবর্তন না করে প্রায় 65 মিলিয়ন বছর ধরে কঙ্গো নদীর বেশিনে অস্তিত্ব রক্ষা করতে সক্ষম হয়ে থাকে তবে তাদের সংখ্যা অনেকগুলো হওয়া উচিত এবং যথেষ্ট অস্তিত্ব রেখে যাওয়া উচিত যাতে তাদের এতদিনে খুঁজে বের করা সম্ভব।
তবে এর বিপক্ষে একটি যুক্তি দেন জুলজিস্টরা যারা এই প্রাণীটির খোঁজে গিয়েছিলেন এবং তাদের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী তারা বিশ্বাস করেন যে প্রাণীটি মনুষ্যদ্বারা বা অন্য কোনো কারণবশত সম্প্রতি অতীতে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।
অতীতের অভিজ্ঞতা ও পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সাধারণত এটা বলা যায় যদি কোন প্রাণী অস্তিত্ব থাকে তবে তাকে খোঁজার জন্য সাধারণত 3 থেকে 6 টি অভিযান করলে সাফল্য আসতে পারে এবং এরপর থেকে তার অস্তিত্বের সম্ভাবনা কমতে থাকে। তাই প্রায় 50 টির উপর অভিযান করার পর এটা মনে হয় যে হয়তো মোকেলে মবেমবে প্রাণীটির বর্তমানে অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা খুবই কম।
যদিও এমন অনেকেই আছে যারা এখনো হার মানেনি এবং তাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে একদিন মোকেলে মবেমবেকে পাওয়া যাবে।
No comments:
Post a Comment