Wednesday, 27 May 2020

চেঙ্গিস খানের আক্রোশ -- একটি কিংবদন্তি ঐতিহাসিক প্রতিশোধের কাহিনী --


খারেজমীন সাম্রাজ্যর কথা হয়তো আপনি শোনেননি এটা অসম্ভব নয় কারণ চেঙ্গিস খান এর প্রতিশোধ এতটাই ভয়ানক ছিল।

1205 সালে নাঈমানের যুবরাজ কুচলাগ মঙ্গোলিয়া থেকে পালিয়ে যায় যখন চেঙ্গিস খান এবং তার মঙ্গল সাম্রাজ্য তাদের এলাকা দখল করে। 1208 সালে চেঙ্গিস খান কুশলগকে পরাজিত করেন এবং কুচলাগ আরো পশ্চিমে চলে যায় এবং সেখানে ঝিলুগু সাম্রাজ্যে রাজ কন্যাকে বিবাহ করেন। 

পরবর্তীকালে নিজের শ্বশুরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সৃষ্টি করে তিনি পশ্চিম লিয়াও সাম্রাজ্যের দখল নেন।  1216 সালে কুচলাগ বাসবালিক শহরে আক্রমণ করে, যেটা তখন মঙ্গল সাম্রাজ্যের আশ্রয় ছিল। তাই চেঙ্গিস খান তার অন্যতম পারদর্শী সেনাপতি জেবেকে সেখানে পাঠান এবং দুই বছরের মাথায় পুরো পশ্চিম অংশটি তার দখলে চলে আসে এবং মোঙ্গল সাম্রাজ্য খারেজমী সাম্রাজ্যের পর্যন্ত বিস্তার করে যায়। এই সাম্রাজ্যঃ খারেজমনের শাহ মোহাম্মদ ২ এর শাসনে ছিল। চেঙ্গিস খান তার ব্যবসায়ীদের সেখানে পাঠান খারেজমানদের সাথে ব্যবসা শুরু করার জন্য কিন্তু  অট্রার গভর্নর ইনালচুক এই ব্যবসায়ীদের গুপ্তচর বদনাম করে কারাগারে বন্দি করে রাখেন। বেশিরভাগ মানুষ তখনকার দিনে, পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত এই সাম্রাজ্য বিস্তারকারী ব্যক্তির সাথে সীমানা ভাগ করা ভালো বিষয় করতেন না,  তাই যখন চেঙ্গিস খান  500 মানুষের একটি দলকে ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে তার এই নতুন প্রতিবেশীর কাছে পাঠালেন তখন খারেজমী শাহের মনে সন্দেহ হয়েছিল। যদিও বেশিরভাগ ইতিহাসবিদদের মতে, চেঙ্গিস খানের এই সাম্রাজ্য দখলের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না।

এরপরেও আক্রমণ না করে বা হুমকি না দিয়ে চেঙ্গিস খান সেখানে তার 3 জন প্রতিনিধি পাঠান; যার মধ্যে দুজন মঙ্গল ও একজন মুসলিম ছিল তারা এই 500 জন মানুষকে মুক্তি দেওয়ার জন্য কথাবার্তা শুরু করেন। কিন্তু তবুও শাহ বদলাননি; তিনি দুইজন মঙ্গলের মাথা মুড়িয়ে দেন এবং মুসলিম দূতের মাথা কেটে ফেলেন। এছাড়া তিনি বন্দী থাকা 500 জন ব্যবসায়ীকে মৃত্যুদন্ডে দণ্ডিত করেন।

চেঙ্গিস খান অতিথি পরায়ণ নিয়ে এক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি তাদের এই অনৈতিক কাজে ক্রোধিত হয়ে পড়েন, তাই তারপর তিনি সিল্ক রোড থেকে তার শত্রুদের সম্পর্কে সকল তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন। তিনি চীন থেকে এলাকা দখল করা বিষয়ে পারদর্শী  ও অভিজ্ঞ একটি দল গঠন করে নিয়ে আসেন এবং খারেজমী সাম্রাজ্যঃ দখলের জন্য তার সেনাবাহিনীকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেন। মঙ্গোলিয়ানদের কাছে এক লাখের উপর সৈন্য ছিল।
.
1219 সালের শীতের সময় তিনি যোশি এবং যেবেকে ফার্ঘানা প্রদেশ লুটপাটের জন্য জন্য 20,000 সেনাসমেত পাঠান।

খারেজমিয়ান সৈন্যরা ভেবেছিল যে এই আক্রমণকারী দলটি মূল শক্তি ছিল কিন্তু অন্য দিক থেকে চাগাতাই খান এবং ওগেদাই খান যুগারিয়ান গেট দিয়ে ঢুকে অত্রারের 20,000 জন এর শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে আটক করে ফেলে। এর পাঁচ মাস বাদে এক পলাতক শহরের দরজা খুলে দিয়ে মোঙ্গলদের শহরের ভেতরে প্রবেশ করতে সাহায্য করে; তারপর এখানে মানুষদের বন্দী করা থেকে শুরু করে গণহত্যা শুরু হয়ে যায় এবং শহরটি মাটিতে মিশে যায়। ইনালচুকের চোখে এবং কান দিয়ে গলিত রুপো ঢেলে হত্যা করা হয়।

এরপর চেঙ্গিস খান এবং তার সৈন্যরা দুর্গম কিজিলকুম মরুভূমি অতিক্রম করে এবং বুখারা দখল করে নেয়। এখানকার রক্ষীরা যুদ্ধ ও গণহত্যা শুরু হওয়ার আগেই পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। চেঙ্গিস খান খারেজমী সাম্রাজ্যের রাজধানী সামারকান্দ এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। 1220 সালে এই শহরের 40,000 জনের শক্তিশালী সৈন্যবাহিনীকে ঘিরে ফেলেন। এরপর তৃতীয় দিনে যখন সেই বাহিনী আক্রমণ শুরু করে, তখন চেঙ্গিস খান একটি ছলনা পূর্বক পলায়ন করেন এবং এই বাহিনীকে প্রলুব্ধ করে বাইরে বের করে আনেন ও  প্রায় অর্ধেক সংখ্যক বাহিনীকে হত্যা করা হয়। তাদের দুটি সাহায্যের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং পঞ্চম দিনে বেঁচে থাকা কিছু হাতেগোনা সৈনিক আত্মসমর্পণ করে; এরপর এক লাখ জনসংখ্যা বিশিষ্ট শহরে বিপুল নরসংহার  শুরু হয়ে যায়। শাহ এবং তার পুত্র উত্তর-পশ্চিম দিকে পালিয়ে যায় এবং চেঙ্গিস খান সেনাপতি সবেতেই এবং জেবেকে  20,000 সৈন সহকারে তার উদ্দেশ্যে রওনা করিয়ে দেন।  এদিকে সামারকান্দ ধ্বংস করার পর উর্গেস কে ধ্বংস করে দেওয়া হয় এবং খোরাসান, রেজিন, বালক, মারভ নিশাপুরে - তারা পরপর সাফল্য পেতে থাকে; এদিকে হেরাত এবং অন্যান্য শহর যারা শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করেছিল তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়। নিজেদের কার্যসিদ্ধির জন্য এবং এইসব শাসকদের শাসনের বিরুদ্ধে মঙ্গোলরা একটি দক্ষ নিষ্ঠুরতার পরিকল্পনা ব্যবহার করেছিল।

এদিকে মহম্মদ এর পুত্র জালালউদ্দিন মিংবুমু প্রায় 60,000 জন তুর্কি এবং আফগানি যোদ্ধাদের দলকে নিযুক্ত করেন। ফলে চেঙ্গিস খান সেনাপতি শিকিখতুক কে 30,000 জন সৈনিকের নেতৃত্বে জালালুদ্দিন এর উদ্দেশ্যে কাবুলের উত্তরে পাঠান।
এটি নিশ্চিত যুদ্ধপরিস্থিতিতে একটি সরু খাতের মাঝে দুই সেনাবাহিনী মুখোমুখি হয়। যে স্থানটি মঙ্গলিয়ান সেনাবাহিনীর পক্ষে অনুপযুক্ত ছিল।  ফলে মঙ্গল সেনাবাহিনী একটি লজ্জাজনক হারের সম্মুখীন হয় এবং যখন তারা পিছু হটতে থাকে। তখন জালালউদ্দিন তার সৈন্যদের পুনরায় আক্রমণে পাঠায়, ফলে এই বাকি সেনাবাহিনীর অর্ধেক জন হারিয়ে যায় এবং বাকি অর্ধেক পালাতে সক্ষম হয়। এই পরাজয় মঙ্গল বাহিনীর অপরাজেয় তকমাটি ভেঙে দেয়।

এরপর খারেজমী সাম্রাজ্যের জন্য মধ্য এশিয়ায় বিদ্রোহের সূচনা হয় যদিও জালালউদ্দিনের সেনাবাহিনীর মধ্যে পরবর্তী কয়েক মাসে একটি অন্তর্দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় এবং জালাল উদ্দিন ভারতবর্ষে আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে পালিয়ে আসে; কিন্তু জালালউদ্দিনেই বাহিনী ইন্ডাস নদী পেরোনোর  আগে চেঙ্গিস খান তাদের ধরে ফেলে ফেলতে সক্ষম হয় এবং মঙ্গল বাহিনী তাদের সেনাবাহিনীকে ধুলিস্যাৎ করে দেয়। 
এরপর 20,000 জনের মোঙ্গলবাহিনী যুবরাজকে ধরে আনার উদ্দেশ্যে পাঠানো হয় কিন্তু তাকে আর  খুঁজে পাওয়া যায়নি। খারেজমিনের বেশিরভাগ অংশ দখলে চলে যায় এবং শাহ তার বাকি জীবন ক্যাস্পিয়ান সমুদ্রের একটি দ্বীপে নির্বাসনে কাটাতে কাটাতে দেহত্যাগ করেন। এদিকে মোঙ্গলরা মধ্য এশিয়ার জনসংখ্যা দুই মিলিয়ন থেকে 2 লাখে কমিয়ে আনে এবং তারা অন্যান্য সম্রাজ্য দখল করার জন্য মনোনিবেশ করে।

এদিকে ইন্ডাস নদীর তীরে যুদ্ধের পরে জালালউদ্দিন তিন মাস পাঞ্জাবে কাটান, তার শক্তি সঞ্চয় এবং হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন এলাকা দখল করার উদ্দেশ্যে তিনি মামেলুক এর সুলতান ইলতুৎমিশের সাথে সন্ধি করার চেষ্টা করেন কিন্তু  ইলতুৎমিস চেঙ্গিস খানের বিরুদ্ধে তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বরঞ্চ 1224 সালে সুলতান জালালউদ্দিনকে আক্রমণ করে এবং তাকে লাহোর ত্যাগ করতে বাধ্য করে।  যেহেতু জালাল উদ্দিনের পিতা অনেকদিন আগেই মারা গিয়েছিল তাই জালালুদ্দিন খারেজমিন সাম্রাজ্যের মুকুট সহজেই পুনরাধিকার করে নেন।  তিনি আজারবাইজান দখল করেন এবং তার রাজধানী তব্রিজ এ নিয়ে যান।  এরপর তিনি জর্জিয়া দখল করেন এবং বিলিসি নামে একটি বড় শহরের দখল করে সেখানকার খ্রিস্টান এবং মুসলিম উভয় বাসিন্দার গণহত্যা করেন।

এরপর মঙ্গল 1227 সালে একটি ছোট বাহিনী ইরানে পাঠায় কিন্তু জালালউদ্দিন এদেরকে পরাজিত করে। কায়াওয়াবাদ, আয়ুবিদের সুলতান এবং আর্মেনিয়ার রাজা জালাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে একত্রিত হয় এবং 1228 সালে তাকে ইরাভানে পরাজিত করে।  এরপর তার সাম্রাজ্যঃ জুড়ে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও গৃহযুদ্ধ সূত্রপাত হয়।

অবশেষে চেঙ্গিস খানের পুত্র অগেদেই খান তার চর্মাকান নামক সেনাপতিকে ইরান পুনর্দখলের জন্য পাঠান এবং সেখানে সেন্ট্রাল ইরানে 1231 সালে জালালউদ্দিন পরাজিত হয়ে তুর্কিতে পালিয়ে যায়। যেখানে তাকে হত্যা করা হয় এবং খারেজমী সাম্রাজ্যের অবশেষে সমাপ্তি ঘটে এরপর জর্জিয়া ও অন্যান্য দেশগুলি মঙ্গলের ছত্রছায়ায় চলে আসে। 

No comments:

Post a Comment