বর্তমানে কালাহারি মরুভূমি কে পৃথিবীর শুষ্কতম স্থানের মধ্যে অন্যতম হিসাবে দেখা হয়। কালাহারি শব্দটি উৎপত্তি 'tswana' শব্দ থেকে যার অর্থ - ভীষণ পিপাসা; তাই জন্য এই স্থানটি কোন প্রাচীন শহরের অবস্থান হিসেবে কল্পনা করা কষ্টকর। কিন্তু এখানকার প্রাচীন কিংবদন্তি বা আদিবাসীদের লোককথায় পাওয়া যায় মরুভূমির সমুদ্রের মাঝে কোথাও প্রাচীন শহর অবস্থিত আছে যা এখানকার কেউ তৈরি করেনি।
ঘটনার সূত্রপাত 1885 সালে যখন আমেরিকান উইলিয়াম লিওনার্ড যিনি একজন বিনোদনকারী ছিলেন এবং পরবর্তীকালে একজন অভিযাত্রী হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন, 'গিলার্মো ফেরিনি' - ছদ্মনামে কালাহারিতে এসেছিলেন এবং তার দলে তার সন্তান লুলু ও যোগদান করেছিল। একটি শুষ্ক অঞ্চলে যাতায়াতকালে তাদের সামনে প্রাচীন ভগ্নাবশেষ এসে পড়ে। বিশাল বিশাল পাথরের তৈরি এবং সিমেন্ট দিয়ে তৈরি পাথরের দেওয়াল এবং সেমিসার্কুলার স্থাপত্য দেখতে পান। তিনি এখানে কোন চিহ্ন বা লেখার খোঁজ করেছিলেন কিন্তু এ জাতীয় কিছু খুঁজে পাননি। তিনি দাবি করেছিলেন যে এটা কোন প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ হতে পারে যা কালাহারি মরুভূমিতে অবস্থিত ছিল।
ফেরিনী তার আবিষ্কার গুলি বা তথ্যগুলি বার্লিনের জিওগ্রাফিকাল সোসাইটির কাছে পেশ করেন এবং 1886 সালে আবার গ্রেট বৃটেনের রয়েল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটির কাছেও নিয়ে যান. তিনি তার এই আবিষ্কার নিয়ে একটি বইও প্রকাশ করেছিলেন।
বুশম্যান |
ফেনীর এই দাবিগুলো অভিযাত্রীদের মনে এক অসাধারণ আকর্ষণের সৃষ্টি করেছিল। কালাহারি মরুভূমিতে পরবর্তী 130 বছর ধরে অন্তত 30 টি এক্সপিডিশন এই প্রাচীন শহরের উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। একটি বড় জটিল সমস্যা ছিল যে ফেরেনি কিভাবে সেই স্থানে পৌঁছেছিল অর্থাৎ তার যাত্রাপথ বা দিক নির্দেশ এর বর্ণনা বিস্তারিত ভাবে পাওয়া যায়নি। এছাড়া তিনি বলেছিলেন যে, এই স্থানের অর্ধেক অংশ মরুভূমির নিচে ডুবে আছে তাই এই স্থানটি খুঁজে বের করা খুবই কষ্টকর। বিশাল কালাহারি মরুভূমিতে এই ধ্বংসাবশেষ খুঁজে বের করা অনেকটা খড়ের গাদায় সুঁচ খোঁজার মতো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
1964 সালে এ.জে.ক্লিমেন্ট নামক একজন অধ্যাপক ও অভিযাত্রী দাবি করেছিলেন যে তিনি হয়তো ফেরিনীর আসল যাত্রা পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি মানুষের বসতির কোন হদিস পাননি, তবে তিনি ডলেরাইট পাথর দিয়ে তৈরি কিছু অদ্ভুত রকমের গঠন দেখতে পেয়েছিলেন।
এছাড়া ব্যাসল্ট এবং 'gabbro' এর মাঝে দানাদার আকৃতি বস্তুর উপস্থিতি লক্ষ্য করেছিলেন।
ডলোরাইট এর পরিখায় প্রায়ই দেখা যায় যেখানে উত্তপ্ত বা গলে যাওয়া পাথর পুরনো পাথরকে ভেদ করে দেওয়ালের মত আকৃতির জিওলজিক্যাল ফর্মেশন সৃষ্টি করে। একে 'ডাইক' বলে এই 'ডাইক' যে পাথর গুলি দিয়ে তৈরি হয় তা সাধারনত আশেপাশের পাথরগুলি থেকে বেশ শক্তপোক্ত হয় তাই অন্যান্য পাথরগুলি ক্ষয় হয়ে যাওয়ার পর কেবলমাত্র 'ডাইক' অবস্থান করে এবং কয়েকটি ডলোরাইট পাথরের ডাইস দেওয়ালের মত অংশের সৃষ্টি করে - যা দূর থেকে দেখে কোন প্রাচীন শহরের দেওয়াল বলে মনে হতে পারে।
তাই ক্লিমেন্ট বলেছিলেন, হতে পারে পারিনি এই জাতীয় কিছু 'রক ফর্মেশন' এর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভুল করে মানুষের তৈরি স্থাপত্য ভেবেছিলেন এবং তিনি মনে করতেন বেশিরভাগ কালাহারি অঞ্চল গত অন্তত 15000 বছর ধরে কোন সভ্যতার উপস্থিতির পক্ষে খুবই শুষ্কতম স্থান।
কাছাকাছি 2013 এবং 2016 সালে দুইটি এক্সপিডিশন লঞ্চ করা হয়েছিল 'marcahuasi project' নামক একটি রিসার্চ প্রজেক্ট এর জন্য একটি অনুসন্ধান চালানো হয়েছিল যাতে কোন কৃত্রিম স্থাপত্য বা কোন ব্যতিক্রমী গঠন খোঁজার চেষ্টা হয়েছিল। এতে গুগল ম্যাপ এর সাহায্য নেওয়া হয়েছিল। এই অনুসন্ধানটিতে খুবই উচ্চ প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়েছিল; কিন্তু হারিয়ে যাওয়া শহরের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এরপর 2016 সালে একটি ট্রাভেল চ্যানেলের সহায়তায় একটি এক্সপিডিশন চালানো হয়। এই এক্সপিডিশনে এরিয়াল সার্ভে এবং রাডার এর সাহায্য নেওয়া হয়। সেখানে পাথরের প্রাচীন এবং অস্বভাবিক গঠন খুঁজে পাওয়া গেছে; অনেকটা ফেরিনির বর্ণনার মত। কিন্তু সেগুলি মনুষ্যনির্মিত না প্রাকৃতিক তা এখনো অস্পষ্ট রয়ে গিয়েছে।
চাকো ক্যানিয়ন ডেসার্ট সিভিলাইজেশন |
কালাহারিমরুভূমির ভেতরে কোন শহরের অবস্থান করার পক্ষে সবচেয়ে বড় বিরোধিতা হলো এখানকার অসম্ভব শুষ্ক আবহাওয়া। সূর্যের এই অসম্ভব পুড়িয়ে দেওয়া তেজে কোন প্রাচীন সভ্যতার অবস্থান খুবই কঠিন। কালাহারি মরুভূমি আধা শুষ্ক এবং আধা আদ্র কালাহারি বেসিনের একটি অংশ যা বতসোয়ানার বেশিরভাগ অংশ, নামিবিয়ার কিছু অংশ এবং দক্ষিণ আফ্রিকা কভার করে; টেকনিক্যালি একে 'সাভানা' বলা যেতে পারে।
এর উত্তর অংশ তুলনামূলকভাবে বৃষ্টি হয় যার জন্য এখানে কিছু প্রকার গাছপালা এবং ঘাস এবং কিছু প্রকার পশু দেখতে পাওয়া যায়। সাভানার দক্ষিণ প্রান্ত আরো শুষ্ক এবং এখানে বেশিরভাগ বালিয়াড়ি অঞ্চল দেখতে পাওয়া যায়। যেহেতু এটি খুবই শুষ্ক তাই কালাহারি মরুভূমিতে কোন মনুষ্যবসতি দেখতে পাওয়া যায় না। কেবলমাত্র 'san people' বা 'বুশম্যান' নামক এক জাতির মানুষ এর কাছাকাছি বসবাস করে। এরা বহু প্রাচীন কাল ধরে এই স্থানে বসবাস করে। বলা হয় এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম আদিবাসীদের মধ্যে অন্যতম। আর্কিওলজিক্যাল রেকর্ড অনুযায়ী অনুমান করা যায় যে, কালাহারি মরুভূমিতে বসবাসরত অধিবাসীরা বেশিরভাগই ভ্রাম্যমান শিকারি বা 'hunter- gatherers' হিসাবে জীবনযাপন করেছে। এদের বড়জোর ছোট ছোট কিছু গ্রাম দেখা গেছে কিন্তু কোন বড় বসতি বা শহর করে থাকার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এত শুষ্ক থাকা সত্বেও এখানে জলের দুটি বড় উৎস আছে এই অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ বিশাল জলাধার আছে এবং এছাড়াও 'অকাভাঙ্গ' নদী এর পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে - যা মূলত এখানকার জলের চাহিদা যোগান দেয়। তাই এদের থেকে দূরে অবস্থিত কালাহারি মরুভূমির ভিতরে কোন শহর তৈরি করলে তাদের পক্ষে জলের ব্যবস্থা করা খুবই দুস্কর বিষয়।
তবে মানব সভ্যতার ইতিহাসে ব্যতিক্রমী কিছু ঘটনাও দেখা গেছে। যেখানে কালাহারি মরুভূমি থেকেও অনেক শুষ্ক জায়গায় মানুষ বসতি স্থাপন করেছিল। এরকম একটি উদাহরণ হচ্ছে - আমেরিকান 'চাকো ক্যানিয়নের' 'ডেজার্ট সিভিলাইজেশন' বা 'প্রোটো সিভিলাইজেশন' এই চাকো ক্যানিয়নটি হচ্ছে মেক্সিকোর উত্তর-পশ্চিমের সান যুয়ান বেসিনে অবস্থিত একটি ক্যানিয়ন। এটি খুবই শুষ্ক অঞ্চল যেখানে জলের প্রধান উৎস 'চাকো' নদী যার সৃষ্টি হয় বর্ষার সময় জমে থাকা জল নেমে আসলে। প্রচুর শুষ্ক অবস্থা হওয়া সত্বেও বহু শতাব্দী ধরে এখানে মানুষেরা বসবাস করে গিয়েছে। প্রায় 800 খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন 'পুব্লন' মানুষেরা এই ক্যানিয়নে এসে বসবাস করতে শুরু করে এবং তার কয়েক শতাব্দী মধ্যেই তারা বাঁধের মাধ্যমে একটি জটিল সেচ প্রণালী গড়ে তোলে এবং এইভাবে জলের ব্যবহার করতে থাকে। পরবর্তীকালে তারা ধীরে ধীরে ছোট থেকে বিভিন্ন বড় বড় গ্রাম গড়ে তোলে। বড় গ্রামগুলিতে বা এগুলির কেন্দ্রে অনেক বড় বড় বাড়িও খুঁজে পাওয়া যায় যেগুলি তে অনেকগুলি কক্ষ, ধর্মীয় স্থান এবং স্তর ছিল।
এই বড় বড় বাড়ি গুলির মধ্যে অন্যতম ছিল 'পুয়েব্লো বনিতো' - যেখানে দূরবর্তী অঞ্চল থেকে ব্যবসা করে আনা জিনিসপত্র মজুদ রাখা হতো। এই চাকোয়ানরা সত্যিকারের বড় কোন শহর গড়ে তোলেনি ঠিকই; কিন্তু তাদের একটি জটিল সমাজ ব্যবস্থা ছিল এবং এদের কেন্দ্রবর্তী অঞ্চলগুলির আকার বড় বড় গ্রামের সাথে তুলনা করা যায়। তাদের কাছে বড় বড় স্থাপত্য অথবা বিল্ডিং তৈরি করার জন্য যথেষ্ট শ্রমিক এবং পুঁজিও ছিল। এখানে চাষবাস করার পক্ষে অনুপোযোগী স্থান হওয়া সত্বেও তারা টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছিল; যদিও সেটা চিরস্থায়ী হয়নি --1130 সালের শুরুর দিকে ক্যানিয়ন এক খরা দেখা দেয় এবং 1200 সাল নাগাদ বেশিরভাগ মানুষ স্থানটি ত্যাগ করে চলে যাওয়া শুরু করে।
যদি চাকো ক্যানিয়নের মত স্থানে প্রাচীনকালে এরকম একটি উন্নত মানের বসতির অবস্থান সম্ভব হয় তবে কি কালাহারি মরুভূমিতেও এরকমই কিছু ছিল?
কিন্তু এরকম ঘটনা খুবই বিরল, পৃথিবীর অন্যান্য শুষ্কতম স্থান গুলি; যেমন- চিলির আটাকামা মরুভূমি বা মধ্য অস্ট্রেলিয়ায় যে সকল আদিবাসীরা বাস করে, তাদেরকে সাধারণত কোন বড় বসতি স্থাপন করতে দেখা যায়নি।
প্রাচীন সুমের এবং ইজিপ্টের সভ্যতাও মরুভূমি স্থানে গড়ে উঠেছিল কিন্তু তাদের কাছে জলের অভাব ছিল না কারণ তারা মরুভূমির কেন্দ্রে নয়, বরঞ্চ নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল।
যদিও কালাহারি মরুভূমি আজকের দিনে শুষ্কতম অঞ্চল কিন্তু এটা সব সময় এতটা শুষ্ক ছিল না প্রায় 10000 বছর আগে কালাহারি বেসিন এ অনেক বড় বড় জলাশয় অবস্থান করতো এবং এখানে গাছপালা থাকার দরুন আরো অনেক সবুজ ছিল।
তাই এটা বলা যেতে পারে যে 10,000 বছর আগে যখন এই মরুভুমি শুষ্ক ছিলনা, হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন শহরটি হয়তো তখন এখানে অবস্থান করতো; কিন্তু এই সময়কালীন দক্ষিণ আফ্রিকায় কোন বড় সভ্যতার বসতি গড়ার করার কোন প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। তাই এটি যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে এটি সাব সাহারান আফ্রিকার প্রথম বড় মনুষ্য বসতি হতে পারে।
ইতিহাসবিদ গুস্তাভ প্রেলুদে এখানকার লোককাহিনীর বর্ণনা অনুযায়ী পেরিনির বর্ণিত স্থান থেকেও উত্তরে আরো কিছু মূল্যবান পাথর খুঁজে পান এবং তিনি দাবি করেন এখানে কিছু ধ্বংসাবশেষ ছিল। কিছু কিছু মানুষ দাবি করেছেন যে, মরুভূমির মাঝে কৃত্রিম খাত, এমনকি জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেয়েছেন।
এই নিদর্শন গুলিকে নিছক ব্যতিক্রমী একপ্রকার রক ফর্মেশন ভেবে নিয়ে কি মানুষ আপাতত তাদের খোঁজ বা অভিযান বন্ধ করে নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে ? যদি এখানে সত্যিই কোনো প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন ভবিষ্যতে প্রমান হয়ে যায় তবে নিঃসন্দেহে সেটা স্মরণীয় একটি বিষয় হবে।
আপনার কি মনে হয় ?
No comments:
Post a Comment